বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে। মাঝে মাঝেই দেয়। ভিতরের সব কিছু যেন উলট পালট
হয়ে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে টেবিলের উপর রেখে ব্যথাটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা
করে শ্যামা। পারে না। রাত গভীর মা-কে ডাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এখন মা-কে
ঘুম থেকে জাগালে সারা রাত আর ঘুম আসবে না। মা-র ঘুম খুব কম হয়। একবার ঘুম
ভাঙলে কোন ভাবেই তা আর আনতে পারেন না। খাটের উপর শুয়ে আছে ছোট বোন চম্পা।
সেদিকে তাকায় শ্যামা। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে চম্পা। কি সুন্দর মায়াবী মুখ।
দেখলেই মুখ টিপে আদর করতে ইচ্ছা হয়। ..............
টেবিলের এক কোণে চম্পার বই গুলো রাখা। এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। শ্যামার হাতে একটা বই। নাম উজ্জল বেদনা। বেদনা কিভাবে উজ্জল হয় তা মাথায় ঢুকে না শ্যামার। তবে গল্পটা পড়তে ভালই লাগছে। গল্পের নায়িকা চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করছিল। নায়িকার নাম কল্পনা। গল্পের নায়কটা একটু লোভী প্রকৃতির। স্বভাবও ভাল না। শুধু নায়িকাকে একান্তে পেতে চায়। নায়িকা কোন ভাবেই বিয়ের আগে একান্তে যেতে চায় না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে একটা যুদ্ধ লেগে আছে। নায়ক একটা পরিকল্পনা করছে। ওর বন্ধু জাফর। জাফরদের বাড়ীর সবাই এক বিয়েতে যাচ্ছে। বাসা খালি থাকবে। জাফরের সাথে কথা বলে পরিকল্পনা করছে অন্য কিছু বলে কল্পনাকে জাফরের বাড়িতে নিয়ে যাবে। সেখানে নিতে পারলেই হলো। এতদিনের শখ পূরণ হবে।
পরিকল্পনা শুধু ঐটুকুই না। আরো বেশ কিছু পরিকল্পনা আছে। এরিমধ্যে একটা ভিডিও ক্যামেরা ঐ রুমে থাকবে। কল্পনা বুঝতে পারবে না। ঐ ক্যামরায় সব কিছু ধারণ হয়ে যাবে। নায়কের নিজেরই ক্যামেরা আছে। সেটা জাফরকে দেখায়।
জাফর ক্যামেরা দেখে বলে, এটার জুম কম। সব কিছু স্পষ্ট আসবে না। আরো ভাল ক্যামেরা দরকার। এ ক্যামরায় ছবি হালকা বুঝা যাবে না। সাউন্ডও তেমন নিতে পারবে না।
নায়কের নাম জাকির। সে একটু চিন্তায় পড়ে যায়। এ বিষয়টাতো আগে চিন্তা করে নাই। ভাল ক্যামেরা দরকার। এতবড় সুযোগ ভাল ক্যামেরার জন্য হাতছাড়া হবে সে কল্পনা করতে পারে না। সব কিছু পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। তাহলে. ভাল ক্যামেরা কই পাবো?
-আমার আছে। চাচা আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছেন। অনেক রেজুশেলন। জুমও অনেক শক্তিশালী।
-তোর থাকলে তো হয়ে গেল এ বিষয়ে আর চিন্তা করতে হচ্ছে না।
-না, চিন্তার আছে, মা-রা বিয়েতে যাওয়ার সময় ক্যামেরাটি নিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। অন্য ক্যামরা যোগাড় করতে হবে।
ওদের পরিকল্পনা এগুচ্ছে। অতটুকু পড়ছিল শ্যামা। শ্যামার ইচ্ছা করছিল ওদের সব পরিকল্পনা কল্পনাকে গিয়ে বলে দেয়। কল্পনা যে কি ভয়ংকর ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে তা জানিয়ে দিতে। এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছা হয়। কল্পনার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলতে, কল্পনা তুমি কখনো যেও না। অনেক বিপদ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। প্লিজ তুমি ভুল বুঝো না।
আচ্ছা কল্পনা একজন অপরিচিত মেয়ে। তাকে তুমি বলা কি উচিত? আপনি বলতে হবে। অপরিচিতকে আপনি বলাই কর্তব্য। একসময় মনে হয় আপনি তুমি তুই না থেকে ইংরেজীর মত একটাই থাকলেই হয়ত ভাল হত। আবার ভাবে, না ঠিক আছে বৈচিত্র আছে। আপনি তুমি যাই বলুক। কিন্তু কল্পনাকে বলার জন্য পাচ্ছে কোথায়। ও যে গল্পের নায়িকা।
ব্যথা বাড়ছে। কষ্ট করে উঠে পানির বোতল থেকে অনেক খানি পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল শ্যামা। একটা আয়না ঝুলছে। সেখানে চোখ পড়তেই দেখল মুখে ব্যথার ছাপ। মুখ কুঁচকে গেছে। শরীরের ব্যথাটা মুখে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
শ্যামা গল্প উপন্যাস পড়ে এটা ঠিক মানায় না। ওর মত যারা এসব কাজ করে তারা কি গল্প উপন্যাস পড়ে? কেউ শুনলে হাসবে। অনেক বেশি হাসবে। টিটকারী মেরে বলবে ওদের আবার গল্পের বই পড়া। ওরাই তো প্রতিদিন গল্প খেলে। ওদের গল্পের বই পড়ার দরকার কি?
