সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

পাগলী (গল্প)

তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পর পর বজ্রপাতে আকাশ চমকে উঠছে। মানুষ চমকে উঠে কিছু অভাবনীয় দেখলে। আর আকাশ চমকায় বৃষ্টিতে। বৃষ্টিকে হয়ত বেশি ভালবাসে তাই। তবে মানুষের চমকানো আনন্দের হলেও আকাশের এই চমকানো মানুষের জন্য যথেষ্ট আতঙ্কের। পত্রিকায় প্রায়ই খবর আসছে বজ্রপাতে মৃত্যু। সেজন্য বাসায় বসে আছি। বাহিরে যাওয়ার কথা ছিল। বের হওয়ার সাহস পাইনি।


সবাই তাড়াহুড়া করে ঘরে আসছে। নির্জন রাস্তা। নাহ রাস্তাটা পুরাটা নির্জন হতে পারে নাই।কেউ না থাকলেও একজন আছে সে হচ্ছে পাগলী। ছেড়া একটা জামা পড়ে আছে। মাঝে মাঝে হা করে বৃষ্টির পানি খাচ্ছে। আমাদের এলাকায় আগে কোন পাগল ছিল না। প্রতিটি এলাকায় নাকি পাগল থাকে গল্পে পড়তাম। কিন্তু আমাদের এলাকায় কোন পাগলের অস্তিত্ব দেখি নাই আগে। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখি কলতলায় একটা মেয়ে আসছে। অচেনা। গায়ে জীর্ণ শীর্ণ একটা জামা। মুখ দেখলে বুঝার উপায় নেই যে এটা পাগল। মায়াবী চেহারা। পরে আচরণে বুঝা গেল এটা এক পাগলী।

এলাকায় কৌতুহল দেখা গেল পাগলীটা কে? কোত্থেকে এসেছে। কিভাবে আসল। সবাই দেখতে আসছে। কিন্তু কেউ উদ্ধার করতে পারলো না পাগলীর পরিচয়। আর পাগলীরা সাধারণত হাসে। বিকট শব্দ করে হাসে। আমাদের পাগলীটাকে আমরা কখনো বিকট স্বরে হাসতে দেখি নাই। মুচকি হাসে। যেন বিকট শব্দে হাসতে জানে না। মাঝে মাঝে মাথা চুলকাতে চুলকাতে কথা বলে যায়।

ঐ পাগলী নিয়ে আলোচনা সমালোচনা অনেক হলো। আমাদের আড্ডাতে বেশ কয়েকদিন ছিল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঐ পাগলী। রাহাত বিশ্বাস করতেই চায় না এই পাগল। দোস্ত এটা কোনমতেই পাগল না।
জুনায়েনদ টিটকারী মারে পাগল না, তবে ছাগল নাকি?

আমরা হেসে উঠি। রাহাত তখন বোমটা ফোটায়। শুন তোরা তো বাহিরের বই কম পড়িস। গোয়েন্দা বইয়ে দেখছি গোয়েন্দা লোকরা তথ্যের জন্য পাগলের বেশ ধরে এলাকায় থাকে। পাগল হয়ে সব নজরে রাখে। কেউ বুঝতেও পারে না যে পাগল।

এবার আমাদের একটু টনক নড়ে। হতেও পারে। কিন্তু আমাদের এলাকায় তো এমন কিছু ঘটে নাই হঠাৎ করে যে গোয়েন্দার দরকার হবে। বিশ্বাস করতেও ইচ্ছা হয় আবার না করতেও ভয় হয়। আইন বিভাগের লোক হলে সর্বনাশ।

জুনায়েদও ভয় পায় বলে মনে হয়। ও এবার টিটকারী করে না। প্রশ্ন রাখে, এই এলাকায় গোয়েন্দা আসার দরকার কি? আমাদের এখানে চুরি নিয়মিত ঘটনা। ছিচকে চুরি। কিন্তু সেটার জন্য গোয়েন্দা আসবে কেন?

