সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

দু:খী মেয়ে (গল্প)

০১. মা-বাবা মরা একটা মেয়ে কতটুকু অসহায় থাকে তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝার কথা না। বুঝেও না। আর মেয়েটি যদি একটু বড় হয় তাহলে তো কথাই নাই। আশ্রয় দিতে সবাই ভয় পায়। চাচা মামা দুই পক্ষই দুই পক্ষের দিকে বাড়িয়ে দেয়। কেউ রাখতে রাজি না। শেষ পর্যন্ত যখন দেখা যায় কেউ রাখছে না তখন বড় মামা যিনি কিনা কেরানি এবং স্বচ্ছল্লতার দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে কম তিনি আশ্রয় দেন আসমাকে। যদিও এটা নিয়ে মামীর অনেক কথা শুনতে হয় মামাকে। - অন্যরা এত বড় লোক, কেউ তো রাখলো না। তুমি কেন আনতে গেলে?...........


মামার সাথে যখন ঘরে ঢুকে সাথে সাথে এই ধরণের কর্কশ প্রশ্ন শুনে আসমা । মামা পাঞ্জাবী খুলে চেয়ারে রাখেন ঝুলিয়ে, তুমি চুপ করো তো। কেউ নিচ্ছে না বলে মেয়েটি রাস্তায় থাকবে নাকি? আমরা আত্মীয়। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে না।

-অন্য অনেক আত্মীয় আছে। তারা তো দায়িত্ব নিলো না। সব দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছে কে? ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর।

মামা আর কথা না বাড়িয়ে রুম দেখিয়ে দেয় আসমাকে। বলে, তোর মামীর কথায় রাগ করিস না, উপর এরকম কঠিন কথা বললেও অনেক ভাল। তুই রুমীর সাথে থাক।

নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয় আসমার। মামাতো বোন রুমীর সাথে থাকবে। রুমিও বিরক্ত ওর রুমে অন্য একজন আসছে দেখে। এতদিন একা ছিল। পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। ইচ্ছা হলে অপরিচিত কোন ছেলের সাথে রাতদিন ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দেয়। এখন রাত জেগে কথা বলছে তা দেখে যদি মায়ের কাছে বিচার দেয় তবে মা অনেক বকা দিবে। কি দরকার ছিল আসমাকে এখানে তুলে আনার।

এই যে এই বাসায় উঠেছে এজন্য প্রতিদিনই মামীর কাছ থেকে মামার কথা শুনতে হয়। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে তখন। মামা বুঝাতে আসেন, আসমা তুই এসব কানে নিস না, আর সারাজীবন কি তোর এখানে থাকতে হবে নাকি? তোর বিয়ে হবে। দেখিস আমি একটা তোর ভাল বিয়ে দেবো। অনেক ভাল ছেলের সাথে। তুই মন খারাপ করিস নে।

মামা ছেলে মানুষীর মত বুঝান। ঘরের সবার একটা তাচ্ছিল্য ভাবের মধ্য দিয়ে কেটে যায় সময় আসমার। সে চেষ্টা করে ঘরের কাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতার। সকালে সবার আগে উঠে রুটি বানানো শুরু করে। ঘর ঝাড়ু দেয়, মুছে। মামা বলেছিলেন, কলেজে নতুন করে ভর্তি হতে। কিন্তু আসমা সরাসরি না করে দিয়েছে। এখন কলেজে যদি ভর্তি হয় তাহলে যে কি অবস্থা হবে এই ঘরে তা টের পায়। এত ঝামেলা করে পড়ার দরকার নেই।

এই ঘরে মামা ছাড়া সবাই যেন পর। আত্মীয়ের দৃষ্টিকোণ আপন তো অনেক হয়। কিন্তু আচরণের দিক দিয়ে আপন কয়জন হতে পারে। মামার জন্য খারাপ লাগে আসমার। ওর জন্য এত কথা শুনতে হয়। কোন মেয়ে নিজের বিয়ে তাড়াতাড়ি হওয়ার জন্য দোয়া করে কিনা জানে না আসমা। তবে ও খুব দোয়া করে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর দোয়া করে। যাতে তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়।