ডাক্তার দেখাতে হবে। আজও কাজে যেতে পারেনি। গত দুই দিন যাওয়া হয়নি। এসব ব্যাপারে ওকে সাহায্য করে আকাশ। আকাশ মহা বিরক্ত। অসুখ বিসুখ তো থাকবে। তাই বলে বাদ দিতে হবে কেন? তোমার তো কিছু করতে হচ্ছে। যা করার ঐ পক্ষই করে।
গতকাল এসেছিল আকাশ। আকাশ ছেলেটাকে অনেক পছন্দ শ্যামার। সরাসরি বলে দেয় সব। প্যচাই কথা বলে না।
-বুক ব্যথাটা প্রতিদিন উঠছে।
-ডাক্তার দেখাও। এখনি যেতে চাও? চলো।
-না এখন না। হয়ত এম্নেই ঠিক হয়ে যাবে। অযথা কতগুলো টাকা খরচ। ডাক্তারের কাছে গেলেই এই টেস্ট ঐ টেস্ট।
তা শুনে হেসে উঠে আকাশ।
-হাসছো কেন?
ইচ্ছা হলো তাই হাসলাম। লতিফা আজ অনেক বড় ট্রিপে গেছে। সাতদিনের ট্রিপ। দশ হাজার টাকার। এক শিল্পপতি কক্সবাজার যাচ্ছেন। তার সাথে থাকবে।
দূরের ট্রিপে অনেক টাকা বেশি দেওয়া হয়। কিন্তু শ্যামা যায় না। মা, বোনকে ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকতে ভাল লাগে না শ্যামার।
-আরে কথা কাটাচ্ছো কেন? হাসলে কেন সেটা বলো।
-হাসলাম যখন বলেই দিই। সামনের বার আমি একজন ডাক্তার খুঁজব। ঐ ব্যটা ওর কাজ করবে। আর এই ফাঁকে তুমি তোমার সমস্যার কথা বলে প্রেসক্রিপ্ট নেবা। তোমার জন্য ঐ ব্যাটাকে টাকা দিতে হবে। কিন্তু তোমাকে দিতে হবে না টাকা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। ফ্রি চিকিৎসা।
বলে হু হু করে হেসে উঠে আকাশ।
আরো কিছুক্ষণ ছিল। চলে যায়।
......................০২...............
