বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

রাত এবং ভালবাসার গল্প (গল্প)

রাত তিনটা। ঘরে থাকলে রাতের ভয়াবহতা তেমন বুঝা যায় না। তবে বাহিরে আসলে বুঝা যায় গভীর রাত কি ভয়ংকর। আসাদ বাহিরে এখন। একটু আগে ঘর থেকে বের হয়েছে। বাসায় গরম লাগছিলো। বাহিরে কিছুটা ঠান্ডা আছে। রাতে সূর্যের তাপ নেই। যে কারণে প্রচন্ড গরম নাই।
আসাদের গন্তব্য নীহাদের বাসা। তিনদিন বাহিরে ছিল। বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার ঘুরে এসেছে। ঘরে আসতে রাত দুইটা বেজে গেছে। রাতে ভাত খেয়েই রওয়ানা দিয়েছে। নীহাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। নীহারা দুইতলায় থাকবে। সেখানে গিয়ে কল দিবে। নীহা ব্যালকনিতে আসবে। সেভাবেই কথা হয়েছে। .......


রাস্তায় লোকজনের চলাচল কমে গেছে। এলাকায় লোডশেডিং চলছে যে কারণে অনেক বাড়ি অন্ধকার। তবে রাস্তার সোডিয়াম লাইট গুলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে বেওয়ারিশ কুকুরের ডাক শুনা যাচ্ছে। দুইটা কুকুর নিজেদের মাঝে গভীর সম্পর্ক করণে লিপ্ত।

আসাদ হেঁটে যায়। রিকসা পেলে ভাল হতো। তাড়াতাড়ি পৌঁছা যেত। কিন্তু দুই একটা রিকসা দেখা গেলেও দেখা যায় সেখানে যাত্রী।

একটা রিকসা ওর পিছন দিয়ে রিং বাজায়। খালি মনে করে ডাকতে যাবে দেখে রিকসায় বসে আরোহী দুইজন। একজন অল্পবয়সী নারী আরেকজন পুরুষ। পুরুষটি মেয়েটিকে বিশ্রী ভাবে জড়ায় ধরে আছে। সোডিয়াম লাইটের আলোতে মেয়েটির মুখ স্পষ্ট। কচি মুখ। বেশি হলে ১২ বছর হবে। এই বয়সেই এ নিষিদ্ধ পথে নামতে হয়ে গেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন পুরুষের মনোরঞ্জন করে টাকা কামাই করে। কি ভয়াবহ জীবন। অনিশ্চিত যাত্রা। আসাদের ইচ্ছা হয় ঐ রিকসা থামাতে। ছেলেটার হাত থেকে মেয়েটা উদ্ধার করতে। তা হয়ত সম্ভব। কিন্তু কয়জন ছেলের হাত থেকে মেয়েটাকে বাঁচানো সম্ভব। কয়জনের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে?

রিকসা চলে যায়। অল্প বয়সী মেয়েটাকে দেখে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। রাতে বের না হলেই ভাল ছিল। কি সমাজ। এতটুকু একটা মেয়ের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আর ছেলেগুলো নোংরা ভাবে মেয়েটাকে নিয়ে খেলে। কিছু কাগুজী টাকা দিয়ে মেয়েটার ইজ্জত কিনে নেয়।

বিকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তার গর্তগুলোতে পানি জমেছে। সোডিয়াম লাইটের আলোতে পানি গুলো অন্যরকম দেখাচ্ছে। আসাদ হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। সামনে পুলিশ দেখা যাচ্ছে। একটু ভয় ভয় করে। কিছু জিজ্ঞেস করলে কি বলবে?

