অনিক চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে একটা বেসরকারি বিদ্যালয়ে। এখানে শুধু নিয়ম আর নিয়ম। এটা করা যাবে না, এইটা করতে হবে এরকম হাজারো সীমাবদ্ধতা। বিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি মাঠ আছে বটে। তবে সেখানে অনিকরা ইচ্ছে করলেও খেলতে পারে না। মাঠে উঁচু শ্রেণীর ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। সেখানে ছোট শ্রেণীর ছেলেদের নেওআ হয় না।
বিজ্ঞান ক্লাস চলছে। সবাই নিরব। এতটুকু শব্দ করার সুযোগ নেই। কেননা জসিম স্যার খুব কড়া। কেউ কথা বললে ভীষণ শাস্তি দেন। কোনো বিষয় না বুঝলে প্রশ্ন পর্যন্ত করার পর্যন্ত সাহস পায় না কেউ। স্যার মাঝে মাঝে ভয়াবহ কান্ড করে বসেন। গত বছরে যেমনটি করেছিলেন। আফসার পিছনের সিটে বসেছিল। পাশের জনের সাথে কথা বলছে। স্যার তা লক্ষ্য করে হাতরে ডাস্টারটি তার দিকে ছুঁড়ে মারেন। কপালের একপাশে লেগে তা নিচে পড়ে যায়। মাথার একপাশ ফেটে রক্ত বের হয়। আফসার নিজের কপাল চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা চালায়।.......................
রক্ত দেখেও স্যারের কাঠিন্য কমে না। হুঙ্কার ছাড়েন, কিরে আফসার ডাস্টার এখনো এনে দিলি না যে, এক্ষুনি আন।
আফসার এক হাতে কপাল চেপে ধরে অন্য হাতে ডাস্টারটি এনে স্যারের টেবিলে রাখে।
পরে স্যার পাশের ফার্মেসী থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনেন।
এরপর থেকে জসিম স্যারের ক্লসে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করে না। জসিম স্যার অক্সিজেন বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন। এ সময় ফরিদ স্যার আসেন। ফরিদ স্যারকে আসতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে যায়। ফরিদ স্যার বলেন- বসো, বসো, সবাই বসো।
তারপর জসিম স্যারকে বলেন, আপনাকে একটু ডিস্টার্ব করতে এলাম।
জসিম স্যার হাসতে হাসতে বলেন- না, না, ঠিক আছে। অসুবিধা নেই।
ছাত্রদের মনে আফসোস বয়ে যায়। স্যার পড়ানোর সময় একটুও হাসেন না। মুখ সব সময় কড়া করে রাখেন। অথচ এখন অন্য স্যারের সাথে কথ বলছেন কি সুন্দর হেসে হেসে। ইশ! স্যার যদি সব সময় হাসিমাখা মুখে থাকতেন।
ফরিদ স্যার বলেন- সামনের মাসে প্রথম সপ্তাহে বিজ্ঞান মেলা হবে।
বিজ্ঞান মেলার কথা শুনে অনিক খুশী হয়ে যায়। গত বছর বিজ্ঞান মেলায় বিভিন্ন প্রজেক্ট দেখে ওরও ইচ্ছে জাগে বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিবে। এজন্য তখন থেকেই বিভিন্ন জিনিষ তৈরি করতে থাকে।
ওর মা যেখানে রান্না করে তার পাশে খালি জায়গা আছে। সেখানে চালের বস্তা, আলু, পিয়াজ সহ বিভিন্ন জিনিষ রাখা ছিল। মার সাহায্যে অনিক ওইসব জিনিষ সরিয়ে নিজে সেখানে বসে বসে নানান জিনিষি বানায়। ওর মা রান্না করে আর ও বিভিন্ন জিনিষ বানায়। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করেছে কয়েল। যদিও একটু সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। কচুরিপানাগুলো ভেঙে যাচ্ছিলো। ঠিকমত আকৃতি দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন কচুরিপানা মিশ্রণের সাথে ময়দা যোগ করে দেয়। এতে সমস্যা মিটে যায়।
