শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

রোজা ( গল্প )

রোজার সময় রোজা রাখা অনেক সহজ। সবাই রাখে। এজন্য তেমন সমস্যা হয় না। ঐ সময় রোজা রাখাটাই স্বাভাবিক মনে হয়। ইমা যখন ছোট ছিল তখন থেকেই ওর রোজা রাখার ইচ্ছা। মা-কে বলত, আম্মু আমাকে সেহেরীর সময় অবশ্যই ডেকে দিবে। আমি রোজা রাখব।..................


মা সরাসরি না করতেন না। তবে ঠিকই ডাকতেন না। সকালে উঠে কেঁদে দিত ইমা। প্রতিদিন সকালে উঠে কাঁদত ইমা। ওর কান্না শুনে মা বলতেন, ঠিক আছে আগামী কাল ডেকে দিবো। এখন কান্না থামাও। ও বলাটাই। কখনো উঠাতেন না। এত ছোট থাকতে কিসের রোজা!!

সেসবের দিনের কথা মনে পড়লে অন্য রকম লাগে। তবে ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকে ইমাকে সেহেরীতে নিয়মিত উঠানো হয়। ঐ বছর রোজার সময় ওর দাদীও ছিল ওদের সাথে। প্রথম রোজার দিন দাদীই তুলে দেন। চারদিকে অন্ধকার। বাহিরে কিছু ছেলে ডাকাডাকি করে যায়। মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে গজল। সময়টাকে অনেক পবিত্র মনে হয়।

সবাই একসাথে বসে খায়। এখন রোজার সময় দাদীর জন্য অনেক খারাপ লাগে ইমার। দাদী মারা গেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় দাদী এল বুঝি ঘুম থেকে তুলতে। কিন্তু দাদী আসেন না।

তবে রোজার সময় ছাড়া অন্য সময় রোজা রাখা একটু কষ্টকর বটে। সেহেরীর সময় উঠা, দুপুরে সবাই খাচ্ছে অথচ একাকী না খেয়ে থাকা ব্যাপারগুলো একটু অস্বাভাবিকই বটে। আর তার উপর রোজাটা যদি গোপন রোজা হয় তাহলে তো আরো সমস্যাজনক।

মায়ের প্রচন্ড অসুখ। এদিকে পড়ালেখারও অনেক চাপ। নবম শ্রেণীতে পড়ে ও। ডাক্তার অসুখ ধরতে পারছেন না। এই অসুখটা মাঝে মাঝেই হয়। অনেক কষ্ট হয় তখন মায়ের। তারপরও অসুখ নিয়ে অফিস করেন। তবে এবার অসুখটা বেশিই ধরেছে। উঠতেই পারেন না। ইমা মায়ের পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মাকে জিজ্ঞেস করে, মা তোমার কেমন লাগছে?
-হা এখন আমি ভাল আছি। তুমি চোখের সমস্যার জন্য ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছে তা খেয়েছো?

মাকে দেখে মনে হয় না ভাল আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কপাল কুঁচকে আছেন। নিশ্চয় অনেক ব্যথা করছে মাথা। হাত বুলাতে থাকে ইমা।

-খেয়েছি। আস্তে করে বলে ইমা।
-এখন যাও। আমার আগের চেয়ে ভাল লাগছে। আগামী কালের পড়াগুলো তৈরি করে ফেলো।

ইমার যেতে ইচ্ছা করে না। মায়ের পাশে বসে থাকতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বসে থাকলে মা বিরক্ত হবেন। তাই অনিচ্ছা সত্বেও চলে যায়।

ওর রুমে এসে পড়ার টেবিলে বসে। পড়ার টেবিলের পাশেই কম্পিউটার টেবিল। পড়া লেখা করতে করতে এক ঘেয়েমী লাগলে কম্পিউটারে গিয়ে বসে। ফেসবুকে, ব্লগে ঘুরাঘুরি করে। মাঝে মাঝে ইয়াহুতে ঢুকে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করে। মন ভাল হয়ে যায়। সব অফ করে আবার পড়তে বসে।

এখন কম্পিউটারে বসতেই ইচ্ছা করে না। মায়ের অসুখের কারণে সবকিছু খারাপ লাগে। ডাক্তার বলছেন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। মা-র অসুখ ভাল হওয়ার জন্য ইমা তিনটি রোজা রাখবে চিন্তা করে। সিদ্ধান্ত নেয় আজ থেকেই রাখবে।

টেবিলে বই খোলা। ফিজিক্স। গতবার এই বিষয়ে তিন নাম্বার কম পাওয়ায় পিছে চলে যায়। তাই এবার এই বিষয়টা একটু বেশি পড়তে হচ্ছে। কিন্তু মাথায় যে কিছুই ঢুকছে না। বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে আসে ও। চোখে পানির ঝাপটা দেয় বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে। চোখে পানির ঝাপটা দিলে ভাল লাগে ওর। বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেয়। পড়ায় মন বসানো দরকার। অথচ বসছে না।

পাকঘরে যায়। চা বানায়। আর এই ফাঁকে ফ্রিজ থেকে তরকারি নিয়ে আসে গোপনে। যাতে কাজের বুয়াটাও টের না পায়। জানলে মা-কে বলে দিবে। তখন মা বকা দিতে পারেন। তরকারি গুলো একটা প্লেটে নিয়ে আর কিছু ভাত নিয়ে টেবিলের কোণায় রেখে দেয়। ঘুমানোর আগে খেয়ে নেবে।

