বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অনুভা ও নুবাহ ( গল্প )

রাস্তাঘাট এদিকটায় একটু ভাঙা। গাড়ি একটু পর পর ঝাঁকি খাচ্ছে। আর লাফিয়ে উঠছে। কিছু কিছু গর্ত ভয়ংকর। সেখানে আবার বৃষ্টির পানি জমেছে। গাড়ির চাকা যখন ঐ পানির উপর দিয়ে যায় তখন পানি গুলো ছিটিয়ে পড়ে। পাশে কোন পথচারী থাকলে তাকে ঐ নোংরা পানি জলসিক্ত করে দেয়। ...................


গাড়ি যে দুলছে এতে বড়রা একটু বিরক্ত হলেও বেশ মজা পাচ্ছে ছোট দুই সদস্য। অনুভা আর নুবাহ। গাড়ি লাফায় আর তা দেখে অনুভাও লাফিয়ে উঠে। গাড়ির চেয়ে ওর লম্ফজম্পটা একটু বেশিই হয়। অনুভার মা মানা করে। অনুভা ব্যথা পাবে, এভাবে সিটের মধ্যে লাফালাফি করো না।

কে শুনে কার কথা। বাসার মধ্যে তাও যা একটু কথা শুনে। বাহিরে আসলে পুরা স্বাধীন। কোন কথাই শুনতে চায় না। অনুভার মাও কিছু বলেন না। বেড়াতে এসেছে। থাক মজা করুক।

নুবাহ তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। রাস্তার পাশেই ঘন বন। সেখানে গাছের সারি। বৃষ্টির পানিতে গাছগুলোর পাতা আরো সবুজ হয়েছে। পরিষ্কার হয়ে গেছে। সজীব পাতা। যেন প্রাণবন্ত। দেখতে ভাল লাগছে নুবাহর। মনযোগ সহকারে সেগুলো দেখছে। ওর ইচ্ছা হচ্ছে একটা কবিতা লিখতে। ওদের ক্লাসের মনিহা কবিতা লিখে। গত স্কুল ম্যাগাজিনে মনিহার একটা কবিতাও ছাপানোও হয়েছে। ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপানো হওয়ায় মনিহা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। সবাই ওর প্রশংসা করছে। ওর ভাব দেখলে মনে হয় ও বাংলাদেশের একটা বড় কবি হতে যাচ্ছে। এখন মনিহাকে ভাল লাগে না। আগে নিজে থেকে কথা বলত। এখন অন্য কেউ কথা না বললে নিজে থেকে একটুও কথা বলতে আসে না মনিহা। একটা কবিতা ছাপা হলো বলে এত দাম দেখাতে হবে নাকি?

মনিহার কবিতা ছাপানো হওয়া দেখে নুবাহও কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলেছে। যদিও ব্যাপারটা কেউ জানে না। একটা প্যাডে কবিতা লিখেছে। প্যাডটা লুকিয়ে রাখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। যদি কারো চোখে পড়ে যায়। কারো চোখে যাতে না পড়ে সেজন্য এক এক সময় এক এক জায়গায় লুকায়। লুকাতে গিয়েতো দুইবার হারিয়ে গিয়েছিল। যদিও পরে ভাগ্যক্রমে খুঁজে পেয়েছে। এখনও লিখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু হাতের কাছে কাগজ কলম নেই। বাবাকে বললে বাবা যোগাড় করে দিবে। কিন্তু জেনে যাবে এটাই সমস্যা। তাই চুপচাপ বাহিরের দৃশ্যগুলো দেখছে নুবাহ। সবুজ বৃক্ষ তোমার আমি বন্ধু হতে চাই। এই ধরণের কবিতা ভর করছে ওর মাথায়।

নুবাহ অনুভাকে ডাক দিল। অনুভা সামনের সিটে চলে গিয়েছিল। মায়ের কাছে। -অনুভা ঐ গাছে পাখিটা দেখছো?
অনুভা চোখ বড় করে বাহিরে তাকায়।
-কোন পাখিটা?
-ঐই যে ঠোঁট হলুদ রঙের পাখিটা। কি সুন্দর তাই না?