পাঁচজন পুলিশের একটা দল বসে আছে চায়ের দোকানে। খোশ গল্পে ব্যস্ত তারা। রাতের ডিউটি ভালোই উপভোগ করছে। হাতে চায়ের কাপ। অস্ত্রগুলো পাশে রাখা। আসাদ ভয় করছিল পুলিশগুলো ওকে দেখলে ডাকবে। ভয়ই সত্য হলো।

পুলিশের একজন সদস্য ডাক দিল, এই ভাই এদিকে আসেন।

মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে আসাদ পুলিশদের দিকে এলো।

-এত রাতে বাহির হলেন, ব্যাপার কি? কই যান?
আসাদের ভয় ভয় করে। কাচুমাচু হয়ে বলে, বাসায় যাচ্ছি।
-বাসা কোথায়?
-দ্বিতীয় গলিটার পরেই।
-এত রাতে বের হওয়া ঠিক না। বাসায় চলে যান।

আসাদ রওয়া দিচ্ছিলো এসময় যে পুলিশটার মাথায় টাক সে বলল, আপনার মোবাইল আছে?
-জ্বী আছে।
-একটু দেন। কথা বলব।

আসাদ মোবাইলটি বাড়িয়ে দেয়। ওর ভাল লাগে পুলিশগুলো ওকে চেক করে নাই। পকেট হাতড়ে অনেকে চেক করে। ব্যাপারটা অনেক অপছন্দ করে আসাদ। নিজেকে মনে হয় বড় অপরাধী। পুলিশগুলো যে এভাবে চেক করে নাই সেজন্য ধন্যবাদ জানায়।

মোবাইলে কিছুক্ষণ রিং হয়। কানে ধরে থাকে পুলিশটি। বুঝা যায় ঐ প্রান্তে যে আছেন সে ধরে নাই। এত রাতে ঘুমিয়ে থাকা স্বাভাবিক।

আবার ডায়েল নাম্বার থেকে কল দেয়। লাভ হয় না। রিং বেজে চলে। কেউ ধরে না।

আরো কয়েকবার চেষ্টা করে যায়। হয়ত ঐ পাশে রিংটোন অফ করে রাখা হয়েছে।
কল ধরছে না দেখে বিরক্ত হয়ে বলে, ধূর শালা, শুধু ঘুমায়। এতবার কল দিলাম ধরল না।

মোবাইলটি ফেরত দেওয়া হয়। আসাদ মনে মনে খুশী হয় যাকে কল দেওয়া হয়েছে তার প্রতি। ধরে নাই। ব্যালেন্স খরচ হয় নাই। ধরলে কতক্ষণ কথা বলত কে জানে। আসাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সকালে ঐ লোককে এই নাম্বার থেকে কল দেবে। ধন্যবাদ জানাবে। লোকটি অবাক হবে। হলে হোক, সমস্যা নেই। মানুষকে অবাক করার মধ্যে আলাদা মজা।

সামনে আর পুলিশ না পড়লেই হয়। দুই একটা ট্রাক সজোরে চলে যায়। ট্রাকের হেডলাইটের আলোতে সামনের দিক পুরা দিনের আলোর মত আলোকিত হয়। ছোট বেলায় একসময় স্বপ্ন দেখত ট্রাকের ড্রাইভার হবে। ছোটবেলায় ওদের বাসা যেখানে ছিল সেখানের পাশেই ছিল ছোট এক ট্রাক টার্মিনাল। সেখানে ট্রাকের ড্রাইভারদের হেলপাররা খুব সমীহ করে। কি আন্তরিক ভাবে ডাকে ওস্তাদ। যা আনার নির্দেশ দেয় তাই এনে দেয়। অনেক সুখী মনে হতো ড্রাইভারদের। সেজন্য ড্রাইভার হওয়ার ইচ্ছা জাগছিল। এখন মনে পড়ায় একচোট হেসে নেয় আসাদ।

বিদ্যুত চলে এসেছে। চারদিক হঠাৎ একসাথে আলোকিত হয়ে গেল। বিল্ডিংগুলো বাহিরের লাইটগুলো জ্বলছে। কাছাকাছি চলে এসেছে আসাদ। নীহাদের বাড়িটা রাস্তার সাথে। রাস্তায় দাঁড়ালেই দেখা যায়। এটা একটা বিপদ। কেউ যদি দেখে তাহলে খবর আছে। ফোন দেয় নীহাকে।

নীহা বাহির হয়ে আসে বারান্দায়। বারান্দার ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দেয়। সবুজ রঙের আলোয় আলোকিত হয় বারান্দা।
মিস্টি হাসি দেয় আসাদকে দেখে।

আসাদ ও হাসি দেয়।
দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে রাতের নিঃসঙ্গতায়। দুইজনের কানেই মোবাইল।