ভাগ্যিস দুপুর বেলায় স্কুলে থাকতে হয়। দুপুরের খাবার বাসা থেকেই নিয়ে যায়। স্কুল ছুটি হয় বিকালে। স্কুল ছুটির পরই কোচিংয়ে যেতে হয়। কোচিং শেষ হলে প্রাইভেট। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সুতরাং সেহেরীটা চুরি করে খেতে পারলেই ধরা খাওয়ার আর সম্ভাবনা নেই।

কিছুক্ষণ পড়ে নেয় ইমা। রাত বাড়ে। পড়তে লাগলে ঘড়ির দিকে তাকায় না ইমা। শেষ হলে তবে দেখে কয়টা বাজছে। রাতের সময় নিয়ে অনিশ্চিত থাকতে ভাল লাগে ইমার। সমস্যা হয় না। একমাত্র রাতে ধরা বাঁধা নিয়ম নেই। সারাদিন এটা এই টাইমে ঐইটা ঐই টাইমে করতে হয়। যা করতে করতে ও মোটামুটি বিরক্ত। রাতে সে সমস্যা নেই।

রাতের বেলায় ইচ্ছামত এই সুযোগটা গ্রহণ করে ইমা। ঘড়ির দিকে তাকায়-ই না। সময় অপচয় হলে ঘুম ছাড়া অন্য কিছু মিস হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই জিনিষটা অনেক ভাল লাগে ইমার। সেজন্য রাতে অনেক্ষণ জাগে।

পড়া শেষ হয়। টেবিলের উপর ঘড়ি আছে। গত জন্মদিনে বাবা দিয়েছিল। ঘড়ির কাঁটায় শক্তিশালী রেডিয়াম। অন্ধকারেও অনেক দূর থেকে স্পষ্ট কয়টা বাজছে তা বুঝা যায়। ঘড়ির দিকে তাকায় ইমা। তিনটা পাঁচ বাজে।

হাত ধুয়ে আসে আস্তে করে। এরপর ভাতের প্লেটটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে। ঠান্ডা হয়ে গেছে তরকারি। বিরক্ত লাগছে খেতে। রোজার সময় সবাই মিলে খেতে কি মজা। এখন একা একা খেতে ইচ্ছা করে না। তারপরও জোর করে গিলতে থাকে যতটুকু পারে।

সকাল বেলায় নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকা হয় ইমাকে। বুয়া ডাকে। ইমা বলে, এখানে নিয়ে আসো। আমার একটা পড়া এখনো শেষ হয় নাই।

বুয়া দিয়ে যায়। বুয়া রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আস্তে করে পলিথিনে ভরে ফেলে ডিমভাজি আর পরোটা। বুয়া পরে এসে খালি প্লেট নিয়ে যায়।
স্কুলে যাওয়ার সময় টিফিন বক্সে ভাত দেওয়া হয়। সেটা ব্যাগে ভরে স্কুলের দিকে রওয়ানা দেয়।

রিকসা করে স্কুলে যায় ইমা। রিকসা অলারা অনেক কথা বলে। মন ভাল থাকলে ইমাও উত্তর দেয়। যেদিন মন ভাল থাকে না সেদিন কিচ্ছু বলে না। চুপ হয়ে শুনে যায়। রাস্তায় জ্যাম। গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ কানে লাগে। সকালের সুন্দর পরিবেশটাই যেন নষ্ট করে দিলো গাড়ির ইঞ্জিনগুলোর বিদঘুটে আওয়াজ। এখন পাখির শব্দে সকাল হয় না, সকাল হয় গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে।

সিগনালে পড়লে একটা জিনিষ খুব খারাপ লাগে। কিছু বিকালঙ্গ এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। মুখ ঝলসে গেছে এরকম একটা মহিলাও আছে এদের মাঝে। পুরা মুখ থেতলে আছে। চামড়া পুড়ে গেছে। কোন নরপশু এডিস মেরেছে হয়ত। মনে মনে ওই মহিলাকে খুঁজে ইমা। আজ আসে নি নাকি? এর মধ্যে একটা ল্যাংড়া এসে হাত পাতে। ইমা ব্যাগ খুলে। তারপর পরোটা ডিম সহ দুপুরের খাবার পলিথিনে করে দিয়ে দেয় ঐ ল্যাংড়া ছেলেকে।

ল্যাংড়া ছেলেটার মুখে হাসি। একটু অবাকও হয় হয়ত। অনেকদিন এরকম খানা দেখেনি। ইমার ভাল লাগে। ওর রোজার কারণে একটা ল্যাংড়া খেতে পারবে পেট ভরে।

স্কুলে টিফিনের ছুটি দেওয়া হয়। দুপুরে সবাই একসাথে খায়। অনেক গরম পড়ছে। পিপাসা পায় ইমার। কিন্তু পাত্তা দেয় না।

ওর বান্ধবী তোফা জিজ্ঞেস করে, কিরে দুপুরে খাবি না? টিফিন বের করছিস না কেন?
পরে খাবো। এখন একটু কাজ আছে। পেটটাও ব্যথা করছে। বলে তিন তলায় উঠে যায় ইমা। তিনতলায় ওদের স্কুল লাইব্রেরী। সেখানে গিয়ে বই পড়ে। ক্লাস শুরুর সময় ঢুকে।

এভাবে ফাঁকি দিয়ে দুইটা রোজা রেখে ফেলে। ইমার মনে হয় আল্লাহ ওর দোয়া কবুল করবে। ওর মা নিশ্চয় ভাল হয়ে যাবেন।