০২.
ফর্সা মুখ। হালকা গড়ন। কণ্ঠস্বর মিস্টি। নাকের নিচের তিলটা সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। দেখে ইসতিয়াকের পছন্দ হয়ে যায় আসমাকে। কিন্তু ইসতিয়াকের মা-বাবা রাজি না। একটা মা বাবা মরা মেয়েকে কোন দুঃখে বিয়ে করতে যাবে ও। তেমন কিছু পাবেও না।

ইসতিয়াক বুঝানোর চেষ্টা করে, মা শুনো। ওর তো আপন কেউ নাই। দেখবা ও অনেক ভাল হবে।
-তোকে বলছে! যারা হঠাৎ অনেক কিছু দেখে তারা দিশা রাখতে পারে না। উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করে। গরীবের পরিবেশ থেকে বড়লোকের পরিবেশে আসলে দেখা যায় তাদের মধ্যে এক ধরণের অহমিকা ভর করে। মাটিতে পা পড়তে চায় না।
-মা, আসমা সেরকম না। ওকে দেখে সেরকম মনে হয় না। অনেক ভাল মেয়ে। তাছাড়া একটা দুঃখী মেয়েকে ঘরে তোলা পুণ্যের কাজ।

মা বিরক্ত হন। এটা ইয়াতিম খানা না যে আমরা ইয়াতিম ঘরে তুলবো। শোন মানুষ দেখে বুঝা যায় না সে কি রকম। আর তোর বাবার এক বন্ধুর মেয়েকে আমাদের ভাল লেগেছে। তাকে বিয়ে কর। দেখবি অনেক সুখী হবি। দুই ফ্যামিলির স্ট্যাটাস একই। মিলে যাবে। সমস্যা হবে না।

ইসতিয়াক সাফ জানিয়ে দেয় বিয়ে করলে ঐ আসমাকেই করবে। মেয়েটা অনেক শালীন ভাবে চলে। দেখলেই মায়া লাগে।

ছেলের জিদের কাছে মা-বাবা হার মানে। অনেক বড় অনুষ্ঠান করে ইসতিয়াকের সাথে আসমার বিয়ে হয়। আসমার কাছে পুরা ব্যাপারটাই স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। ইসতিয়াকদের বাড়িতে ঢুকে তো অবাক। টিভিতে এই ধরণের বড় লোকদের বাড়ি দেখা যায়। বাস্তবে এরকম বাড়িতে আগে কখনো ঢুকে নাই।

সবচেয়ে বেশি খুশী হয় মামা। মামা কেঁদে ফেলেন। বিদায়ের সময় বলেন, তোকে এ বাড়িতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তুই আমাকে ক্ষমা করিস। তোর ঠিকমত যত্ন নিতে পারি নাই।

আসমা মামাকে জড়িয়ে কাঁদে। এই মানুষটা এত ভাল কেন?

বড় লোকের সাথে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়ার পর থেকে রুমীর আচরণে পরিবর্তনে দেখা যায়। সে অনেক তোয়াজ করা শুরু করে আসমাকে। সেও কাঁদে আসমাকে জড়িয়ে। তবে যাকে যন্ত্রণা মনে করতো, কথায় কথায় খোঁটা দিতো সে চলে যাওয়ায় কাঁদার কি আছে তা জানা যায় না। জানা যায় না কান্নাটা কি অভিনয় নাকি সত্যি। কারণ মানুষের মনে কি আছে তা দেখা যায় না। উপরের আচরণটাই শুধু প্রকাশিত হয়।