ব্যথা বাড়ে। মাঝে মাঝে ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। কাজে যেতে পারে না। আর এ পেশাতে কাজে না গেলে কোন টাকা আসে না। যতক্ষন কাজ ততক্ষণের টাকা আসবে শুধু। তাই বাধ্য হয়ে ডাক্তার দেখাতে যায়। আকাশ সঙ্গে যায়।
ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট করতে দেন। করা হয় সব। পেটে টিউমার হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে। না হলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। টিউমার বড় হয়ে গেলে পরে আর কিছুই করার থাকবে না।
অপারেশনের জন্য ১০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এত টাকা দেবে কে? নিজের কাছে সব মিলে এক লক্ষ টাকার মত হবে। এই টাইপের মেয়েকে কেউ সাহায্য করবে না। এদের সাহায্য করলে পাপ মনে হবে। কে আসবে সাহায্য করতে গিয়ে পাপ নিতে। ছাত্রী হলে মেধাবী ছাত্রীর অপারেশনের জন্য টাকা প্রয়োজন বলে টাকা তোলা যেত। কিন্তু কি বলে টাকা তুলবে শ্যামার জন্য। কিন্তু শ্যামারও যে সুন্দর একটা মন আছে।
বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ব্যথা করছে। এখন হসপিটালে ভর্তি হয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু সেখানে থাকলে খরচ বেশি হবে বলে বাসাতেই আছে শ্যামা। বৃষ্টির আওয়াজ ভাল লাগছে। তা শুনে ব্যথা ভুলার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে কয়েক ফোঁটা বৃস্টি পড়ে ঘরের চাল ভেদ করে। এই বর্ষায় টিনের চাল ঠিক করার কথা ছিল। বর্ষার আগেই বৃষ্টি শুরু হলো।
শ্যামার ইচ্ছা করছে বাহিরে ভিজতে। মনে হচ্ছে বৃষ্টির পানিতে ভিজলে মনের কালিমাগুলো দূর হয়ে যাবে। একটা জিনিষ অনেক বেশি বিশ্বাস করতে চায় শ্যামা। বৃষ্টির পানি ধুয়ে মুছে দেয় মনের কালিমাগুলো। প্রতিবার কাজ করার পর মনে হয় ইশ এখন যদি বৃষ্টি হতো। বৃষ্টিতে ভিজে সব কদাকার জিনিষগুলো মুছে যেত। কিন্তু বৃষ্টি যে আসে না।
এতগুলো টাকার যোগাড় অসম্ভব। কোথায় পাবে। কিন্তু বাঁচতে হবেই। এখন যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে ছোট বোন চম্পাকেও এই পথে নামতে হবে। চম্পাকে ওরা ..............। না কল্পনা করতে পারে না শ্যামা। যে করে হোক বাঁচতেই হবে। ছোট বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ওর। এই স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে।
দিন চলে যাচ্ছে। কিছু হচ্ছে না। এতগুলো টাকা না হলে অপারেশন হবে না। টাকার অভাবের কারণে মৃত্যুর জন্য যেন সাগ্রহে অপেক্ষা করা। শুধু চম্পার জন্য চিন্তা হয়। কি হবে?
মা দিনরাত কাঁদেন। প্রতিদিন রোজা রাখেন। এখন ঘরে বাজার করা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক বেলা খাওয়া হয় অন্য বেলা অনাহারে। টাকা জমানোর জন্য। কিন্তু এভাবে জমিয়ে দশ লক্ষ টাকা বানানো অসম্ভব। যুগ অপেক্ষা করতে হবে।
.............................. ০৩ .....................
বাস্তবেও মাঝে মাঝে অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ডাক্তারের ঐখান থেকে বের হয়ে হয়ে অপেক্ষা করছে শ্যামা। ভিতরে আকাশ ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
এ সময় একটা ছেলে আছে।
-আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?
শ্যামা অবাক হয়। এই লোককে চিনে না। আগে কখনো দেখেই নি। রাতের বেলায় অনেকে আসে। তবে কেউ দিনের বেলায় পরিচয় দেয় না। এটাই নিয়ম।
আমতা আমতা করে শ্যামা বলে, আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
অবাকের কারণে যতটা না আমতা আমতা করে বলা তার চেয়ে বেশি অসুস্থতার কারণে। অসুখ দিন দিন কঠিন হচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারে শ্যামা। আর বোধ হয় বেশি দিন নাই।
-আপনি ঠিক চিনবেন না। আপনার কাছে অনেকে আসে। হঠাৎ একদিন ইচ্ছা জেগেছিল। যাবো। দুবছর আগে। গেলাম। আপনার হয়ত মনে নেই। আমার মন অনেক খারাপ ছিল তখন। প্রিয় জনকে হারিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ছিলাম। সেই প্রথম যাওয়া। আগে কখনো যাই নি কোন মেয়ের কাছে। এর পর আর যাই নি। ইচ্ছা হতো সবাইকে খুন করি। কিচ্ছু ভাল লাগত না। এক বন্ধুর পরামর্শে গিয়েছিলাম। কিন্তু..............
থামিয়ে দেয় শ্যামা। বলে, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। আর আমিই যে সে আপনি বুঝলেন কিভাবে?
