শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০

বিভ্রান্তি ( গল্প )

আকাশে ঘুড়ি উড়ে। পাখি উড়ে। মাঝে মাঝে কিছু মানব পাখি যা উড়োজাহাজ কিংবা হেলিকপ্টার নামে পরিচিত সেগুলো উড়ে। কিন্তু মনের আকাশে এত কিছু উড়ার সুযোগ নেই। একটা জিনিসই বেশি উড়াউড়ি করে। স্বপ্ন। শাহেদের মনের আকাশে এই স্বপ্নের উড়াউড়ি একটু বেশিই যেন। তবে এখন সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নামবে। নামতেই হবে। কখন থেকে কোন মেয়ের সাথে একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখেছে তা মনে পড়ে না। থাকলে ভালোই হতো। যেদিন থেকে প্রথম ভাবা শুরু করছে কোন মেয়ের সঙ্গ সেদিনটা প্রতি বছর স্বপ্ন দিন হিসাবে জাঁকজমক হিসাবে ভাবে করা যেত।

একটু আফছোস বয়ে যায় শাহেদের মনে। ডায়েরী লিখলে ভালই হতো। আগে অনেকে ডায়েরী লিখে রাখত। যুগের পরিবর্তনের সাথে ডায়েরী লেখার অভ্যাস বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একটা ডায়েরী কিনেছিল বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে। চিন্তা করল যা যা ঘটে সব লিখে রাখবে। কিন্তু সমস্যায় পড়ছে লিখতে গিয়ে। হাতের লেখা খুব খারাপ অবস্থা। এত সুন্দর ডায়েরীতে এরকম বিশ্রী হাতের লেখা ঠিক মানায় না। ডায়েরীটার প্রতি মায়া হয়। এত সুন্দর ডায়েরীতে লেখা থাকবে মুক্তাক্ষরের মত জ্বল জ্বল লেখা। বিশ্রী লেখা লিখা হলে তা ডায়েরীটার জন্য অপমান জনক। তাই লেখার সাহস হলো না। তবে ডায়েরীটাতে কিছু অক্ষর আছে। মোহাম্মদ শাহেদ উল্লাহ, গ্রীণরোড, ঢাকা। যদিও সেগুলো হাতের অক্ষরের না। সিল দিয়ে কথাগুলো ডায়েরীতে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে।

হঠাৎ ডায়েরীটার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ডায়েরীটা বের করে ডেস্ক থেকে। এখনও একেবারে ঝকঝকে। নতুনের মত। সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করলে বউকে দিয়ে দেবে ডায়েরীটা লিখতে। বউ তার মনের কথাগুলো লিখবে। আচ্ছা যার সাথে বিয়ে হবে তার হাতের লেখা যদি খারাপ হয়? চিন্তায় পড়ে যায়। নিজের উপর বিরক্ত হয়। সব অলুক্ষণে চিন্তা। মেয়েদের হাতের লেখা গুটানো হয়। অনেক যত্ন করে ওরা লিখে। ছেলেদের মত তাড়াহুড়া করে লিখে না।

তা স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নামার জন্য প্রথমে চিন্তা করে বিয়ে করবে। একটা বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে ইদানিংকালে, এখুনি সময় দুর্নীতি থামানোর। শাহেদের মনে হয় এখুনি সময় তার বিয়ে করার। বিয়ে করার পেছনে অনেক যুক্তি আছে। প্রথম যুক্তি হচ্ছে ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে তিন জনই বিয়ে করে বিবাহিত হয়ে গেছে। ওদের সাথে গল্প করতে গেলে ওরা শুধু বউয়ের গল্প বলে। নিজেদের যেন কোন গল্প নেই। তবে গল্প গুলো শুনতে ভালোই লাগে। বউরা যে কিরুপ খাতির করে সে বিষয়ের গল্প।

সেদিন ফরহাদ বলল, দোস্ত জানিস আমার তো রাতে ফিরতে দেরি হয় প্রায় প্রতিদিনই। আমি ওকে বলি আগেই খেয়ে ফেলতে। অথচ ও খায় না। একসাথে খায়। সেদিন একটা অফিসিয়াল কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হয়েছিল। ফিরতে রাত তিনটা বাজছে। তখনও দেখি শীলা না খেয়ে বসে আছে। আমার সাথে খাবে বলে।

কথাগুলো শুনলে কেমন জানি লাগে। একটা অন্যরকম ব্যথা অনুভব হয়। ঈর্ষা হয়। কিন্তু ঈর্ষা করে কি হবে? তার যে বউ ই নাই। আফছোসে শাহেদের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

আজকাল বিয়েতে অনেক টাকা খরচ হয়। শুধুমাত্র খরচের ভয়ে অনেকে বিয়ে করতে পারে না। সেদিক থেকেও কিছুটা টেনশন মুক্ত শাহেদ। একটা প্রাথমিক হিসাব করে। ব্যাংকে এখন উঠাতে পারবে টাকার পরিমাণ ৪২ লাখ টাকা। আর অফিস থেকে বিয়ের জন্য লোন নেওয়ারও সুবিধা আছে।

শিউলিকে বিয়ের কথা বলতেই আঁতকে উঠে। যেন ও ওর মৃত্যু দন্ড শুনছে।
-তাহলে কি তুমি বিয়ে করবে না? জানতে চায় শাহেদ।
-করবো না কেন? অবশ্যই করবো। মেয়ে হয়েছি তাই বিয়ে তো করতেই হবে।
-তার মানে কি ছেলেদের বিয়ে করতে হয় না?
- করতে হয়। তারপরও চাইলে না করেও থাকতে পারে। এত কথা উঠে না। কিন্তু কোন মেয়ের বিয়ে না হলে তার সম্পর্কে হাজারো কথা বলে সবাই। কথার ভয়ে হলেও বিয়েতে বসে যেতে হয় মেয়েদের।
-তোমার কি নিজ থেকে ইচ্ছা নেই বিয়ে করার?
শিউলি তা শুনে উল্টা প্রশ্ন করে, আমি কি সে কথা বলেছি?