০৩.
বিয়ের পর হানিমুন। ব্যাপারটা স্বপ্নের মত নববিবাহিতাদের জন্য। অফিসে এই মুহূর্তে বড় ছুটি সম্ভব না। তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বে ও বিদেশ যাওয়া যাচ্ছে না।
অপরাধীর ভঙ্গিতে ইসতিয়াক বলে, তুমি রাগ করছো নাতো?
-কেন?
- এই যে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা ছিল। এখন যেতে পারছি না অফিসের ঝামেলায়। তার পরিবর্তে কক্সবাজার যাচ্ছি।
আসমা হাসে। আরে এখানে রাগের কি আছে। কক্সবাজার দেখতে বাহিরে থেকে আসে না মানুষ।
-হুম সেটা ঠিক। অনেক দেশ থেকে কক্সবাজার দেখতে আসে। আমরাও ভেবে নিবো অন্য দেশ থেকে কক্সবাজার যাচ্ছি। এছাড়া তো উপায় নেই।
দুইজনে হেসে ফেলে।

এই এদিকে আসো তো একটু।
-কেন?
আরে আসো না।
আসমা কাছে আসে। ঘনিষ্ঠ হয়।

আসমার ভয় হয় এত সুখ কি কপালে সইবে। কপালের একটা ধৈর্য্য আছে। এত সুখ সইবার মত ধৈর্য্য কি তার কপালে আছে?
ওর ভাবনা টের পায় ইসতিয়াক। -কি ভাবছো?
-কিচ্ছু না।

ইসতিয়াক অভিমান দেখায়। ঠিক আছে বলতে না চাইলে বলতে হবে না। আমি কি তোমার আপন কেউ নাকি যে আমাকে বলবা। আমিতো পর।
বলেই মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ফেলে।

ছেলেমানুষী অভিমান দেখে বেশ ভাল লাগে আসমার। ওহ আদর করে ওর নরম হাত রাখে মাথায়। চুলে বিলি কেটে দেয়। এই এদিকে ফিরো।
-নাহ ফিরবো না। তুমি আমাকে আপন ভাবো না।

আরে তুমি ছাড়া আপন কে আছে? তুমি যদি এরকম বলো খুব খারাপ লাগে। প্লিজ এরকম ভাবে বলবা না কখনো। কথাগুলোর মাঝে যেন কান্না ভর করে আছে।

তা টের পেয়ে ইসতিয়াক সাথে সাথে ফিরে। চিবুক ধরে আসমার। আরে দুষ্ট মেয়ে দেখি কাঁদছে। পাগলী এই কথা দিচ্ছি আর কখনো বলবো না। এবার হলো? একটু হাসো । আরে এখনো দেখি মন খারাপ করে রাখছে। হাসো না। প্লিজ হাসো। আচ্ছা বুঝছি তোমার হাসতে কষ্ট হচ্ছে। আমিই হাসিয়ে দিই। হাসতে হলে যেন কি করতে হয়। মুখ খুলতে হয়। দাঁত বের করে দেখাতে হয়। তাই না।

বলেই দুর্বলভাবে আসমার ঠোঁট দুইটি ফাঁক করার চেষ্টা করে। আসমা আর মুখ গম্ভীর করে থাকতে পারে না।
হেসে দেয়।


০৪.
হানিমুনের উদ্দেশ্যে বের হয় আসমা, ইসতিয়াক। শ্বশুর শ্বাশুড়ি থেকে বিদায় নেয়। দেখে শ্বাশুড়ির মুখ বেজার। তা দেখে একবার ভাবে ইসতিয়াককে বলবে, এই এখন যাওয়ার দরকার নেই। পরে যাই। কিন্তু তা বলতে ইসতিয়াক হতাশ হবে। রাতেও অনেক সুন্দর সুন্দর স্বপ্নের কথা বলেছে। কি করবে সেখানে গিয়ে। হোটেল বুকিং। তার বন্ধুর শেয়ার আছে সে হোটেলে। কঠিন একটা সংবর্ধনা দেওয়া হবে ঐ হোটেলে।
স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট দিতে চায় না আসমা। তাই কিছু বলে না। যদিও শ্বাশুড়ি মুখ দেখে খারাপ লাগে। নিজেদের গাড়ি করে প্রথমে যাওয়ার কথা ছিল। পরে পরিবর্তন হয়। সেখানে ভালমানের গাড়ি যাচ্ছে। সেগুলোতে বেশ আরাম। আর কক্সবাজারে তো বন্ধুর গাড়িটি পাওয়া যাবে। সমস্যা হবে না।

