সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মুক্তি (গল্প)

গ্রামটার নাম ইয়াবামী। ক্যামেরুনে। উত্তরে দুয়ালা শহর থেকে কয়েক ঘন্টার পথ। তবে রাস্তার অবস্থা ভাল না। মাটির রাস্তা। বর্ষাকালে সম্পূর্ণ রাস্তা কাদা হয়ে যায়। কোথাও কোথাও জমে চোরা বালি। গাড়ীর চাকা সে চোরাবালিতে আটকে পড়ে। তাই বর্ষা কালে এদিকে তেমন গাড়ি যায় না।........


বিদ্যুত না থাকায় এলাকাটি রাতে পরিণত হয় অন্ধকার রাজ্যে। বাহিরে দাঁড়ালে দেখা যায় মিটি মিটি কুপির বাতি জ্বলছে ঘর গুলোতে। একটা ঘর থেকে অন্য ঘর দূরে। তবে দুইটা ঘরে সৌর বিদ্যুত আছে। ওরা শহরে ব্যবসা করে। ওদের বাসা থেকে সাদা আলো হালকা বাহিরে পড়ে। বিভিন্ন ঘরের বাতির মিটি মিটি আলোর মাঝে ঐই দুইটা সাদা আলোকে অন্যরকম লাগে।

তুরাফা ঘরের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাবা বাজার করতে গেছে সে ভর দুপুরে। এখন সন্ধ্যা শেষে রাত নেমেছে। এখনও ফিরেন নাই। বাবা আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ওর চোখ বাজারের যাওয়ার রাস্তাটার দিকে। এখানে ছিনতাই, রাহজানি, অপহরণ বেশি। দুইদিন আগেও একটা খুন হয়েছে। পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তের বাড়ীটা গুয়েনের। তাকে বাসায় মধ্যে কারা জানি খুন করে যায়।

গুয়েনকে কবর দেওয়া হয়েছ বড় গাছটার নিচে। তুরাফাদের বাসার কাছে। তুরাফা দেখেছে। অনেক মানুষ যোগ দিয়েছে অন্তঃষ্ক্রিয়ায়। এই এলাকায় প্রায় সময় মানুষ মারা যায়। বেশির ভাগই খুন। লাশে রক্ত লেগে থাকে। তুরাফা ছোট। কখনো অন্তষ্ক্রিয়ায় শরিক হয় নাই। তারপরও দেখতে দেখতে অন্তষ্ক্রিয়ার সকল নিয়ম ওর মুখস্ত।

অন্তষ্ক্রিয়ার কথা মনে আসতেই ভয় লাগে তুরাফার। ওর বাবার এমন কিছু হয় নাইতো? ইচ্ছা হয় বাবা বলে চিৎকার দিতে। কিন্তু তা দেওয়া যাবে না। সবাই ছুটে আসবে।

ওর মা ডাক দেয়, কিরে তুরাফা বাহিরে কিজন্য দাঁড়িয়ে আছিস, বাসায় আয়।

মা-কে খুব ভয় পায় তুরাফা। তাই সে ডাক শুনা মাত্রই ভেতরে চলে আসে। বাবার জন্য চিন্তা হয়। বাবা ফিরলেন না কেন? মা-কে জিজ্ঞাস করতে ইচ্ছা হয়। জিজ্ঞেস করলে আবার ধমক দিবেন না তো? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাস করে ফেলে, মা বাবা এলো না যে এখনো?

ওর মা মেঝেতে বসে কাঁথা সেলাই করেন। উত্তর দেন না কিছু। কিছুক্ষণ পর বলেন, যা পা ভাল করে ধুয়ে শুয়ে পড়।

তুরাফার খারাপ লাগে। আজও কি রাতে খাবার দেবে না। মাঝে মাঝে রাতে কোন কিছু রান্না করা হয় না। আজও কি সেরকম। বাবা বাজার নিয়ে আসলে হয়ত কিছু রান্না হতো। বাবা কি ফিরবেন না?

তবে মা-কে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভয় করে তুরাফার। মা অনেক রাগী। সে পা ধুয়ে এসে শুয়ে পড়ে। নাহ ঘুম আসে না। বাবাকে চুপি চুপি বলেছিল একটা পুতুল আনতে। বাবা বলেছিলেন আনবেন। তবে নিষেধ করে দিয়েছে মা-কে যেন না বলে পুতুলের কথা।

রাত বাড়ে। বাহিরে বন্য প্রাণীর আওয়াজ শোনা যায়। রাতে সাধারণত কেউ বের হয় না। অপহরণের ঘটনা প্রায় সময় ঘটে। মানুষ বের না হওয়ার কারণ যতটা না বন্য প্রাণী তার চেয়ে বেশি অপহরণকারীদের।

তুরাফার ঘুম আসে না। বাবা এখনও আসছেন না কেন? ইচ্ছা হয় বাহিরে গিয়ে দাঁড়াতে। ওর মনে হয় বাহিরে গিয়ে দাঁড়ালে অপেক্ষা করলে বাবা চলে আসবে। পুতুল আনবে। পুতুল আনলে মা-র কাছ থেকে পুতুলটি লুকিয়ে রাখতে হবে। মা দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

