সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মুক্ত হওয়া গেল!! ( গল্প )

ঘুটঘুটে অন্ধকার। এত বেশি অন্ধকার যে নিজের হাতটুকুও দেখা যায় না। উঁচু দেওয়াল ঘেরা ছোট্ট একটা রুম। ফ্যান আছে। ফ্লোর থেকে ছাদ অনেক উপরে। যে কারণে ফ্যান ঘুরলেও বাতাস পাওয়া যায় না। একটা ছোট ভেন্টিলেটন আছে। সেখানে সব মাকড়সার জাল। মাকড়শার জালও যে এত ঘন হতে পারে তা না এই ভেন্টিলেটর না দেখলে বুঝা যাবে না। .......


আকবরকে এই রুমে দুই ঘন্টা আগে আনা হয়েছে। চেয়ারের উপর বসা। পিঠ চুলকাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু হাত দিয়ে যে চুলকিয়ে নেবে সে উপায় নেই। চেয়ারের সাথে রশি দিয়ে শক্ত ভাবে বাঁধা আছে তার শরীর। একটু যে নড়বে সেটাও সম্ভব না। নড়তে গেলে চেপে থাকা রশি গুলো চামড়ার সাথে আরো বেশি মিলে যায়। ব্যথা হয়। তাই নড়া চড়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করা বোকামী।

যে দুর্ভেদ্য এলাকায় আছে এখান থেকে পালাতে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীও পারবে না। কোন জায়গায় আনা হয়েছে তা বুঝতে পারে নি আকবর। চোখ বাঁধা ছিল শক্ত কাপড়ে। আনার সময় দুই পাশে দুইজন নিরাপত্তা বাহিনর সদস্য শক্ত করে ধরে রেখেছিল। তাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ছেড়ে দিলেই পালাবে। অথচ শক্তি বলতে কিছু এখন আর শরীরে নেই। আটক হয়েছে আজ দশদিন। এই দশদিনে দুইবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আজ তৃতীয়বারের মত নিচ্ছে।

রুমে ঢোকানোর পর চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। তবে লাভ হয় নি। সেই একই অন্ধকার। অনেক দিন সুন্দর আলোকিত পৃথিবীটা দেখা হয় না। অন্ধকারেই আছে। আলোকিত পৃথিবীটা দেখতে বড় বেশি ইচ্ছা করে।

এক জনের গলা শুনা যায়। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন লবন মিশিয়ে পানি আনতে।

রুমের দরজা খুলে ঢুকলেন একজন। হাতে টর্চ লাইট নিয়ে তার পিছনে দুইজন এসেছে। টর্চ লাইটের আলোতে কিছুটা আলোকিত হয়। যে অফিসার ঢুকছেন তার নাম লতিফ। তাকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এর প্রতি আলাদা ভাবে কেয়ার নিতে।

কেয়ার বলতে বুঝানো হয় অন্যকিছু। লতিফ সেভাবেই কেয়ার নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের নির্দেশ বলে কথা।

একটা শ্রমিক সংঘঠনের নেতা আকবর। ঐ সংঘঠনটির প্রধান কর্মকর্তার সাথে একদিন দেখা করতে যান। সমস্যা হচ্ছে ২২ জন শ্রমিককে দায়িত্বে অবহেলার জন্য চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য যান আকবর।

স্যার তাদেরকে আরেকবার যদি সুযোগ দিতেন।
আকবরকে দেখে বিরক্ত হন অফিসার। স্পষ্ট করে বলে দেন, কোন সুযোগ দেওয়া যাবে না। যাদের চাকরি যাচ্ছে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোন পরিকল্পনা নাই। ওদের কারণে অনেক বদনাম হয়েছে।
স্যার এভাবে হঠাৎ করে কারো চাকরি থেকে বাদ দেওয়া অমানবিক। আপনি নতুন এসেছেন। ওদের ওয়ার্নিং নোটিশ দেন। এছাড়া চাকরি চলে গেলে পরিবার নিয়ে ওরা যাবে কোথায়?

মোবাইলে কথা বলতে বলতে অফিসার উত্তর দেন, আপনি ওদের পক্ষে দালালি করবেন না। ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।

দালালি বলায় কথাটা গায়ে লাগে আকবরের।
কি বললেন? আমি দালালি করছি? ঠিক আছে আমি চ্যালেন্স দিয়ে যাচ্ছি আপনি কোন শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না। আপনার ক্ষমতা আমি দেখে নেব।
এই বলে বের হয়ে যায় আকবর।

দুইদিন পর চাকুরীচ্যুত করা হয় এ শ্রমিকদের। সাথে সাথে আকবর ঘোষণা দেয় কর্মবিরতির। সবাই কর্মবিরতি শুরু করে দেয়।

এবার ঐ কর্মকর্তা অনেক অনুরোধ করেন। কিন্তু আকবরের এক কথা। ঐ শ্রমিকদের চাকরি ফেরত দিতে হবে। অন্যথায় অবরোধ চলবে।

পরে সরকারি চাপে অনিচ্ছাস্বত্বেও দাবি মেনে নেওয়া হয়।

সময় পার হয়। ৫ বছর পর বিশেষ সুযোগে ঐ কর্মকর্তা আজ অনেক বড় পদে আছেন। অনেক ক্ষমতা।

সেদিনের কথা ভুলেন নাই তিনি। আকবরকে আটক করা হয়। আটক করার সময় বাসা তছনছ করে আসা হয়।

লতিফ তার চোখের চশমা হাতে নেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে তা মুছেন। চশমাটা আবার চোখে পড়তে পড়তে বলেন, ভাল আছেন?