জানালার পাশে বসেছে আসমা। আর পাশে ইসতিয়াক।
-তোমার সাথে তো এটাই আমার প্রথম ভ্রমণ, আমার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। এর পর কত্ত জায়গায় যাবো। প্রথম তো এটাই। আহ ভুল হয়ে গেছে।
আসমা জিজ্ঞেস করে, কি ভুল হয়েছে?
-যে গাড়ি করে এতদূর ভ্রমণে প্রথম বের হলাম সে গাড়ির নং টাই দেখি নাই। এই নম্বারটা স্মরণ রাখা দরকার। বিশাল ভুল হয়ে গেছে।
আসমা হাসে। ভুলের কি আছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিবে।

আরে, গাইড তো ওর চোখ দিয়ে দেখে বলবে। আমার চোখ নাই নাকি। আমি নিজ চোখে দেখে এটা স্মরণ রাখবো। বুঝলে?
চোখ পিটিপিটি করে আসমা বলে, হুম বুঝলাম। গাড়ি লাঞ্চ ব্রেকের জন্য থামলে তখন দেখে নিও।

এই দাঁড়াও দাঁড়াও।
আসমা বিরক্ত হ্ওয়ার ভান করে। আরাম করে বসছি। দাঁড়াতে পারবো।
-আরে সে যে দাঁড়ানোর কথা বলছো সে দাঁড়াতে বলি নাই তো। চোখ পিটি পিটি করছো তো। সেটা করো তো আবার।
-কেন?
-তোমাকে এত্ত সুন্দর লাগছিলো যে। কি বলবো। অনেক সুন্দর লাগছিলো।
দুষ্টামি করে আসমা বলে, তাহলে তো করা যাবে না। তোমার মুখ লেগে যাবে।

ইসতিয়াক গম্ভীর স্বরে বলে, বউদের উপর স্বামীদের মুখ লাগে না।
-বাহ! এই তথ্য তোমারে দিলো কে?
-আমি জানি জানি।
- যেভাবে বলছো, ,মনে হচ্ছে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে সব জ্যান্তা। এর আগে যেন কয়েকটা বিয়ে করেছো।
সামনের বক্স থেকে কমলা নিয়ে তার চামড়া ছাড়তে ছাড়তে ইসতিয়াক বলে, একটা বিয়ের জ্বালায় বাঁচি না। আবার আরো বিয়ে।

আসমা বলে, কি আমাকে বিয়ে করে জ্বালায় পড়ছো? বিয়ে করতে গেলা কেন?
-আরে কি বলে কি বুঝে। আমি বললাম একজনকে বিয়ে করেই এত স্বপ্নে আছি যে। অন্য কোন স্বপ্নরে জ্বালা সহ্য করতে পারবো না।
-হুম ভালোই তো কথা ঘুরাতে পারো।

ইসতিয়াক কমলার কোষ কয়েকটা আসমাকে দেয়। নাও খাও। ওহ মজার ব্যাপার কি জানো? আমি এত কথা কখনো বলি নাই। অন্যরা জানলে অবাক হয়ে যাবে আমি এত কথা বলি।
-আরে তুমি আগে বিয়ে করছো নাকি? এত কথা বলবে কিভাবে। তবে প্রেম ট্রেম করলে ভিন্ন কথা। তখন আরো বেশি কথা বলতে হয়।
প্রেমের কথা শুনে ইসতিয়াক যেন আকাশ থেকে পড়ে। - স্ট্যাডরি সময় স্ট্যাডি নিয়ে আর চাকরিতে ঢুকার পর তা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়েছে যে প্রেমের সুযোগ পাই নি। তবে এখন থেকে প্রেম করবো।