কিন্তু পুতুল আনার অপেক্ষা শেষ হয় না। সেদিন আর বাবা আসেন নি। শুধু সেদিন না। পরেও আসেননি। মা কিছুদিন খোঁজ করেছেন। তারপর আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বছর পার হয়। মা-র সাথে অন্য আরেকজনের বিয়ে হয়। সে বাসাতেই এখন থাকে তুরাফা।

তুরাফা বড় হয়েছে। এগারোতে পড়ছে। পুতুল খেলার বয়স শেষ হয়েছে আরো আগে। এখন ঘরের অনেক কাজ করে। ঐ দূর কুয়া থেকে পানি আনে। শুধু নিজের বাসায় না। এখানে ধনী দুই পরিবার আছে। একটা জেক্স হেরিপনের পরিবার। সে পরিবারেও পানি এনে দেয় তুরাফা। প্রতি বালতি পানির জন্য একটাকা করে পায়। টাকাগুলো মা-কে দিতে হয়।

চিৎকারের আওয়াজ আসে রুম থেকে। প্রচন্ড চিৎকার। তুরাফার মা-র খারাপ লাগে মেয়ের চিৎকার শুনে। কিন্তু করার কিছু নেই। তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন তার মাও তাকে এরকম করেছিল। অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে ভাল এখন নিজের মেয়েকে নিজের কষ্ট দিতে হচ্ছে না।

কান্নার আওয়াজ বাড়ে। তা শুনেও হাতের কাজ এগিয়ে নেন। এখানে অপহরণ, ধর্ষণের সংখ্যা বেশি। মেয়ে একটু স্বাস্থ্যবতী হলেই অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেগুলো শহরে বিক্রী করে দেওয়া হয়। আর নির্যাতন চলে সে মেয়েদের উপর। এজন্য অভিভাবকরা সন্তান একটু বড় হতে দেখলে তাদের যাতে স্বাস্থ্য বতী না দেখায়, তারা যাতে কারো নজরে না পড়ে সেজন্য এই নির্মম ব্যবস্থা নেন। এটাই এখানকার রীতি।

তুরাফার বুক জ্বলছে। মনে হচ্ছে বুকের চামড়া ছিড়ে পড়ে যাবে। ওর বুকে গরম পাথর ঘষা হচ্ছে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু লাভ নেই। দুইজন দুই দিকে ধরে আছে। বুকে ঘন ঘন পাথরের ছ্যাক দেওয়া হচ্ছে। অনেক জ্বলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত হাড্ডির সাথে বুকের চামড়া না মিশে যায় ততক্ষণ দিতে থাকে। যাতে লেপ্টে যায় বুক।

আর এতে কারো নজরে পড়বে না। তুরাফার খারাপ লাগে। তার বাবা থাকলে এমন কষ্ট হতে দিতেন না। বাবা অনেক আদর করত।

যে মহিলা পাথর ঘষে তার নাম এমিলিয়েন। তার কোন ছেলে মেয়ে নেই। এই গ্রামে কোন মেয়ের বাড়ন্ত শুরু হলে তার ডাক পড়ে। তিনি গিয়ে গরম পাথর ঘষেন। যাওয়ার সময় তুরাফার মা-কে বলে যান সামনের সপ্তাহে আবার এসে ঘষা দিবেন। তুরাফার মা টাকা বের করে দেন।

তুরাফার অসুস্থ হয়ে পড়ে। দিন দিন অসুস্থতা বাড়ে। কপাল গরম।
তুরাফার পাশে ওর মা বসে আছে। ওর মা জিজ্ঞেস করে, বেশি খারাপ লাগছে?

তুরাফা মাথা নাড়ে। ওর মা তুরাফার কপালে হাত বুলিয়ে দেন। চুলে বিলি কাটেন।
-মা, আমাকে এত কষ্ট দিলো কেন ঐ বুড়িটা?

ওর মা বলে, এগুলো এখানে সব মেয়েকে করা হয়। না হলে ঐ জলদুস্যদের চোখ পড়ে। ওরা তুলে নিয়ে যায়। তারপর কঠিন নির্যাতন করে। অনেক কষ্ট দেয়।

তুরাফা অসহায় ভাবে বলে, এরচেয়ে আর বেশি কষ্ট হতে কি হতে পারে?
-তুই বুঝবি না। অনেক কষ্ট দেয় ওরা।

তুরাফা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এর চেয়ে বেশি কষ্ট আছে তা তার বিশ্বাস হয় না।

সপ্তাহ শেষ হলে ঐ মহিলা আবার আসবে।

জ্বর বাড়ে। তুরাফা প্রলাপ বকে। মাঝে মাঝে ডাক দেয়, বাবা, বাবা। তুমি কোথায়? আমাকে নিয়ে যাও।
ওর মনে হয় ওর বাবাও ওকে ডাকছে।

ঐ মহিলার আর আসতে হয় না। এর আগেই তুরাফা পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। অপহরণকারীদের হাত থেকে বেঁচে যায়। বেঁচে যায় ঐ মহিলার নির্যাতন থেকে।

তুরাফা বেঁচে গেছে মরে। তবে ঐ এলাকার ছোট মেয়েদের এরকম কষ্ট দিয়ে লোলুপ দৃষ্টি থেকে আড়াল করে এখনো রাখা হয়। এটাই যে ঐ এলাকার নিয়ম।


>>প্রথম আলো ব্লগে : http://prothom-aloblog.com/posts/13/106862