ওদের কথা যেন পাখিটা শুনে। সেটা উড়ে যায়।

অনুভা বলে, নুবাহ আপু আমাকে একটা পাখি ধরে দেবে?
-তুমি পাখি দিয়ে কি করবে?
-দেখো না টিভিতে, একটা ছোট্ট মেয়ে পাখির সাথে কথা বলে। আমিও পাখির সাথে কথা বলব। পাখিকে আদর করবো। গোসল করিয়ে দিবো।
-তুমিই তো পিচ্চি। তোমাকে সবাই আদর করে। তুমি আবার পাখিকে কি আদর করবে?
-আমি পিচ্চি না। দেখো না আমি বড় হয়ে গিয়েছি। সিটের উপর লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় অনুভা। পায়ের পাতার উপর ভর করে আরো লম্বা হতে চায়। দেখো কত্ত লম্বা আমি।

ওর চেষ্টা দেখে সবাই হেসে উঠে।
-এবার বলো আমাকে পাখি ধরে দিবে কিনা?
-ঠিক আছে পারলে দিবো।

কথা বলতে বলতে অনুভা পিছের সিটে চলে যায়। নুবাহর সাথে বসে।
নুবাহর দুই চুলে বেনী করা। সুন্দর লাগছে। দুইপাশে দুইটা বেনী আছে। তা দেখে অনুভা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা নুবাহ আপু তোমার মত বেণী আমার হয় না কেন?

-তুমি আরেকটু বড় হও। তখন তোমার চুলেও সুন্দর বেণী হবে।

আম্মু আচার খাবো। আমার বমি আসছে। এরিমধ্যে বেশ কয়েকবার আচার খেয়েছে। একসময় অনুভার মা ঘোষণা করলেন আর আচার দেওয়া হবে না। এত আচার খেলে পেট খারাপ করবে।

অনুভার বমি টমি কোন ব্যাপার নয়। আচার খাওয়ার জন্য সে কিছুটা বমির অভিনয় করে। আপু সরো আমাকে জানালার কাছে যেতে দাও। বমি আসছে।

ভাত খাওয়ার সময়ও একই কাজ করে অনুভা। যখন খেতে আর ইচ্ছা করে না। মা বেশি জোর করে। তখন নিজ থেকে বমি করে দেয়।

অনুভা আর নুবাহ আপন বোন না। মন কি আত্মীয়ও না। দুই পরিবার ঘুরতে বের হয়েছে। ব্লগে পরিচয়। নুবাহর বাবা বিদেশ ছিলেন। সময় কাটত না তখন ব্লগে এসে মজা করতেন। তখন থেকেই পরিচয়। পারিবারিক বন্ধুত্ব হয়ে যায়।


দুই ফ্যামিলি ভ্রমণে এসেছে। বন দেখবে। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় রাঙামাটি যাবে। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বান্দরবান গেলে ভাল হয়। সাথে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতও দেখে আসা যাবে। প্রথমে বান্দরবান। নুবাহর আম্মুরও অনেক দিন বান্দরবান আসার ইচ্ছা।

হঠাৎ বৃষ্টি জোরে আসা শুরু করে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ফোটা ঢুকে। -নুবাহ জানালা বন্ধ করে দাও। তোমার ঠান্ডা লাগবে। টনসিল বেড়ে যাবে।
নুবাহর ভাল লাগছিল। জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি আসায়। তার চোখে মুখে ছিটা পড়ছিল। বাবার কথায় জানালা বন্ধ করে দিল। যদিও ইচ্ছা করছিল না একটুও। বাবাকে এত ভাল লাগে। তারপরও মাঝে মাঝে বাবার এরকম কঠিন কিছু কেন বলেন?

নুবাহর অনেক ভাল লাগে বাবাকে। দেশে আসার পর প্রতিদিন বাবা ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে মা সঙ্গী হোন। যেদিন ঘরে কাজ বেশি থাকে মা যান না। নুবাহ যায়। অনেক মজা বাবার সাথে ঘুরতে। কোনটা কি জিজ্ঞেস করলে কি সুন্দর বুঝিয়ে দেন। সামনের বছর নাকি আবার যাবেন। বাবাকে যেতে দিতে ইচ্ছা করে না নুবাহর। কি দরকার বিদেশে থাকার।

গাড়ী এখন অনেক উপরে। সামনের রাস্তাগুলো ভয়ঙ্কর উঁচু। খাড়া বেয়ে উঠে গেছে। দেখলে গা হিম হয়ে যায়। অনুভা দেখছো সামনের রাস্তাগুলো কত উঁচুতে।
অনুভা বিজ্ঞের মত বলে, হুম দেখছি।
-তোমার ভয় করছে না?
-নাহ ভয় করবে কেন? ভয় করলে গাড়ির করবে। আমার ভয় করে না। আমি টিভিতে এর চেয়ে উঁচু রাস্তা দেখেছি।
এই পিচ্চি বলে কি? অবাক হয় নুবাহ।

রাস্তার একদিকে অনেক উঁচু পাহাড়। অন্যদিকে গভীর খাদ। দেখলেই ভয় করে। ঐ খাদের নিচে মেঘ এদিক ঐদিক ঘুরাঘুরি করছে। তার মানে মেঘের অনেক উপরে এখন গাড়িটা।

