সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

স্বপ্ন জোছনা ( গল্প )

চারদিকে উজ্জ্বল আলো। সাদা বর্ণের মনে হয়। আবার কখনো মনে হয় সাদা বর্ণের না এই আলো স্বর্গীয়। এই আলোর রঙ বুঝা অসম্ভব। পুকুরের পানির রঙ বদলে গেছে। মাঝে মাঝে মাছের ঝাপটানি শুনা যাচ্ছে। মাছগুলোও কি এই সুন্দর রাত উপভোগ করতে এভাবে উপরে উঁকি দিচ্ছে। দিতেই পারে। ওদেরও তো জীবন আছে। এই পুকুরে অনেক মাছ। একটু জাল ফেললেই মাছের ভারে জাল তুলতে কষ্ট হয়। তবে এই পুকুর থেকে খাওয়ার জন্য মাছ তোলা হয় না। হাট থেকে আনা হয়। মাছগুলো পুকুরেই থাকে।....


সাকিলা বসে আছে পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড়টা বাঁধানো টাইলস দিয়ে। উপরে বসার জন্য সিমেন্টের সোফা বানানো হয়েছে। উপরে ছাদ। ছাদটাও চমৎকার। ঢেউ খেলানো। তার ঠিক পাশে একটা রুম। সে রুমের সাথে আবার বাথরুম। রুমটা এসি। তবে সাকিলা সে রুমে ঢুকলে কখনো এসি ছাড়ে না। ইমনের এসি ছাড়া ভাল লাগে না। বিদ্যুৎ চলে গেলে কখনো যদি জেনারেটর ছাড়তে অপারেটর দেরি করে তবে খুব বিরক্ত হয়। একটু এসি বন্ধ থাকলেই বিরক্ত লাগে ওর। প্রথম দিন সে রুমে সময় কাটাতে আসছিল যেদিন সেদিন হঠাৎ সাকিলা কিছু না বলে এসি অফ করে দিয়েছে দেখে অবাক হয়েছিল ইমন। - এসি অফ করলে যে?

-এখানে এত বাতাস! চারদিকে বাতাসে গাছের পাতাগুলো কি সুন্দর দোল খাচ্ছে। আর সে বাতাস ঘরে ঢুকতে দিচ্ছি না। দরজা জানালা বন্ধ করে এসির কৃত্রিম বাতাস খাবো কেন? আমি প্রাকৃতিক বাতাস উপভোগ করবো। এই বলে দরজা জানালা খুলে দেয়।
-এই রুমে এসি ছাড়া থাকতে আমার কেমন অস্বস্তি লাগে।
- ঠিক আছে তুমি এই রুমেই থাকো এসিতে। আমি বাহিরে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ করো। তুমি বসে থাকো।
-ঠিক আছে, এসি লাগবে না।

এরপর থেকে এসি নিয়ে আর কথা বলে না ইমন। ভাল লাগে সাকিলার ছেলেমানুষী। হঠাৎ রাত তিনটা বেজে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। বলে চলো বাহিরে গিয়ে বসি। প্রথম দিকে ঘুমকে বিসর্জন দিতে একটু কষ্ট হতো। ইমন বরাবরই ঘুম পাগল। কিন্তু এখন ভাল লাগে হুট করে এভাবে উঠিয়ে বেরিয়ে আসা। বাহিরে এসে বসে গল্প করা। মাঝে মাঝে জোনাকী পোকাদের উড়তে দেখা যায়। জোনাকী পোকা দেখলেই ছুটে যায় সাকিলা সেদিকে জোনাকী পোকা ধরার জন্য। সব সময় ধরতে পারে না। কখনো ধরে ফেললে তা এনে ইমনের হাতে দেয়।
ইমন তা হাতে নেয়।

