রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সাতাশ তারিখ (গল্প)

রাতে ঘুম না আসার কারণ ভাবছিলাম। ইদানিং এ সমস্যাটা হচ্ছে। রাতের অনেকটা কেটে যায়। অথচ ঘুমের দেখা পাই না। কিছু নিয়ে যে দুশ্চিন্তায় আছি তা নয়। তবে এখন ঘুম না হওয়ার কারণ নিয়ে টেনশন করছি। একারণেই হয়ত ঘুম আসছে না। টেনশনমুক্ত হওয়ার জন্য মোবাইলে অল্প ভলিউমে গান প্লে করি। প্রীতমের গান।


প্রথমেই যন্ত্রের করুণ সুর। এরপর শোনা যায় প্রীতমের গলা, আমাদের সংসারে ছিল স্বপ্ন রাশি রাশি,
আজ স্বপ্ন গেছে উড়ে শুধু তুমি আমি আছি
ফুলে ফুলে ভরা ছিল যে ঘর দুয়ার
আজ সেখানে শুধু অবিশ্বাসের হাহাকার।

এমন সব গান শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরও শুনতে ভাল লাগে। হঠাত দেখি গান বন্ধ হয়ে গেছে। ইনকামিং কলের রিংটোন বাজছে। বিরক্ত হয়ে মোবাইলের ডিসপ্লেতে তাকাই। সেখানে ইশতিয়াকের নাম ভেসে উঠে। কল যে করেছে তার নাম ইশিতা। কিন্তু মেয়ের নাম দেখলে বন্ধুরা দুষ্টামি করে। তাই নাম চেঞ্জ করে ইশতিয়াক নামে সেভ করা আছে। মেয়েটা সবে মাত্র ইন্টারে পড়ছে। এর মধ্যে দেখি ভবিষ্যত সংসার জীবনের ছক একে রেখেছে। বোঝার চেষ্টা করছে না ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে।

সবুজ বাটন চেপে ধরে কল রিসিভ করি। ও পাশ থেকে কথা আসে। : ঘুমিয়ে পড়ছিলেন? সরি বিরক্ত করার জন্য।
:নাহ নাহ ঘুমাইনি। তোমার খবর কি?
: অনেক বেশি ভাল। আপনি?
এমন ভাবে ভাল আছে ব্যাপারটা বলল যে আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম। প্রশ্নটা না করাই হয়ত ঠিক ছিল। ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলা। এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না।

চুপ আছি দেখে বলল, কেমন আছেন তা আমাকে বলা যাবে না? ঠিক আছে বলা না গেলে বলতে হবে না।
আমি বললাম, আমিও ভাল আছি।

: আচ্ছা একটা অনুমতি চাইবো। মানা করবেন নাতো?
: কি অনুমতি? আগে বলো। মানা করার মত না হলে অবশ্যই মানা করবো না।
: আপনাকে আগে কখনো তুমি করে বলি নাই। আজ বলবো। প্লিজ মানা করবেন না।

বলার মধ্যে আকুতি। আমি বুঝি না ফোনে কথা বলে একজনের জন্য এভাবে ঘোর কিভাবে তৈরি হয়। এটাও কি সম্ভব! নাকি ঘোরেরটা পুরা অভিনয়। অভিনয় ভাবতে খারাপ লাগে। এ মেয়ের সাথে কথা বলে কখনো মনে হয়নি কিছু অভিনয় করেছে। এত আবেগ দিয়ে যে কথা বলে। অনেক বেশি আপন মনে হয়। কিন্তু এ অল্প বয়সের আবেগ একটা সময় পর চলে যাবে।
অনিচ্ছাস্বত্বেও বললাম, আচ্ছা বলো।
: থ্যাংকস। আজকের কয় তারিখ বলো তো?

তারিখের ব্যাপারটা আমি কখনো সঠিক ভাবে বলতে পারি না। কেউ তারিখ জিজ্ঞেস করলে মোবাইলের স্ক্রিনে কিংবা কম্পিউটারের ডান পাশের নিচের আইকনে ডেট দেখে নিই। মনে করার চেষ্টা করি আজকে কয় তারিখ।
ইশিতা কথা বলে উঠে, তোমাকে নিয়ে আর হলো না। সামান্য তারিখের ব্যাপারটাও মনে রাখতে পারো না।
আমি এ প্রান্ত থেকে মাথা নাড়ি। মাথা নাড়ার ব্যাপারটা ও প্রান্তে বোঝা যাওয়ার কথা না। তারপরও কিভাবে যেন বুঝে গেল।
বলল, তোমার মাথা নাড়া বন্ধ করো। এই যে আমি আপনাকে তুমি করে বলছি খুব বিরক্ত হচ্ছেন তাই না? আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকের পর থেকে আর কখনো তোমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করবো না। আজকের ২৭ তারিখ আমার জীবনের অনেক দু:খের একটা দিন। তোমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক বলেছি। আসলে কাউকে জোর করে কিছু করা ঠিক না। কষ্টগুলো শুধু আমারই থাক। আর কক্ষনো বিরক্ত করবো না তোমাকে।

ওর গলাটা কেমন যেন শোনাচ্ছিল। কাঁদছে নাকি! আমার জন্য একটা মেয়ের চোখের পানি ফেলবে এটা কখনো ভাবনাতেই ছিল না আমি এতটাই সাধারণ।

আমি কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বললাম, আসলে বাস্তবতা অনেক কঠিন। পরে বড় কষ্ট পাওয়ার চেয়ে আগে ছোট কষ্ট পাওয়াই ভাল। তাই না?