আসমা কমলার কোষ ফেরত দেয়। তোমার দেওয়া কমলা খাবো না। কত্তবড় সাহস বলে কিনা এখন থেকে প্রেম করবে।

-আরে কার সাথে প্রেম করবো সেটা না শুনেই প্রতিক্রিয়া! আমি তো শুধু প্রেম করবো আমার বউয়ের সাথে। বুঝছো?
আসাম হেসে ফেলে। তবে হাসিটা দীর্ঘায়িত হতে পারে না।

গাড়িটা ওভারটেক করতে যাচ্ছিলো একটা বাসকে। তখন সামনে থেকে একটা ট্রাক কোথা থেকে যেন এসে পড়ে। এদিকে পাশে বাসের জন্য সরতেও পারছিল না এসি বাসটা। চোখের পলকে ট্রাকটা সরাসরি এসে পড়ে বাসের সামনে। ওভারটেক করতে যাওয়ার কারণে এসি বাসের গতি ছিল বেশি। ট্রাক আর এসি বাসের গতিতে মুখোমুখি সংঘর্ষে বাসটা গিয়ে পাশের খাদে পড়ে।

কে যেন আসমাকে ধাক্কা মেরে জানালা দিয়ে বের করে দেয়। এরপরের কিছু মনে নাই।

হাসপাতালে যখন জ্ঞান ফিরে তখন ইসতিয়াককে খুঁজে। নার্স বলে, অস্থির হবেন না। আপনার হাসবেন্ড পাশের কেবিনে আছে। ওনার চিকিৎসা চলছে।

নার্সরা রোগীর স্বান্তনা দেওয়ার জন্য অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারেন। মৃত মানুষকেও জীবিত বলে দেন।

আসমার সহ্য হয় না। আমি আমার হাসব্যান্ডের কাছে যাবো। আমার হাসবেন্ড দূর্ঘটনার সময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাঁচিয়ে দেন।

নার্স বলে, একটু অপেক্ষা করুন। ওষুধটি খেয়ে নিন। আপনাকে আপনার হাসব্যান্ডের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।

কিন্তু আসমার অপেক্ষা আর শেষ হয় না। এই অপেক্ষা আর এই জীবনেও শেষ হবে না।

ইসতিয়াকের মুখ সম্পূর্ণ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। গলা কেটে গেছে। একটুর জন্য তা ঝুলে আছে। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। এই ধরণের লাশ দেখানো ঠিক হবে না মুরুব্বীরা এই সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ইসতিয়াককে আর দেখানো হয় না। আসমা দেখতে পায় না নিজ স্বামীর মৃতদেহ।


০৫.

একদিকে স্বামীর মৃত্যু তার উপর শ্বাশুড়ি অভিযোগ সাথে এই পরিবারের আরো কেউ কেউ এক কষ্টকর জীবন শুরু হয় আসমার। হঠাৎ থেমে যায় সব স্বপ্ন। সব এখন অন্ধকার। আসমার জীবনে হানিমুন হয়ে গেছে ব্ল্যাকমুন। যা সূচনা করেছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কষ্টকর জীবন।

শ্বাশুড়ির মতে, সব দোষ আসমার। সে অলক্ষী। তার কারণেই নিজের ছেলেকে হারাতে হয়েছে। এই অলক্ষীকে বাসায় রাখা যাবে না। এর মধ্যে আরেকটা ব্যাপারও শ্বাশুড়ির মাথায় ঢুকে গেছে। আসমা এখানে থাকলে এই বাড়ির মালিকানা দাবি করতে পারে। তাছাড়া ইসতিয়াকের ভাগের সম্পত্তিগুলো খুঁজবে একসময়। তাই তাকে এই ঘরে রাখা যাবে না। বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। যে করে হোক বিয়ে দিতেই হবে। তাহলে সম্পত্তি ভাগ থেকে দূরে সরানো যাবে।