-আপনি একটা জিনিষ জানেন না। আমার রেজাল্ট শুনলেই বুঝতেন। অহংকার হয়ে যাবে তারপরও বলছি, এস এস সি এবং ইন্টারমিডিয়েট দুইটাতেই আমি স্ট্যান্ড করেছি। বুয়েট থেকে রেকর্ড সংখ্যক নাম্বার নিয়ে আমি বের হয়েছি। আমার স্মৃতি শক্তি আমার অনেক ভাল বন্ধু। আপনার কপালে বাম পাশের দাগটা খেয়াল করেই নিশ্চিত হলাম। আপনার কি অসুখ হয়েছে?
শ্যামা আশ্চর্য হয়। এসময় আকাশ বের হয়। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। আকাশ সব সময় ফুরফুরে মেজাজে থাকে। তার চোখে মুখে চিন্তা মানে অনেক বেশি কঠিন কিছু।
-চলো বাসায় চলো।
-আপনার কি অসুখ বললেন না তো।
যখন আকাশ বুঝতে পারে কথাগুলো শ্যামাকেই বলা হচ্ছে তখন হাতের টেস্টের রিপোর্ট গুলো বাড়িয়ে দেয় যুবকটির হাতে।
সেটা দেখেই আকাশকে এক কোণায় ডেকে নিয়ে যায় যুবকটি।
-আচ্ছা অপারেশন কখন হচ্ছে। ডেট ঠিক হয়েছে?
- না।
- দেরি করছেন কেন? পরে তো কঠিন অবস্থা হয়ে যাবে। যত আগে করা হবে তত মঙ্গল।
- তা তো আমরাও জানি। কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবো?
-কত লাগবে বলছে ডাক্তার।
-দশ লাখ টাকা।
- আপনি ব্যবস্থা করেন। টাকা দিকটা আপনাকে দেখতে হবে না। সেটা আমি দেখছি।
থ হয়ে যায় আকাশ। মুখে কথা বের হয় না।
তার আশ্চর্য হওয়া দেখে যুবকটি বলেন, সেদিন ওনার সাথে কথা না হলে হয়ত আমি এতদিন জেলে থাকতাম। মাথা খারাপের মত হয়ে গিয়েছিল। যে কাউকে খুন করে বসতাম। কিন্তু ওনার গল্প শুনে মনে হলো আরে আমি তো ভালই আছি। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখলাম। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। ওই রাতটাই আমার জন্য টার্নি পয়েন্ট। এত বড় উপকার যিনি করেছেন তার প্রতি এতটুকু কৃতজ্ঞতা অন্তত দেখাতে পারি। না কি বলেন নিজেকে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করি।
টেবিলের এক কোণে চম্পার বই গুলো রাখা। এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। শ্যামার হাতে একটা বই। নাম উজ্জল বেদনা। বেদনা কিভাবে উজ্জল হয় তা মাথায় ঢুকে না শ্যামার। তবে গল্পটা পড়তে ভালই লাগছে। গল্পের নায়িকা চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করছিল। নায়িকার নাম কল্পনা। গল্পের নায়কটা একটু লোভী প্রকৃতির। স্বভাবও ভাল না। শুধু নায়িকাকে একান্তে পেতে চায়। নায়িকা কোন ভাবেই বিয়ের আগে একান্তে যেতে চায় না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে একটা যুদ্ধ লেগে আছে। নায়ক একটা পরিকল্পনা করছে। ওর বন্ধু জাফর। জাফরদের বাড়ীর সবাই এক বিয়েতে যাচ্ছে। বাসা খালি থাকবে। জাফরের সাথে কথা বলে পরিকল্পনা করছে অন্য কিছু বলে কল্পনাকে জাফরের বাড়িতে নিয়ে যাবে। সেখানে নিতে পারলেই হলো। এতদিনের শখ পূরণ হবে।
পরিকল্পনা শুধু ঐটুকুই না। আরো বেশ কিছু পরিকল্পনা আছে। এরিমধ্যে একটা ভিডিও ক্যামেরা ঐ রুমে থাকবে। কল্পনা বুঝতে পারবে না। ঐ ক্যামরায় সব কিছু ধারণ হয়ে যাবে। নায়কের নিজেরই ক্যামেরা আছে। সেটা জাফরকে দেখায়।
জাফর ক্যামেরা দেখে বলে, এটার জুম কম। সব কিছু স্পষ্ট আসবে না। আরো ভাল ক্যামেরা দরকার। এ ক্যামরায় ছবি হালকা বুঝা যাবে না। সাউন্ডও তেমন নিতে পারবে না।
নায়কের নাম জাকির। সে একটু চিন্তায় পড়ে যায়। এ বিষয়টাতো আগে চিন্তা করে নাই। ভাল ক্যামেরা দরকার। এতবড় সুযোগ ভাল ক্যামেরার জন্য হাতছাড়া হবে সে কল্পনা করতে পারে না। সব কিছু পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। তাহলে. ভাল ক্যামেরা কই পাবো?