এবার রাহাত পার্ট নিয়ে বসে। হুম ঠিক বলছিস। ছিচকে চুরির জন্য গোয়েন্দা আসে না। কিন্তু আমাদের পরের গ্রামের পরই তো সীমান্ত। ঐখানের কিছু নজরের জন্য হয়ত আসছে।

রাহাতের যুক্তিতে পাগলীটা যে গোয়েন্দা বিভাগের লোক এই বিশ্বাসটা আমাদের আরো পাকাপোক্ত হয়। আস্তে আস্তে সন্দেহটা চারদিকে ছড়িয়ে যায়। বড়দের মাঝেও ভর করে। যদিও কাউকে দেখা গেল না এটা সত্যি কতটুকু তা বিবেচনা করার।

আর বিশ্বাসের যাত্রা আরো শক্ত হওয়ার কারণও আছে। আমাদের এলাকায় অনেক চুরি হতো। এই পাগলীটা আসার কয়েকদিন পর চুরি বন্ধ। কোথাও চুরির কথা শুনা যায় না। একটা মহিলা পাগল কিভাবে চোরদের প্রতিহত করে এই এক রহস্য বটে। আমরা অনেকটা শক্তভাবে ধরে নিলাম এইটা সাধারণ পাগলী না। নিশ্চয়ই ছদ্মবেশে আসছে।

প্রথম দিকে কেউ কেউ সাহস করে পাগলীর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিল। মিন্টু ভাই এক্ষেত্রে প্রথমে ছিলেন। অতি সাহসী লোক। তবে অতি বদ। আমাদের ধারণা এলাকায় চুরির ঘটনার সাথে তার সম্পর্ক আছে। কিন্তু মিন্টু ভাইয়ের ভয়ে কেউ টু শব্দ করে না। যে কিছু বলবে তার বাড়ির সব কিছু হারাবে এটা যেন অপ্রকাশ্যে হুমকি। সে মিন্টু ভাই উধাও পাগলীটা আসার পর।

মিন্টু ভাই উধাওয়ের পর আমাদের বিশ্বাস আর কেউ টলাতে পারে নি যে পাগলীটা ছদ্মবেশী না। অন্য এলাকায় পাগলকে কেউ সালাম দেয় নাকি জানি না। আমাদের এখানে যতবার পাগলীটির সামনে যাওয়া হয় সবাই সালাম দেয়। লম্বা সালাম। কেউ বা সালাম দিতে গিয়ে ভয়ে ডানহাতের জায়গায় বাম হাত তুলে ফেলে।

সালামের উত্তরে পাগলী ভেংচি কাটে। সেটা আরেক ভয়ঙ্কর। জিহ্বা দুই ইঞ্চি বের করে ভেংচি দেয়।

বৃষ্টি বাড়ছে। অথচ পাগলীটা নড়ছে না। বৃষ্টিতে ভিজছে। আর নিজের পেটের উপর হাত দিয়ে থাপ্পর মারছে। পাগলীর পেটের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম বিজলী চমকানোর মত করে। পেট ফুলে আছে কিছুটা। কারণ কি? অন্য কোন কারণে কি পেট ফুলে।

ব্যাপারটা কিছু দিনের মধ্যে এলাকায় পরিষ্কার হয়ে গেলো। পাগলীর বাচ্চা হবে। কিন্তু কে করছে এই কাজ? আর কার এত্তবড় সাহস ছদ্মবেশী গোয়েন্দার সাথে এ কাজ করার?

আরো সময় কেটে যায়।

একসময় সে দিন চলে আসে। সবাই ভীড় জমায়। একটা শিশু খড়ের মধ্যে হাত পা নাড়াচ্ছে। আর তার পাশে পাগলী শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। আশেপাশে রক্ত। একটা চাদর দিয়ে পাগলীকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাটা কাঁদছে চিৎকার করে। হয়ত মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য।

কিন্তু তার মা যে পাগলী এটা সে জানে? তার চেয়ে পৃথিবীতে আগত শিশুটার জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হচ্ছে তা র মা বেঁচে নেই।

মরা পাগলীর মুখের দিকে তাকাই। এরকম অমানবিক ভাবে মরে প্রমাণিত হলো পাগলীটা আসলেই পাগলী ছিল।

আমাদের আড্ডা আগের মতই বসে। এখন পাগলীকে নিয়ে কথা বলতে আর ভয় করে না। অনেক কথা হয়। রাহাত ওর গোয়েন্দাগিরি দিয়ে প্রকাশ করে, আমার যতটুকু মনে হয় পাগলীর সাথে অপকর্মটা করছে মিন্টু ভাই। প্রথম দিকেই করেছে মনে হয়। পরে যখন শুনলো পাগলীটা ছদ্মবেশী গোয়েন্দা। তখন পালাইছে। আর পাগলী আসার পর চুরি কমে যাওয়ার কারণও একটাই। গোয়েন্দার এলাকায় এসেছে ভেবে কেউ আর চুরি করার সাহস পায় নাই।

রাহাতের কথাগুলোই হয়ত সত্য। পাগলীর জন্য খারাপ লাগে। তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগে বাচ্চাটার জন্য।

রচনাকাল- সকাল ১১.২১
২১ আগস্ট,২০১০
> প্রথম আলো ব্লগে : http://prothom-aloblog.com/posts/41/106287