সাকিলা বলে, দেখছো কি ছোট্ট? ভিতরে কোন ব্যাটারী জাতীয় কিছু নেই। তারপরও অনবরত জ্বলছে।
-হুম। অনেক অবাক করার ব্যাপার।
-আসলেই। আচ্ছা ছেড়ে দাও। বেশিক্ষণ ধরে রাখলে মারা যেতে পারে।

ইমন ছেড়ে দেয়।

আজ পুর্নিমার রাত তা আগে টের পায় নি সাকিলা। সন্ধ্যা থেকে আকাশে মেঘ ছিল। অল্প বৃষ্টিও হয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। জানালা দিয়ে দেখে অল্প আলো আসছে। সুন্দর সে আলো পড়ছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। আর সে আলো প্রতিফলিত হয়ে রুমে একটা হালকা আলো ছড়াচ্ছে। এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখেই ইমনকে জাগিয়ে নিয়ে আসে পুকুর পাড়ে।

সাকিলা সিঁড়িতে বসে আছে। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ইমন। ওরা বসেছে একেবারে নিচের দিকে। আরেকটি সিঁড়ি নামলেই পুকুরের পানি ছোঁয়া যাবে। ইমন মাঝে মাঝে পা বাড়িয়ে পানিতে রাখছে। আবার উঠিয়ে নিচ্ছি।
ইমন জিজ্ঞেস করে, এই চুপচাপ কেন? কথা বলো।
-কি বলবো?
-আরে আমি শিখিয়ে দিলে তো আমিই বলতে পারি। তুমি নিজ থেকে বলো।
সাকিলা ইমনের চুলে বিলি কেটে দেয়।
চাঁদটা হঠাৎ একটা মেঘের ভিতর ঢুকে যায়। চারদিকে আলো কমে আসে। তবে তা ক্ষণিকের জন্য।

ইমন বলে, দেখছো, চাঁদটা মেঘের ভিতর ঢুকে গেছে?
সাকিলা বলে, নাহ চাঁদ ঢুকে নাই। মেঘগুলো চাঁদের উপর দিয়ে গিয়েছে। আচ্ছা দেখছো মেঘগুলো কি তাড়াতাড়ি চলে গেছে? মনে হচ্ছে চাঁদের সামনে থাকতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে।
-আসলে তো মেঘগুলো চাঁদের উপর চলে যাচ্ছে। হুম আমারো মনে হচ্ছে তাই। অনেক তাড়াতাড়ি যাচ্ছে।

আবার চুপ হয়ে যায় সাকিলা। তা খেয়াল করে ইমন বলে, এই তুমি কি চুপ থাকবে? কথা না বললে আমি কিন্তু চলে যাচ্ছি।
-ঠিক আছে। খারাপ লাগলে চলে যাও। আমি একা বসে থাকবো।
-আরে কি বলে? আমি কি সেটা বলছি নাকি! তুমি থাকবে, আর আমি তোমার সাথে থাকবো না এটা কথা হলো? যা হোক আমি তো তোমার একমাত্র স্বামী তাই না!

সাকিলা হেসে উঠে। ওর দাঁত গুলো চাঁদের আলোতে আরো সাদা দেখায়। অদ্ভূত মায়াবী সে মুখ। সাকিলার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে ইমন। সাকিলা জিজ্ঞেস করে হাসতে হাসতে, এই দুইমাত্র স্বামী হয় কেমনে?

ইমন নিরীহ ভঙ্গিতে বলে, তাতো জানি না।
-ঠিক আছে জানতে হবে না।
-যদি বলো তবে ডিকশনারী দেখে আসতে পারি।
আবার হাসে সাকিলা। হাসি থামিয়ে বলে অনেক আগের একটা কথা মনে পড়ছে।

-কি কথা? কারো সাথে প্রেম ট্রেম না তো?
এই দিবো থাপ্পর বলে সরে যায় সাকিলা। ইমন উঠে বসে।

-হায় হায় এই কথা যে কোন দুঃখে বলতে গেলাম। কি সুন্দর শুয়ে ছিলাম আরামে। এখন উঠিয়ে দিলো। দাঁড়াও অপরাধ যে করছে তার খবর করছি।