-আমার আছে। চাচা আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছেন। অনেক রেজুশেলন। জুমও অনেক শক্তিশালী।
-তোর থাকলে তো হয়ে গেল এ বিষয়ে আর চিন্তা করতে হচ্ছে না।
-না, চিন্তার আছে, মা-রা বিয়েতে যাওয়ার সময় ক্যামেরাটি নিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। অন্য ক্যামরা যোগাড় করতে হবে।
ওদের পরিকল্পনা এগুচ্ছে। অতটুকু পড়ছিল শ্যামা। শ্যামার ইচ্ছা করছিল ওদের সব পরিকল্পনা কল্পনাকে গিয়ে বলে দেয়। কল্পনা যে কি ভয়ংকর ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে তা জানিয়ে দিতে। এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছা হয়। কল্পনার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলতে, কল্পনা তুমি কখনো যেও না। অনেক বিপদ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। প্লিজ তুমি ভুল বুঝো না।
আচ্ছা কল্পনা একজন অপরিচিত মেয়ে। তাকে তুমি বলা কি উচিত? আপনি বলতে হবে। অপরিচিতকে আপনি বলাই কর্তব্য। একসময় মনে হয় আপনি তুমি তুই না থেকে ইংরেজীর মত একটাই থাকলেই হয়ত ভাল হত। আবার ভাবে, না ঠিক আছে বৈচিত্র আছে। আপনি তুমি যাই বলুক। কিন্তু কল্পনাকে বলার জন্য পাচ্ছে কোথায়। ও যে গল্পের নায়িকা।
ব্যথা বাড়ছে। কষ্ট করে উঠে পানির বোতল থেকে অনেক খানি পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল শ্যামা। একটা আয়না ঝুলছে। সেখানে চোখ পড়তেই দেখল মুখে ব্যথার ছাপ। মুখ কুঁচকে গেছে। শরীরের ব্যথাটা মুখে স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
শ্যামা গল্প উপন্যাস পড়ে এটা ঠিক মানায় না। ওর মত যারা এসব কাজ করে তারা কি গল্প উপন্যাস পড়ে? কেউ শুনলে হাসবে। অনেক বেশি হাসবে। টিটকারী মেরে বলবে ওদের আবার গল্পের বই পড়া। ওরাই তো প্রতিদিন গল্প খেলে। ওদের গল্পের বই পড়ার দরকার কি?
ডাক্তার দেখাতে হবে। আজও কাজে যেতে পারেনি। গত দুই দিন যাওয়া হয়নি। এসব ব্যাপারে ওকে সাহায্য করে আকাশ। আকাশ মহা বিরক্ত। অসুখ বিসুখ তো থাকবে। তাই বলে বাদ দিতে হবে কেন? তোমার তো কিছু করতে হচ্ছে। যা করার ঐ পক্ষই করে।
গতকাল এসেছিল আকাশ। আকাশ ছেলেটাকে অনেক পছন্দ শ্যামার। সরাসরি বলে দেয় সব। প্যচাই কথা বলে না।
-বুক ব্যথাটা প্রতিদিন উঠছে।
-ডাক্তার দেখাও। এখনি যেতে চাও? চলো।
-না এখন না। হয়ত এম্নেই ঠিক হয়ে যাবে। অযথা কতগুলো টাকা খরচ। ডাক্তারের কাছে গেলেই এই টেস্ট ঐ টেস্ট।
তা শুনে হেসে উঠে আকাশ।
-হাসছো কেন?