একটু পর সুন্দর এক দৃশ্যের অবতারণা হয়ে। গাড়ি মেঘের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সামনে অস্পষ্ট কিছুটা। মেঘের জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিছু মেঘ গাড়ির জানালায় আঘাত হানে।

-আব্বু জানালা খুলে দিই? বৃষ্টি তো থেমে গেছে।
-হা খুলে দাও।

খুলে দেওয়ার পর দেখে মেঘ উড়ছে। কিছু মেঘকণা। হাত দিয়ে ধরতে চায়। কিন্তু ধরা পড়ে না। অনেক হালকা কণা মেঘ গুলো। কিছুদূর পরে আবার পরিষ্কার। সব মেঘ যেন কই হারিয়ে গেছে।

মেঘের রাজ্য শেষ। খারাপ লাগে নুবাহর। ইশ মেঘের রাজ্য যদি আরো বড় হতো।
-অনুভা জানালা দিয়ে মেঘ দেখছো?
অনুভা আশ্চর্য হয়।
-নুবাহ আপু, মেঘ তো আকাশের থাকে। এখানে নেমে এলো কিভাবে?
-আমাদের দেখার জন্য মেঘ নেমেছে।

বলে হেসে উঠে নুবাহ। অনুভাও হাসে। অনুভার কয়েকটা দাঁত পড়ে গেছে। ফোকলা দাঁতে যখন হাসে অনেক সুন্দর দেখায়।

এক দীর্ঘ যাত্রার পর ওরা পৌঁছে নীলগীরি। অনেক সুন্দর এক এলাকা। পাহাড়ের উপর। এখানে দুইটা কটেজ আগে থেকে ভাড়া করা হয়েছে।

কটেজগুলোর নামও সুন্দর। মেঘদূত, আকাশ লীনা। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে। দুই পরিবার দুই কটেজে গিয়ে উঠে। বয় তাদের মালপত্র গুলো পৌছিয়ে দেয়।

চারদিকে মেঘের আনাগোণা। মেঘ নিচে নেমে এসেছে মাটিকে ধরবে বলে। মাটি মেঘের ছোয়ায় লাজুক হচ্ছে।

অনুভা আর নুবাহ মেঘের রাজ্যে ছুটাছুটি করছে। দুই হাত ভরে মেঘ ধরার চেষ্টা করছে। যদিও হাতে ঠিক ধরা যাচ্ছে না হালকা জল কণাগুলো। তারপরও একজন আরেকজনকে ছুড়ে দিচ্ছে।

সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট আছে। খাওয়ার জন্য নুবাহ আর অনুভাকে ডাকা হচ্ছে। কিন্তু ওদের সেদিকে খেয়াল নাই। ওরা ব্যস্ত মেঘ ধরায়। মেঘের ভিতর হারিয়ে যেতে নাই মানা।

রাতে ১০ পর্যন্ত জেনারেটর থাকে। এর পর তা বন্ধ হয়ে যায়। কৃত্রিম আলো গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে এখন শুধু চাঁদের আলো। দূরের পাহাড়টাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে অনেক জোরে। বাহিরে খোলা আকাশের নিচে বসে সবাই গল্প করছে। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। বাতাসে পরিধেয় জামা কাপড় উড়াউড়ি করছে। ভাল লাগছে।

অনুভা আর নুবাহ ঘোষণা করল, তাদের এখানে অনেক ভাল লাগছে। তারা কক্সবাজার যাবে না। এখানেই বাকী দুইদিন থাকবে।


( নাহার আপুকে বলেছিলাম অনুভাকে নিয়ে গল্প লিখব। অনুভাকে নিয়ে গল্প লিখব তা অবশ্যই ভাল হতে হবে। ভাল গল্প লিখব এই আশায় ওকে নিয়ে গল্প লেখা হয় নাই। আজ দেখলাম আমার এক মন্তব্যের উত্তরে নাহার আপু বললেন অপেক্ষায় আছেন অনুভাকে শিরোনামে গল্প পাওয়ার। তা দেখা মাত্র লেখা শুরু করলাম। মধ্যখানে বিদ্যুত চলে গেল। থমকে গেলাম। আসার পর আবার শুরু করছি। যা হোক লিখে ফেললাম। পরে সুন্দর গল্প লেখার ইচ্ছা আছে। নুবাহ হচ্ছে আমাদের প্রিয় সাইদ ভাইয়ের মেয়ে।
অনুভা আর নুবাহর অনেক অনেক শুভ কামনা। )