এভাবে বেঁধে রাখার পর কাউকে ভাল আছেন জিজ্ঞেস করা অনেক নির্মম রসিকতা। যারা আসেন তারা এরকম রসিকতা বোধ হয় অনেক পছন্দ করেন। মাঝে মাঝেই রসিকতা করে বসেন। অশ্লীন কথাও বলেন।

হা ভালো আছি। বাঁধনটা যদি আরো শক্ত করে বাঁধা থাকত তবে আরো বেশি ভাল থাকতাম।

তা শুনে লতিফ একজনকে ডেকে নির্দেশ দেন, বাঁধনটি খুলে দিতে। বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। নিজেকে অনেক স্বাধীন মনে হয়। যদিও জানেন স্বাধীনতার কিছুই আসে নি। তাকে কঠিন মামলায় জড়ানো হচ্ছে।

লতিফ কিছু জিজ্ঞেস করে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর দুইজন আসে। তারা বোধ হয় হাতের মাশল শক্ত করতে আসে। আকবরের পিঠের উপর দিয়েই তাদের কসরত চলে।

পানি চাইলে দেওয়া হয় লবণ যুক্ত পানি। সেগুলো খেয়ে গলা জ্বলে।

মানুষের সহ্য ক্ষমতা একটা আছে। সেটা পার হলে আর হুশ থাকে না। আকবরও হুশ হারিয়ে ফেলেন।

শ্রমিক সংঘঠনের সভাপতি হওয়ার জন্য অনেক কিছু করতে হয়েছে। কিন্তু যে অপরাধগুলোতে তাকে জড়ানো হচ্ছে সে ধরণের কঠিন অপরাধ করেনি কখনো। টাকা কামানোর জন্য অনেক পথে গেছেন। তবে সেটা অন্যকে কাজ পাইয়ে দিয়ে। অস্ত্র কখনোই ধরেন নাই।। অথচ তার বিরুদ্ধে দুইটা অস্ত্র মামলাও আছে।

নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সব অপরাধেই নিজেকে স্বীকার করে নেয় আকবর। বাঁচতে বড় ইচ্ছা হয়। পৃথিবীটা এত মায়ার কেন? মায়া ছুটাতে পারলেই ভাল হতো। পৃথিবীর মায়ার জন্য মিথ্যা অপরাধেও নিজেকে জড়িয়ে নেন। স্বীকার করলেই যে লাভ হবে তা কিন্তু না। রিমান্ডের নির্যাতন কিছুটা কমবে এতটুকুই। নতুন শাস্তি আসছে।

আকবর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় এবার বের হলে আর কোন রাজনীতি করবে না। গ্রামে চলে যাবে। নিজের মত নিজে থাকবে। বের হয়েই সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেবে।

সময় বদলে গেছে।
একইরকম অপরাধে অনেকের জামিন হয়েছে। আকবরেরটাই হচ্ছে না। বিশেষ কারণে ইচ্ছা করেই দেওয়া হচ্ছে না। বার বার তারিখ পরিবর্তন করা হচ্ছে।

...................................................০২................................

আজ নির্দিষ্ট দিন। এর আগে বেশ কয়েকবার তারিখ পিছিয়েছে। জামিন হয়নি। আকবরেরও বের হতে পারে নি, আটক কৃত অনেকেই বের হয়ে গেছে। তবে আদালতে আসতে পারলে ভালই লাগে। কিছুটা মুক্ত পৃথিবী। আকবরের চেহারা দেখলে বুঝার উপায় নেই এটা সেই আকবর। শরীর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। চলা ফেরা করতে হয় হুইল চেয়ারে। আজ আসতে পারলে হয়ত আজ ও ভাল লাগত।

আজ জামিন দেওয়া হতে পারে। তবে তা জীবিত আকবরের না। মৃত আকবরের। এক সপ্তাহ আগে বন্দী থাকা অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করে আকবর। ফিরে যাওয়া হলো না আর গ্রামে।

আকবরের লাশ আনা হয়েছে। সবাই কাঁদছে। বিধ্বস্ত মুখে আক্রোশ। তা কার প্রতি সেটা বুঝা যাচ্ছে না।

বড় মেয়ে লতা কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তার জ্ঞান ফিরলেই আবার কাঁদছে। অনেক আদর করত বাবা। বাবার সাথে ঘুরতে বের হতো ছুটির দিনে বিকাল গুলোতে।

শেষ পর্যন্ত পৃথিবী দেখা পেলেন আকবর। মুক্ত হওয়া গেল । মৃত্যু অনেক শক্তিশালী প্রমাণ হলো আবার।
কারাগার, আদালত, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, দুর্নীতি থেকে মৃত্যু অনেক বেশি ক্ষমতাবান।