গরম পানির ফ্লাস্ক তৈরি করে ও। বাঁশের ভেতর বড় বোতল ঢুকিয়ে তার চারফাশ ভুসি দিয়ে ফাঁকা জায়গা পূর্ণ করে দেয়। বানাপনোর পর দেখে গরম পানি বেশ কিছুক্ষণ গরম থাকে। ও একটা ফ্যান পর্যন্ত বানিয়ে ফেলছে। কারেন্ট চলে গেলে সেটা ছেড়ে দেয়। ভালোই বাতাস পায়।
ফরিদ স্যার একটা কাগজ বের করলেন। “ তোমরা কে কে বিজ্ঞান মেলায় অংশ গ্রহণ করতে চাও বলো। আমি নাম লিখে নিচ্ছি।” অনিক দেখে ওদের ক্লাসের ফাস্ট বয় মনজুর নাম দিল। ওর দেখাদেখি আরো কয়েকজন নাম দেয়। ওরা নাম বলছে আর স্যার নাম লিখে নিচ্ছেন।
এ সময় অনিক দাঁড়ায়। “ স্যার আমিও নাম দিতে চাই”।
স্যার অনিকের দিকে তাকালেন। স্যারের ভ্রু একটু সংকুচিত হলো। বিরক্ত হলে যেমনটা হয়।
গম্ভীর স্বরে স্যার বললেন- তোমার নাম তো নেয়া যাবে না। তোমার কথা অস্পষ্ট। তুমি বসে পড়ো।
অনিক বসলো। অনেক আশা করে দাঁড়িয়েছিল। এর মধ্যেও কল্পনা করে ফেলেছে বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়ে ফেলছে। ওর প্রজেক্ট সবাই দেখছে। ওর বাবা যিনি কিনা পড়ালেখায় ফাঁকি দিচ্ছে ভেবে এসব কাজ দেখে মাঝে মাঝে বকা দিতেন তিনি বিজ্ঞান মেলায় উপস্থিত হয়ে অপরিচিতের মতো ওর প্রজেক্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। ওর কয়েল সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন- আচ্ছঅ তোমা আবিষ্কৃত এই কয়েলে মশা যাবে তো?
: হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে।
: তাহলে তো অনেক টাকা বেঁচে যাবে। আমারেদ বাসায় আর মশার কয়েল কিনতে হবে না। আর তোমার বানানো এই ফ্লাক্সে কতক্ষণ পানি গরম থাকবে?
: তিন-চার ঘন্টা।
: ভালো, ভালো খুব ভালো।
নিজের অফিসের কলিগদের ছেলের আবিষ্কৃত জিনিষগুলো গর্বের সাথে দেখাচ্ছেন। কত স্বপ্নই না দেখেছিল। অনিক বহু কষ্টে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারা যাচ্ছে না ।ভাগ্য ভালো আজ দেরিতে আসায় একটু কোণার দিকে বসতে হয়েছে। না হলে সবাই দেখে ফেলত।
অনিকের মাথায় ঢুকে না কথার সাথে আবিষ্কারের কি সম্পর্ক। স্যারকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু পাশে জসিম স্যার থাকায় ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে নি। অনিকের কথা অষ্পষ্ট। হালকা তোতলা ধরণের। এটাতো ওর দোষ না। ও তো ইচ্ছে করে এমন হয় নি। আল্লাইতো এভাবে বানিয়েছে। আর ওর কথাগুলো তো সবাই বুঝতে পারে। এখানে সমস্যাটি কি?
পরের দিন যারা নাম দিয়েছে তারা সবাই আলোচনায় ব্যস্ত কে কি প্রজেক্ট বানাবে। অনিক আজ স্কুলে দেরিতে আসেনি। তারপরও সামনের সিট খালি পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে বসে না।
শেষের একটা সিটে গিয়ে বসে। যখন অন্যরা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তখন ওর বুকফাটা কান্না আসে। নাম সম্ভবত চলে গেছে। বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিতে পারবে না এটা ভেবে ওর অনেক কষ্ট হয়। বার বার মনে হয় একটু যদি সুযোগ পাওয়া যেত। যারা অংশ নিচ্চে তারা কত মজা করবে। কতজন ওদের প্রজেক্ট দেখতে আসবে। আর ওর কিনা বাসায় বসে থাকতে হবে ওই দিনগুলোতে। ওদের ক্লাসের ফাস্ট বয় মনজুর ওর পাশে এসে বসে।
: কিরে তুই চুপচাপ কেন? মন খারাপ?