জিহবা বের করে জিহ্বাকে নিজ হাতে একটা থাপ্পর মেরে বসে ইমন। আর কথা পাসনি। কি সুন্দর বউয়ের কোলে শুয়ে ছিলাম। তোর কারণে উঠায় দিল আমারে।

সাকিলার অনেক মজা লাগে। চাঁদের আলো যেন আরো বেড়েছে। তার চেয়ে মনের আনন্দ আরো বাড়ে। সবকিছু এত্ত ভাল লাগছে।
-শুধু জিহ্বা কি কথা বলে নাকি? কথা বলার জন্য কন্ঠ, জিহবা, তালু, নাসিকা, দন্ত এগুলো লাগে। আর লাগে মন। যেখানে থেকে কথা বের হয়ে আসবে। শুধু জিহবাকে শাস্তি দিয়ে তুমি অন্যায় করছো।
-আরে আমি জানি নাকি এতকিছু। আচ্ছা মনকে শাস্তি দিবো কিভাবে?

হঠাৎ করে ব্যাঙের শব্দ পাওয়া যায়। এতক্ষণ ছিল না। কিন্তু শুরু হওয়ার পর একটু পর পর দিচ্ছে। হয়ত কোন কারণে ব্যাঙের ঘুম ভেঙে গেছে।

-মনকে শাস্তি দিতে হবে না। তুমি জিহবার কাছে ক্ষমা চাও।
-ঠিক আছে। এখুনি চাচ্ছি। এই জিহবা আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি ক্ষমা না করলে আমার প্রিয়তমা স্ত্রীও আমাকে ক্ষমা করবে না।

সময় এগিয়ে চলে। সবাই ঘুমে। এত বিশাল বাড়ীতে জেগে আছে শুধু ওরা দুজন।

কিছুক্ষণ পার হয়। আরে তুমি বললা না তো কি মনে পড়ে গেল? আমি তো ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। আমার অপরাধ মাফ। এবার বলো কি মনে পড়লো।

-আমি তখন এস এস সি পরীক্ষা দেবো। রাতে পড়া শেষ। তখন দেখি বাহিরে সুন্দর আলো। জানালার কাছে গেলাম। দেখি চারদিকে চাঁদের আলো। তা ইচ্ছা জাগলো বাহিরে যাওয়ার। বাহিরে গিয়ে বসার। খাটে মেজ আপু শুয়ে আছেন। তাকে বলবো কিনা ভাবছি। কিন্তু এটা জানি এটা অসম্ভব। আব্বু অনেক বকা দিবেন। আর আব্বুর ঘুম খুব পাতলা। দরজার সামান্য আওয়াজ পেলেই উঠে যাবেন। তখন চিল্লায়ে পুরা ঘর কাঁপিয়ে তুলবেন। সেটা ভেবে আর আপুকে ডাকি নাই। সারারাত স্বপ্ন দেখলাম খোলা চোখে। একটুও ঘুমাইনি। কল্পনা করছি। এমন একটা দিন আসবে যেদিন পূর্ণিমার আলোতে বসে দুজনে গল্প করবো। এখন দেখো এটা বাস্তবে পেয়েছি। কিন্তু এখনো আমার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। তুমি এত্ত ভাল কেন?

-এই পাম্প দিও না।
-পাম্প দিচ্ছি না? ঠিক আছে তুমি খুব পঁচা।

দুঃখ পাওয়ার অভিনয় করে ইমন। হুম তা তো বলবা। ঐ স্বপ্নে যাকে কল্পনা করতে তাকে পেলে একথা বলতে পারতে না। তাকে তো পাও নাই। এখনতো আমাকে এই কথা শুনতেই হবে। স্বপ্নের রাজকুমারকে না পাওয়ার দুঃখ এখন আমার উপর দিয়ে ঝাঁড়ে। ভাগ্যে যখন লেখা আছে কি আর করা।
অসহায়ের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে যায় ইমন।