তুমি এত দিন ছিলা কেন?
-কই এতদিন? তিন দিন ছিলাম। বন্ধুরা চেয়েছিল আরো কিছুদিন থাকতে। আমি বললাম অসম্ভব। চলে আসলাম।
-তিনদিন অনেক। তোমাকে না দেখতে পাওয়ায় অনেক খারাপ লেগেছে। এখন এসেছো দেখে এত্ত যে ভাল লাগছছে ইচ্ছা হচ্ছে নেমে আসতে। কিন্তু বাসায় দরজা খুলতে গেলে টের পাবেন। মামা ড্রয়িং রুমে শুয়েছেন।
- না না আসতে হবে না। তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছা হলো। এজন্য চলে এলাম।
-অনেক ভাল করেছো। কাল বিকালে মৌমিতাদের বাসায় যাব। বিকালে ফ্রি থেকো। ঘুরবো।
-হা ঠিক আছে।

হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যায়। আসাদ হাঁটার ভান করে। ওর পাশ দিয়ে একটা প্রাইভেট কার চলে যায়। তা দেখে নীহা হেসে উঠে।

মোবাইলে হাসির শব্দ শুনে আসাদ বলে, আমি আছি বিপদে আর তুমি হাসছো?
-আরে তোমার হাঁটার অভিনয় দেখে ভাল লাগল। প্রাইভেট কারটি দেখে কি সুন্দর সুবোধ বালকের মত হাঁটা শুরু করলা। তোমাকে দেখে অনেক ভাল লাগছিল। অনেক ইনোসেন্ট মনে হচ্ছিলো।
-হুম, হয়েছে, হয়েছে।
-ঠিক আছে। এখন যাও। সারাদিন জার্নি করেছো। বাসায় গিয়ে ঘুমাও। আম্মু রাতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠতে পারেন। না ঘুমিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি দেখলে খবর আছে।
-যেতে ইচ্ছা করছে না তো। আরো কিছুক্ষণ থাকি।
-সমস্যা হতে পারে। রাস্তায় কেউ দেখলে সমস্যা হবে। এখন যাও।
-ঠিক আছে বাবা যাচ্ছি। হাসি দাও।

নীহা সুন্দর একটা হাসি দেয়।

আসাদ বাসার দিকে রওয়ানা দেয়।
কিছুদূর আসতেই থমকে দাঁড়ায়। পুলিশের দল। ঐ পুলিশগুলো না তো। বুক কেঁপে উঠে।

অন্য পথে চলে যাবে এসময় ঐ পুলিশের একজন দৌড়ে আসে।

-তুমি না বাড়ি যাচ্ছিলে, আবার এখানে কি? তোমার মতলবটা কি বলো তো।

আসাদ আমতা আমতা করে। কিছু বলতে পারে না।
এখন তো কিছু বলতে পারবা না। নিশ্চয় মতলব খারাপ।

-নাহ আসলে...
তোমার এখন কিছু বলতে হবে না। যা বলার থানাতে বলবা।

থানাতে নিয়ে আসা হয় আসাদকে। রাতের শেষ অংশ এখন। আর কিছুক্ষণ পরই সকাল হবে। নতুন দিন আসবে। পুরাতন দিন বিদায় নেবে। নতুন দিনটি হবে আসাদের জন্য একটা কুৎসিত দিন। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মশার কামড়ে ঘুমানো যাচ্ছে না।

সামনে টেবিলে উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশটি। কিছুক্ষণ পর পর গো গো করে নাক ডাকছে। বিরক্তিকর সে নাক ডাকা।

নীহাকে ফোন করে জানালেই হবে। ওর চাচা সচিব। একটা ফোন করলেই হবে। ছেড়ে দিয়ে কূল পাবে না। কিন্তু এখন কল দেয়া যাবে না। এখন কল দিলে নীহা এখনই পুরা ঘর মাথায় তুলবে। সাথে সাথে চাচার ঘুম ভাঙাবে। সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। কি দরকার সুন্দর ঘুম গুলো ভাঙানোর ।

সকালের অপেক্ষায় আছে আসাদ। সকালেই ফোন দিবে। কিন্তু সময়গুলো যেন কাটছে না। সকাল কি হবে না? এত দেরি হচ্ছে কেন?