সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাস্তবতা ( ক্ষুদ্র গল্প )

একটা দুইটা ফোঁটা পড়ছে। একে ঠিক বৃষ্টি বলা চলে না। তবে আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে জোরে বৃষ্টি শুরু হবে। অনেক আগেই সূর্যটা উধাও হয়েছে। মেঘের সাদা চাদরে সেটা গোপন হয়েছে ঠিক যেমন দিনের আলোতে অদৃশ্য হয়ে যায় রাতের তারাগুলো। .........


সুমন বসে আছে বারান্দায়। বিশাল বারান্দা। এটাকে বারান্দা না বলে রুম বলা যায়। সুমনের নানা করেছিলেন। তিন তলার বিল্ডিং। সুদৃশ্য বাড়ি। অথচ ঢোকার মুখে টিনের চালের বারান্দা। বারান্দার তিন পাশে বেড়া। সামনের পাশ পুরাটাই খোলা। বৃষ্টির ফোটা এসে বারান্দার ভিতরে পড়ে। বৃষ্টি এলে নানা এই বারান্দায় চলে আসতেন। এখানেই ঘুমাতেন। বিল্ডিংয়ে বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ বুঝা যায় না। তাই বৃষ্টির শব্দ শুনতেই এখানে চলে আসা।

সে নানা আজ আর নেই। আজ মৃত্যু বার্ষিকী। দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। সব আত্মীয় এসেছে। নানা সবাইকে একসাথে চাইতেন। তার ইচ্ছা ছিল মেয়ে , মেয়ের জামাই, নাতি নাতনী নিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনে শুনে গল্প করবেন। কিন্তু এক এক জন এক এক জায়গায়। সবাই ব্যস্ত। তাই নানার ইচ্ছা ও পূরণ হতো না।

সবাই প্রাণবন্ত। একসাথে দেখা হওয়ায় অনেক আনন্দিত। বাবুর্চিরা বিশাল ডেকে রান্না করছে। বাহিরে রান্নার আয়াজন করা হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা থাকায় সেটা পাক ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। পাকঘরটাও বিশাল। নানার সব কিছু বিশাল করেই করতেন। ছোট কিছু ভাল লাগত না তার।

বাজারে গেলে প্রথমেই খুঁজতেন সবচেয়ে বড় মাছটি। মাছের দোকানদাররা এই ব্যাপারটি জানত। নানার জন্য সবচেয়ে বড় মাছটি আলাদা করে রাখা হতো। সেটি বাসায় আনার পর আয়োজন করে সে মাছ কাটা হতো। যদিও খাওয়ার কেউ নাই। শুধু নানা- নানু আর কাজের মানুষরা। পরে তা বিলানো হতো। নানা আফছোস করতেন। ইশ নাতিরা যদি বড় মাছটা দেখত কি খুশীই না হতো।

নানু কাঁদছেন। লোকটা সারাজীবন চাইত সবাইকে একসাথে দেখতে। এখন সবাই এসেছে অথচ লোকটাই নাই। চোখের পানিতে নানুর শাড়ি ভিজে গেছে। সাদা শাড়ি পড়ে আছেন । তাই সহজে বুঝা যাচ্ছে সে পানি। মেয়েরা স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

সুমন একটু আগে পাকঘর ঘুরে এলো। পাকঘরে অনেক গরম। তিনটা চুলায় রান্না হচ্ছে। তাই সেখানে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হয় নাই।

ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় সুমনদের । কিন্তু সেটা দাদাবাড়ি। কোন ঈদ নানাবাড়ীতে করা হয় নাই। কোন মামা নেই সুমনের। মামা থাকলে নিশ্চয় ঈদ করতে গ্রামে যেতেন। ছেলে না থাকায় মিলেমিশে ঈদ করার স্বপ্ন পূরণ হলো না কখনো নানার।

মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভাবতে ভাল লাগে না সুমনের। তারপরও কেন জানি চিন্তা করে। মাথায় চলে আসে। নানা বেঁচে থাকতে সবাই আসে নাই। অথচ এখন সবাই এসেছে। মৃত্যু মানুষকে একসাথে করে দিয়েছে। কিন্তু যার ইচ্ছা এসব দেখা তার ইচ্ছা তো পূরণ হয় নাই। আচ্ছা নানা কি দেখছেন এসব? হয়ত দেখছেন, হয়ত না। কি নির্মম? ভাল লাগে না। আচ্ছা সবাই যদি একই সাথে বেঁচে থাকত তাহলে কি অনেক ভাল হতো না? তবে বেঁচে থাকলে এভাবে মিলিত হওয়া হয় না। নানা যেমন পারেন নি দেখে যেতে।

মা- বাবাকে সুমনের মাঝে মাঝে বেশি স্বার্থপর মনে হয়। নানা মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ফোনে কথা বলছেন । সুমনের সাথে।

- চলে আয় নাতি। গাছে আম ধরেছে। সব পেকে গেছে। গাছে উঠে আম পারতে হবে না। চলে আয়।
-নানা তুমি তো অসুস্থ। বের হবা কেমনে?
-আরে তোরা আসলে সুস্থ হয়ে যাবো। তোরা কাছে নেইতো এজন্য অসুস্থ আছি।
-আমার তো আসতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সামনে যে টিউটেরিয়াল পরীক্ষা।
-তোদের তো শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা, আমাদের সময় এত পরীক্ষা ছিল না। এত পরীক্ষা যে কোত্থেকে আসে কে জানে?
তোর মা-কে দেয়।

নানা কি বলে তা বুঝা যায় না। তবে মায়ের কথা গুলো শোনা যায়। বাবা তুমি বোঝার চেষ্টা করো। সুমনের পরীক্ষা। গত পরীক্ষায় নাম্বার কম এসেছে, এজন্য সেকেন্ড হয়ে গেছে। এবারও যদি খারাপ করে অনেক পিছে চলে যাবে। সুমনের পরীক্ষা না থাকলে আসা যেত।

টিউটোরিয়াল পরীক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ না। চাইলেই যাওয়া যেত। কিন্তু ইচ্ছা করেই গেলেন না।

সুমনের পরীক্ষা শেষ হয়। কিন্তু তার আগেই নানা মারা যান। সকালে। মরার সময় নানু ছাড়া কেউ ছিলেন না। অথচ মরার পর সবাই এসে হাজির হয়।

সব দিকে কান্নার রোল। যখন জীবিত ছিলেন সবাইকে ডাকছেন। ব্যস্ততার কারণে কেউ আসল না।

প্রতিবছর এভাবে সবাই আসবে। উৎসব মুখর ভাব হবে।

সবাই মিলিত হওয়ার জন্য কি মৃত্যুর বড় বেশি প্রয়োজন সুমনের জানতে ইচ্ছা করে।

সামনে ওর কাজিনরা মিলে ক্রিকেট খেলছে। বৃষ্টির ফোঁটা গভীর হচ্ছে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। ক্রিকেট অনেক প্রিয় সুমনের। নানাও ব্যাট ধরে দাঁড়াতেন। যদিও ব্যাটে বল লাগাতে পারতেন না। ছোট কালে নানার সাথে ক্রিকেট খেলার স্মৃতি মনে পড়ে যায়।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খেলার অন্যরকম মজা। সুমনকে বেশ কয়েকবার ডাকা হয়েছে খেলার জন্য। কিন্তু ও যায় নি।

কেন জানি আনন্দ করতে ইচ্ছা করছে না। এই যে মৃত্যু বার্ষিকী পালন এটাকে লোকদেখানো অনুষ্ঠান মনে হচ্ছে। বিরক্ত লাগছে।

অন্যরা যখন ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত তখন সুমন মনে মনে বলছে, নানা তোমাকে আমি অনেক বেশি মিস করছি। অনেক বেশি। আল্লাহ তোমাকে অনেক ভাল রাখুন।

কলেমা পড়তে থাকে সুমন। নানার জন্য কলেমা পড়েই যায়।