ইচ্ছা হলো তাই হাসলাম। লতিফা আজ অনেক বড় ট্রিপে গেছে। সাতদিনের ট্রিপ। দশ হাজার টাকার। এক শিল্পপতি কক্সবাজার যাচ্ছেন। তার সাথে থাকবে।
দূরের ট্রিপে অনেক টাকা বেশি দেওয়া হয়। কিন্তু শ্যামা যায় না। মা, বোনকে ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকতে ভাল লাগে না শ্যামার।
-আরে কথা কাটাচ্ছো কেন? হাসলে কেন সেটা বলো।
-হাসলাম যখন বলেই দিই। সামনের বার আমি একজন ডাক্তার খুঁজব। ঐ ব্যটা ওর কাজ করবে। আর এই ফাঁকে তুমি তোমার সমস্যার কথা বলে প্রেসক্রিপ্ট নেবা। তোমার জন্য ঐ ব্যাটাকে টাকা দিতে হবে। কিন্তু তোমাকে দিতে হবে না টাকা চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। ফ্রি চিকিৎসা।
বলে হু হু করে হেসে উঠে আকাশ।
আরো কিছুক্ষণ ছিল। চলে যায়।
......................০২...............
ব্যথা বাড়ে। মাঝে মাঝে ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। কাজে যেতে পারে না। আর এ পেশাতে কাজে না গেলে কোন টাকা আসে না। যতক্ষন কাজ ততক্ষণের টাকা আসবে শুধু। তাই বাধ্য হয়ে ডাক্তার দেখাতে যায়। আকাশ সঙ্গে যায়।
ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট করতে দেন। করা হয় সব। পেটে টিউমার হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে। না হলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। টিউমার বড় হয়ে গেলে পরে আর কিছুই করার থাকবে না।
অপারেশনের জন্য ১০ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এত টাকা দেবে কে? নিজের কাছে সব মিলে এক লক্ষ টাকার মত হবে। এই টাইপের মেয়েকে কেউ সাহায্য করবে না। এদের সাহায্য করলে পাপ মনে হবে। কে আসবে সাহায্য করতে গিয়ে পাপ নিতে। ছাত্রী হলে মেধাবী ছাত্রীর অপারেশনের জন্য টাকা প্রয়োজন বলে টাকা তোলা যেত। কিন্তু কি বলে টাকা তুলবে শ্যামার জন্য। কিন্তু শ্যামারও যে সুন্দর একটা মন আছে।
বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। ব্যথা করছে। এখন হসপিটালে ভর্তি হয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু সেখানে থাকলে খরচ বেশি হবে বলে বাসাতেই আছে শ্যামা। বৃষ্টির আওয়াজ ভাল লাগছে। তা শুনে ব্যথা ভুলার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে কয়েক ফোঁটা বৃস্টি পড়ে ঘরের চাল ভেদ করে। এই বর্ষায় টিনের চাল ঠিক করার কথা ছিল। বর্ষার আগেই বৃষ্টি শুরু হলো।
শ্যামার ইচ্ছা করছে বাহিরে ভিজতে। মনে হচ্ছে বৃষ্টির পানিতে ভিজলে মনের কালিমাগুলো দূর হয়ে যাবে। একটা জিনিষ অনেক বেশি বিশ্বাস করতে চায় শ্যামা। বৃষ্টির পানি ধুয়ে মুছে দেয় মনের কালিমাগুলো। প্রতিবার কাজ করার পর মনে হয় ইশ এখন যদি বৃষ্টি হতো। বৃষ্টিতে ভিজে সব কদাকার জিনিষগুলো মুছে যেত। কিন্তু বৃষ্টি যে আসে না।
এতগুলো টাকার যোগাড় অসম্ভব। কোথায় পাবে। কিন্তু বাঁচতে হবেই। এখন যদি কিছু একটা হয়ে যায় তবে ছোট বোন চম্পাকেও এই পথে নামতে হবে। চম্পাকে ওরা ..............। না কল্পনা করতে পারে না শ্যামা। যে করে হোক বাঁচতেই হবে। ছোট বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ওর। এই স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে।
দিন চলে যাচ্ছে। কিছু হচ্ছে না। এতগুলো টাকা না হলে অপারেশন হবে না। টাকার অভাবের কারণে মৃত্যুর জন্য যেন সাগ্রহে অপেক্ষা করা। শুধু চম্পার জন্য চিন্তা হয়। কি হবে?
মা দিনরাত কাঁদেন। প্রতিদিন রোজা রাখেন। এখন ঘরে বাজার করা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক বেলা খাওয়া হয় অন্য বেলা অনাহারে। টাকা জমানোর জন্য। কিন্তু এভাবে জমিয়ে দশ লক্ষ টাকা বানানো অসম্ভব। যুগ অপেক্ষা করতে হবে।
.............................. ০৩ .....................