অনিক কথা বলতে পারে না। মুখ বুজে আসে।
মনজুর বলে, তুই মন খারাপ করিস না। তোর নাম নেই তো কি হয়েছে? তুই আমার সাথে থাকবি। মানুষকে প্রজেক্ট দেখাবি। দর্শনার্থীরা প্রশ্ন করলে উত্তর দিবি। সবাই ভাববে তুই ঠিকই বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়েছিস।
ওদের কথাগুলো পাশের বেঞ্চে বসা শারমিন শুনছিল। ওরও খারাপ লাগছিল। অনিক চুপচাপ ধরণের। তাই অন্য ছেলেদের সাথে কথা বললেও অনিকের সাথে কখনো কথা হয়নি। তবে শারমিনের মনে হয় আজই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দুইটা ক্লাস শেষ। এখন ইংরেজী ক্লাস শুরু হবে। একরাম স্যার আসেন। সবাই দাঁড়িয়ে যায়। একরাম স্যার বাংলা নেন, কখনো ইংরেজী নেন না। তাই একরাম স্যার আসায় সবাই একটু অবাক হয়। স্যার চেয়ারে বসেন। বলেন, অনিক তোমার নাম আর রোল নম্বর বলো। বিজ্ঞান মেলায় তোমারও অংশ নিতে হবে।
অনিক দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে ও নাম বলে। বুঝতে পারে না কিভাবে এটা সম্ভব হলো।
খুশি হয়। তবে তার চেয়ে বেশি খুশি হয় শারমিন। একরাম স্যার ওকে বাসায় প্রাইভেট পড়ান। গতকাল রাতে স্যারকে ও অনিকের ব্যাপারটা বলে। স্যার দেখবেন বলছিলেন।
বিজ্ঞান মেলায় অনিকদের স্কুলের জন্য পুরা একটা রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওর সিট হয় একেবারে কোণায় যেহেতু সবার শেষে ওর নাম এসেছে। অনিকের প্রজেক্টের নাম “ ফেলনা জিনিষ থেকে উৎপাদন। জসিম স্যার অনিককে দেখে অবাক হন।
: কি তোমার নাম না দেয়া হয়েছিল না! তুমি আসলা কেমনে?
অনিক চুপ করে শোনে। কোণার দিকে সিট পড়ায় ওর কাছে দর্শনার্থী কম আসে। তবে প্রতিদিন ওর ওখানে শারমিন এসে দেখে যায়। যদিও কথা হয় না। কি কথা হবে! মেয়েদের দিকে অনিক তাকাতেই লজ্জা পায়।
শেষের দিন পুরষ্কার বিতরণী। মঞ্চে বক্তৃতা রাখা হচ্ছে। কেউ বক্তৃতা মনযোগ দিয়ে শুনছে বলে মনে হয় না। কে পুরষ্কার জিতে এটা জানতেই সবাই আগ্রহী।
ফরিদ স্যারের ভ্রু সংকুচিত হয়। তবে এবার বিরক্তির জন্য না। অবাকের কারণে। অনিকের স্কুলের অন্য কেউ পুরষ্কার না জিতলেও অনিক তৃতীয় স্থান লাভ করে স্কুলের মর্যাদা রক্ষা করে। ওর নামের সাথে স্কুলের নাম ঘোষণার সাথে সাথে কোণা থেকে ফরিদ স্যার একরকম কোলে করে তাকে নিয়ে আসেন। তারপর মঞ্চের উপর উঠিয়ে দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে। পুরষ্কারের ভারী বক্সটা ধরে রাখতে কষ্ট হয়।
পরের দিন অ্যাসেম্বলীর সময় অধ্যক্ষ স্যার অনিককে সামনে নিয়ে আসেন। সবার সাতে পরিচয় করিয়ে দেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। সবাইকে অনিকের পুরষ্কারটা দেখান।
অনিকের ক্লাসের মেয়েদের লাইনের একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছিল বেণী ঝুলানো ফুটফুটে মেয়ে শারমিন। ওর ভীষণ খুশী লাগছে। সাথে সাথে অনিকের উপর বিরক্তও লাগছে। ছেলেটা একবারও তাকাচ্ছে না কেন? ও কি কখনোই জানবে না ওকে নেওয়ার জন্য একরাম স্যারকে ওই বলেছিল।