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর উত্তেজিত গলায় বলে, আপনি কষ্টের কি বুঝেন? কষ্ট নিয়ে আপনি কক্ষনো কথা বলবেন না। কক্ষনো না। যে কষ্ট সারা জীবন ধরে বয়ে নিতে হবে সে কষ্ট বড় না ছোট তা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। আসলে আপনার সাথে পরিচয় নাহলেই অনেক ভাল ছিল। অনেক ভাল।

: হা সেটাই ভালো হতো। তবে তুমি একটা ঘোরের মধ্যে আছো। দেখো অনার্স লাইফে যখন যাবে, তখন আজকের এ ব্যাপার মনে পড়লে হাসবে। বলবে, আরে কি ছেলেমানুষি করছিলাম। দেখো আমার কথা সত্যি হবে।

: কক্ষনো আপনার কথা সত্যি হবে না। আমি ঘোরের মধ্যে কিছু করি নাই। বাস্তবতা আমি বুঝি। আপনার আমাকে ভালো লাগে না তাই এসব কথা বলছেন। আমি আসলে অনেক খারাপ। অনেক খারাপ। আপনাকে অনেক বিরক্ত করছি। দু:খিত বলবো না। আপনাকে বিরক্ত করার সময়গুলোই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর সময়। এজন্যই দু:খিত বলবো না।

: শোনো তুমি বেশ ভাল মেয়ে। তোমার সাথে কথা বলে তাই মনে হয়েছে। তবে বাস্তবতা বেশ নিষ্ঠুর। অনেক কিছু মিলতে দেয় না। তাই সরে থাকাই ভাল।

: হুম আপনি অনেক বাস্তববাদী। আপনার কথা হচ্ছে মাথা ব্যথা করলে মাথা কেটে ফেলা।

আমি বলি, নাহ সেটা নাহ। মাথা একটাই, এর বিকল্প নেই। তা কেটে ফেলা কোন বুদ্ধিমানের কাজ না। তবে আমি তো একজন না। এক ফয়সাল গেলে আরো কত ফয়সাল আসবে। দেখবা অনেক সুন্দর মনের মত কেউ তোমার জীবনে আসছে। অনেক সুখী হবো।

: খবরদার আপনি এসব আশির্বাদ করবেন না। উত্তেজিত গলাটা অনেক বেশি ঝাঝালো শোনায়।
আমি চুপ করে থাকি। আপনার কাছে এসব আশির্বাদ শুনতে আমি চাই না। আর আমার কারো আশীর্বাদের দরকার নেই। আমি এখন থেকে ভাল করে পড়াশোনা করবো। আর ফাকি দিবো না। আগে পড়তাম মা-বাবার কথা রাখতে গিয়ে। কিন্তু এখন আমি নিজের জন্যই পড়বো।

আমি বলি, খুব ভাল সিদ্ধান্ত। মন দিয়ে পড়ালেখা করো। ভাল হবে।
: কেন নিজের জন্য পড়বো তা তো জিজ্ঞাসা করেন নাই। আপনি আসলে আমার কোন ব্যাপারেই কখনো আগ্রহ দেখান নি।
: নাহ নাহ। ঠিক আছে। বলো।
: আমার চাকরি করার কোন স্বপ্ন ছিল না। একটা সুন্দর সংসার হবে। ভালো একজন মা হবো। চাকরি করবো না। এক একদিন এক এক রকম রান্না করে পরিবারের সবাই খাবো। অথচ যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম সে যখন আর আসবেই না তাই এখন এ ধরণের স্বপ্ন দেখা বাদ দেবো। আমার তো আর সংসার হবে না। ব্যস্ত থাকতে হবে। ভাল ভাবে পড়ে একটা বড় চাকুরি করে নিজেকে অনেক বেশি ব্যস্ত রাখবো। অনেক বেশি।

আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাই না।
ইষিতাই আবার কথা বলে উঠে : আমি দোয়া করি আপনার ছেলে মেয়ে যেন আপনার মত না হয়।
একটু আশ্চর্য হই। জিজ্ঞেস করি, এ কি অভিশাপ দিচ্ছো?
: নাহ নাহ অভিশাপ নাতো। আদর্শের দিক দিয়ে আপনার মতই হোক। তবে আবেগের দিক দিয়ে যেন তা না হয়। হলে যে অন্যদের কষ্ট দেবে। কষ্ট গুলো কি ভয়ংকর তা যে পায় সে ছাড়া কেউ বুঝে না।

কিছুক্ষণ থেমে বলে, আচ্ছা আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। এ ২৭ তারিখ হয়ত অন্যান্য দিনের মতই আপনার কাছে একটা সাধারণ দিন। কিন্তু এ দিনটা সত্যিই অনেক কষ্টের একটা দিন। তুমি অনেক বেশি ভাল থেকো। অনেক অনেক বেশি।

আর কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে মোবাইল কেটে দেয় ও। এরপর আর কখনো ওই মোবাইলটা অন পাওয়া যায়নি।

মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছা করে মেয়েটা এখন কেমন আছে? আগের কথাগুলো ভেবে কি তার ছেলেমানুষি মনে হয়? কিন্তু জানার কোন উপায় নেই। যে দুইটা নম্বর থেকে সে কথা বলতো সেগুলো বন্ধ। দুই বছর ধরে একদিন কথা না বললে যে থাকতে পারতো না সে আর কল দেয়নি। মেয়েটার কথা মনে পড়লে কেমন জানি খারাপ লাগে। জানতে ইচ্ছা করে সে কেমন আছে?

আচ্ছা এ খারাপ লাগাটাই কি ভালোবাসা??

কাঁচা হাতের গল্পে : সাতাশ তারিখ