বাস্তবেও মাঝে মাঝে অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ডাক্তারের ঐখান থেকে বের হয়ে হয়ে অপেক্ষা করছে শ্যামা। ভিতরে আকাশ ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
এ সময় একটা ছেলে আছে।
-আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?
শ্যামা অবাক হয়। এই লোককে চিনে না। আগে কখনো দেখেই নি। রাতের বেলায় অনেকে আসে। তবে কেউ দিনের বেলায় পরিচয় দেয় না। এটাই নিয়ম।
আমতা আমতা করে শ্যামা বলে, আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।
অবাকের কারণে যতটা না আমতা আমতা করে বলা তার চেয়ে বেশি অসুস্থতার কারণে। অসুখ দিন দিন কঠিন হচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারে শ্যামা। আর বোধ হয় বেশি দিন নাই।
-আপনি ঠিক চিনবেন না। আপনার কাছে অনেকে আসে। হঠাৎ একদিন ইচ্ছা জেগেছিল। যাবো। দুবছর আগে। গেলাম। আপনার হয়ত মনে নেই। আমার মন অনেক খারাপ ছিল তখন। প্রিয় জনকে হারিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় ছিলাম। সেই প্রথম যাওয়া। আগে কখনো যাই নি কোন মেয়ের কাছে। এর পর আর যাই নি। ইচ্ছা হতো সবাইকে খুন করি। কিচ্ছু ভাল লাগত না। এক বন্ধুর পরামর্শে গিয়েছিলাম। কিন্তু..............
থামিয়ে দেয় শ্যামা। বলে, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। আর আমিই যে সে আপনি বুঝলেন কিভাবে?
-আপনি একটা জিনিষ জানেন না। আমার রেজাল্ট শুনলেই বুঝতেন। অহংকার হয়ে যাবে তারপরও বলছি, এস এস সি এবং ইন্টারমিডিয়েট দুইটাতেই আমি স্ট্যান্ড করেছি। বুয়েট থেকে রেকর্ড সংখ্যক নাম্বার নিয়ে আমি বের হয়েছি। আমার স্মৃতি শক্তি আমার অনেক ভাল বন্ধু। আপনার কপালে বাম পাশের দাগটা খেয়াল করেই নিশ্চিত হলাম। আপনার কি অসুখ হয়েছে?
শ্যামা আশ্চর্য হয়। এসময় আকাশ বের হয়। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। আকাশ সব সময় ফুরফুরে মেজাজে থাকে। তার চোখে মুখে চিন্তা মানে অনেক বেশি কঠিন কিছু।
-চলো বাসায় চলো।
-আপনার কি অসুখ বললেন না তো।
যখন আকাশ বুঝতে পারে কথাগুলো শ্যামাকেই বলা হচ্ছে তখন হাতের টেস্টের রিপোর্ট গুলো বাড়িয়ে দেয় যুবকটির হাতে।
সেটা দেখেই আকাশকে এক কোণায় ডেকে নিয়ে যায় যুবকটি।
-আচ্ছা অপারেশন কখন হচ্ছে। ডেট ঠিক হয়েছে?
- না।
- দেরি করছেন কেন? পরে তো কঠিন অবস্থা হয়ে যাবে। যত আগে করা হবে তত মঙ্গল।
- তা তো আমরাও জানি। কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবো?
-কত লাগবে বলছে ডাক্তার।
-দশ লাখ টাকা।
- আপনি ব্যবস্থা করেন। টাকা দিকটা আপনাকে দেখতে হবে না। সেটা আমি দেখছি।
থ হয়ে যায় আকাশ। মুখে কথা বের হয় না।
তার আশ্চর্য হওয়া দেখে যুবকটি বলেন, সেদিন ওনার সাথে কথা না হলে হয়ত আমি এতদিন জেলে থাকতাম। মাথা খারাপের মত হয়ে গিয়েছিল। যে কাউকে খুন করে বসতাম। কিন্তু ওনার গল্প শুনে মনে হলো আরে আমি তো ভালই আছি। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখলাম। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছি। ওই রাতটাই আমার জন্য টার্নি পয়েন্ট। এত বড় উপকার যিনি করেছেন তার প্রতি এতটুকু কৃতজ্ঞতা অন্তত দেখাতে পারি। না কি বলেন নিজেকে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করি।