মনের দুঃখে যখন দিশেহারা আসমা তখন শ্বাশুড়ি বলে, আমি তো তোমার ভাল চাই। তোমাকে বিয়ে দিতে চাই।
-মা, এটা কি বলছেন। বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। ইসতিয়াকের স্মৃতি আঁকড়ে আমি বেঁচে থাকবো।
-নাহ এটা হয় না। তোমার বয়স কম। অনেক জীবন পড়ে আছে।
-নাহ মা এটা বলবেন না। আমি বিয়ে করতে পারবো না।
-তুমি বোঝার চেষ্টা করো। আমরা তোমার ভালোর জন্য বলছি। তোমার একজন সঙ্গী দরকার। বিয়ে দিলে সঙ্গী পাবে। কষ্ট শেয়ার করতে পারবে।

আসমার কান্না চলে আসে। ইসতিয়াকের জন্য কষ্ট অন্যের সাথে শেয়ারের প্রশ্ন আসছে কেন? সে কান্না করতে করতে বলে, মা আমি এ ঘরে কাজের মেয়ের মত থাকবো। সব কাজ করবো। তারপরও বিয়ের কথা বলিয়েন না। আমি পারবো না।

কথাটা শুনে মায়া লাগে শ্বাশুড়ির। কিন্তু এখানে রাখলে বিপদ। সম্পত্তির মালিকানা খুঁজে বসবে। তাই কোন মতেই এখানে রাখা যাবে না। অবশ্যই বিয়ে দিতে হবে।

অসহায় হতে হতে যখন মানুষ অসহায়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে তখন প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যায়। মানুষ হয়ে যায় যেন পুতুল। তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তা করানো যায়। আসমার এখনকার অবস্থাও হয়েছে সেরকম।

তার আবার বিয়ে দেওয়া হয়।

শ্বাশুড়ির মনে নিজের সম্পত্তি রক্ষার চেষ্টা। কিন্তু এটা বুঝতে পারে না আসমা। যদি বুঝতো তবে সে সাদা কাগজে সই দিয়ে বলে দিত কোন সম্পত্তির ভাগ দাবি করবে না। কিন্তু ব্যাপারটা ওকে বলা হয় নি।

০৬.

আদালতে আসমা আসছে। আসমার দেবর আইনজীবি। সে আসমার পূর্বের শ্বশুর পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সম্পদের দাবি বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগে। আসমার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু নিজেকে এখন পুতুল ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না সে।

আসমার পূর্বের শ্বাশুড়ি ও সেখানে আছে। মহা দুশ্চিন্তা তার। আদালত কি রায় দেয়। অনেক দিন পর দেখা হয় শ্বাশুড়ির সাথে। আসমা পা ধরে সালাম করে শ্বাশুড়ি। শ্বাশুড়ি তেমন

আদালতে নীরবতা। দুই পক্ষের আইনজীবি যুক্তি দেখাচ্ছে নিজ নিজ পক্ষকে জিতিয়ে নেওয়ার জন্য। চলছে কথা যুদ্ধ।
যুক্তি তর্ক উপস্থাপন শেষ। এবার রায়ের পালা।

আদালত আসমাকে এভাবে সম্পত্তি বঞ্চিত করার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং নির্দেশ দেয় সাতদিনের মধ্যেই যেন আসমাকে সকল সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ইসতিয়াকের অবর্তমানে তার সকল সম্পত্তির বৈধ মালিক তার স্ত্রী। যেহেতু তাদের সন্তান নেই। আদালত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়।

আসমার শ্বাশুড়ি রায় শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তা দেখে সবার আগে ছুটে যায় আসমা। শ্বাশুড়ি মাথা নিজের কোলের উপর উঠিয়ে পরম মমতায়। পানির ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।

>> প্রথম আলো ব্লগে : http://prothom-aloblog.com/posts/13/107163