-তাহলে চলো বিয়ে করে ফেলি।
-তুমি হঠাৎ করে বিয়ের জন্য এত পাগল হয়ে গেলে কেন?
-হঠাৎ করে কোথায়? আমি তো আগেও বলেছি। তুমি এড়িয়ে গেছো বার বার।
- হা বলছো। তবে স্পষ্ট ভাবে না। আজ সরাসরি বলছো বিয়ে করে ফেলতে।

এই সময় মোবাইলে রিং বেজে উঠে। শিউলি একটু আড়ালে যায় কথা বলতে। কল করেছে মুশফিক। একসাথে পড়ে। -দোস্ত বিকালের দিকে বাসায় একটু আসবি।
শিউলি জানতে চায় কি হলো? বাসায় কেন?
-দুপুরে বাসায় সবাই চাচার বাসায় যাবে। তা মজা করা যাবে। হেভি আড্ডা দেওয়া যাবে।
-তুই গেলি না কেন?
-তোর সাথে মজা করতে।
শিউলি হেসে উঠে। বলে এত মজা ঠিক না।
-আচ্ছা যা ঠিক না। তুই আসলেই হলো। তা এখন কোথায় তুই?
-শাহেদের সাথে গল্প করছি।
- ঐ ঢিলার সাথে কি গল্প করিস?
- সাবধান ওরে ঢিলা ডাকবি না। ও আমার স্বামী । বুঝছিস।
-ও আবার তোর স্বামী হলো কখন থেকে?
এটাই তো বলছি তোকে। আজ সে বলছে বিয়ে করে ফেলতে। হা হা হা।
-হাসছিস কেন? ভালোইতো করে ফেল, আর কয়দিন একা থাকবি? বিয়ে করে দোকা হয়ে যা।
-গাধা বিয়ে করলে কি আর এত জায়গায় মজা করতে পারবো? বন্দী হয়ে যাবো। বিয়ের কথা এখন চিন্তা করছি না।
-মজা তো কম করছ নাই।
এই কথা শুনে শিউলি রাগ করে। - যাহ তোর লগে আর কথা নেই। বিকালে আসুম না। আজই শাহেদকে বিয়ে করবো। আমি রেখে দিচ্ছি।
-দাঁড়া, দাঁড়া। তোর সাথে একটু দুষ্টামি করলাম। আর রেখে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিস। ঠিক আছে তোর সাথে আর কোনদিন দুষ্টামি করুম না। সরি।
-ঠিক আছে। কানে ধর।
-ডান হাত তো কানে ধরাই আছে। মোবাইল সহ। এইবার বাম হাতও কান স্পর্শ করালাম। খুশীতো?
-হুম খুশী। আচ্ছা রাখি। শাহেদ বেচারা একা দাঁড়িয়ে আছে। যাই।
-ঠিক আছে। বাই বাই। বিকালে দেখা হচ্ছে।

শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে একটা গাছের নিচে। গাছে অনেক গুলো পাখি কিচির মিচির করছে। সময় কাটানোর জন্য পাখিগুলো গুণার চেষ্টা করে। যদিও বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিছু পাখি কিছু না বলে হঠাৎ উড়ে যায়। আবার কিছু এসে নতুন ভাবে বসে।

-সরি, অনেকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে রাখলাম।
শাহেদ পিছে তাকায়। শিউলির মুখ অনেক উজ্জ্বল। আগের চেয়েও। দেখতে ভাল লাগছে। উচ্ছ্বাসের সময় মুখ দেখতে অনেক ভাল লাগে। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের কারণ যদি জানত তাহলে শাহেদের উচ্ছ্বাসের বদলে ঘৃণা তৈরি হতো। অজানার কারণেই অনেক সময় খারাপ জিনিষ অনেক বেশি ভাল লাগে।

-নাহ ঠিক আছে। কথা শেষ হয়েছে।
-হুম হয়েছে। লিসা করছে। অনেক দিন ফোন দিই না, খবরা খবর নিই না ওর। তাই অনেক রাগ করে আছে আমার উপর। রাগ ভাঙলাম।
-পুরাপুরি রাগ ভাঙছে?
-হা। তবে কিছুটা আছে। সামনা সামনি দেখা হলে আশা করি সেটাও থাকবে না।

-আমি বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলাম।
-হা আমিও শুনছি।
-এখন তোমার মতামত কি?
-তুমি এত তাড়াহুড়া করছো কেন? তাড়াহুড়া করে কোন কিছু করা ঠিক না। আমার ফাইনাল পরীক্ষাটা অন্তত শেষ হোক।
-সেটা তো আরো দুবছর আছে।
-দেখতে দেখতে চলে যাবে।
শাহেদের মন খারাপ হয়ে যায়। ওর মুখ কালো করছে দেখে শিউলির শাহেদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
এই তুমি চোখ বন্ধ করো।
কেন?
করতে বলছি করো।
শাহেদ চোখ বন্ধ করে।
হা করো এবার।
শাহেদ হা করতেই লজেন্স একটা মুখে ঢুকিয়ে দেয় শিউলি। নাও বাবু এটা চুষে চুষে খাও।

শাহেদের মন ভাল হয়ে যায়। কি সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আদর করে লজেন্স খেতে বলছে। নিজেকে ফরহাদের মত ভাগ্যবান মনে হয়।

বিভ্রান্তি যতক্ষণ পর্যন্ত শাহেদকে স্পর্শ করতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ওর নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হবে।