সাকিলা স্থির দৃষ্টিতে তাকায় ইমনের দিকে। এর চেয়ে স্বপ্ন আর কিছু হতে পারে? ভাবে। তবে উপরে সেটা আর প্রকাশ করে না। অন্য কথা বলে। শুনো একটা কাজ করতে ইচ্ছা করছে। ভাল লাগত করতে পারলে।
-হুম করো। তোমাকে মানা করেছে কে?
-তুমি বিরক্ত হতে পারো। তাই করবো না।
-আশ্চর্য বিরক্ত হবো কেন? তোমার ভাল লাগতে পারে। করো।
-সত্যি বলছো তো?

সাকিলা এক ঝটকায় ইমনকে ধাক্কা মারে। ইমন গিয়ে পুকুরে পড়ে।

ইমন বলে, আরে কি করছো?এটাই তোমার কাজ? আমি তো ভাবছিলাম অন্য বড় কিছু। তবে একটু বললে ভাল ছিল।
-কেন?
-মোবাইলটা হাতে ছিল। ঐটা পড়ে গেছে পুকুরে।

এটা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় সাকিলার। ঐ মোবাইল সেটটা অনেক প্রিয় ইমনের। আর অনেক নাম্বার মেসেজ সেভ ছিল সেখানে। উচিত হয় নি এভাবে হঠাৎ ধাক্কা দেওয়া।

ওর চুপ থাকা দেখে ইমন বলে, আরে মন খারাপ করছো কেন? তুমি কি খেয়াল করেছো নাকি আমার হাতে মোবাইল আছে। তোমার কি দোষ? মন খারাপ করবে না একটুও।
-তোমার প্রিয় সেটটা এভাবে নষ্ট করে দিলাম।
-আরে বলে কি? বাজারে কি সেটের অভাব আছে নাকি? কালকেই আরেকটা কিনে নিবো।
-ঐখানে যে নাম্বারগুলো।
-সমস্যা নেই। সংগ্রহ করে নিবো। এম্নেই নাম্বার অনেক বেড়ে গিয়েছিল মোবাইলে। ভাবছিলাম কিছু ডিলিট দিবো। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কোনগুলো দিবো। এখন ভালই হয়েছে সবগুলো ডিলিট হয়ে গেছে।

বলে হা হা করে হাসে ইমন। এই এদিকে আসো। চলো সাঁতার কাটি। দেখি কে আগে ঐ পাড়ে পৌঁছতে পারে।

সাকিলাও নেমে পড়ে পুকুরে। ফিস ফিস করে বলে, আসলে তুমি অনেক ভাল। আমার স্বপ্নের রাজকুমারের চেয়ে ভাল।
কিন্তু ইমন বুঝে না।
-এই তুমি ফিসফিস করে কি বলো?
-কিচ্ছু নাহ।

দুজনে সাঁতার শুরু করেছে। তাদের ঝাপটানিতে পুকুরের স্থির পানিগুলো দুলছে। তাতে মাছগুলো নড়ে উঠছে। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে এই দুই নর-নারীর উপর। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে সাঁতরিয়ে। দুজনেই কাছাকাছি, একেবারে পাশাপাশি। পাশে থাকার জন্য কেউ এগিয়ে গিয়ে প্রথম হতে চাচ্ছে না।

পুকুরে রাতে নাকি অশুভ শক্তি ভর করে। থাকে সাপের ভয়। কোন অমঙ্গল যেন স্পর্শ করতে না পারে এই স্বপ্নের জুটিকে। তারপরও ভয় থেকে যায় প্রকৃতি অনেক সময় বেশি ভালবাসা সহ্য করতে পারে না।

যখন লিখলাম- দুপুর ১২.৫০, ২৫ আগস্ট, ২০১০।
>> প্রথম আলো ব্লগে : http://prothom-aloblog.com/posts/13/106737