সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

দ্ধিধা দ্বন্ধ ( গল্প )

শফিক পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নিল। প্যান্টের কিছু অংশ উপরে তুলে দিল। গলির পথটাতে পানি জমছে। একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। নালার পানি বৃষ্টির পানির সাথে একাকার হয়। কালচে দেখায় সে পানি গুলো। সে পানি পার হতে হয়। বাসায় গিয়ে পরিষ্কার করে হাটু পর্যন্ত ধুয়ে ফেলে। । সকালে যাওয়ার সময় মসজিদের পুকুরে পা ভাল ভাবে ধুঁয়ে নেয়। ..................


অন্য জায়গায় বাসা নেওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই তো হবে না। অন্য কোথাও এত অল্প টাকায় মেস পাওয়া যাবে না। তাই এখানে থাকতে হয়। তিনটা টিউশনি করে। সেটা দিয়ে কোন মতে চলে যায়। একটা ছেড়ে দিতে হবে মনে হচ্ছে। মেয়েটা দুর্বল হয়ে পড়ছে।

গেলে দরজা খুলতে দেরি করে। শফিকের অভ্যাস হচ্ছে হাতে চাবির তোড়া নিয়ে খেলা। একবার এই হাতে আরেকবার ঐ হাতে ফেলে। এই যে দরজা খুলতে দেরি হওয়া শফিক বিরক্ত হয় না। কিন্তু যেদিন বুঝছে ইচ্ছা করে দরজা খুলতে দেরি করে তখন বিরক্ত লাগে। ছাত্রীর নাম এষা। নবম শ্রেণীতে পড়ে।

একদিন ওর গণিত খাতা দেখছিল। ঐ সময় এষা বলে, স্যার একটা কথা বলব, মাইন্ড করবেন না তো?
-কি?
-আপনি যে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাবির তোড়া একহাত থেকে অন্যহাতে নিয়ে খেলেন দেখতে অনেক ভাল লাগে।
এটা শুনে আশ্চর্য হয় শফিক। তুমি কিভাবে দেখলে?
-দরজা ছিদ্র আছে না। সে ছিদ্র দিয়ে দেখি।
দরজা গুলো অনেক সুন্দর। চমৎকার নকশা। অনেক পুরু। ঝকঝকে। মনে হয় হাত রাখলে দরজায় ময়লা লেগে যাবে। সেখানে ছোট একটা ছিদ্র আছে। ম্যাগনিফাইং কাঁচ আছে। কে আসছে সে ছিদ্র দিয়ে দেখা যায়।
- তার মানে তুমি ইচ্ছা করে দরজা দেরিতে খুলো?
- একটু দেরি করি আর কি?

-এসব করা ঠিক না। পড়ালেখায় মনযোগ দাও।
-মনযোগ দিয়েছি তো। আগে আমার রোল ছিল ১৭। আপনার কাছে পড়ার পর এই পরীক্ষায় ৯ হয়েছে। মনযোগ দিয়েছি বিধায়ই তো এত আগে আসতে পেরেছি।
- আরো সামনে যেতে হবে। মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার চেষ্টা করো।
- ঠিক আছে করবো। আপনি এত সুন্দর করে পড়ান। অনেক ভাল লাগে। আচ্ছা স্যার, আপনি কথা বলছেন যে নিচের দিকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে কেন? কারো সাথে কথা বললে তার দিকে তাকিয়ে কথা বলা এটা একটা সাধারণ ভদ্রতা।

শফিক বিরক্ত হয়। কি হচ্ছে এসব। কথা কাটাবার জন্য বলে, পরের অঙ্কটা ধরো।
-এইতো শুরু করছি। তার আগে বলেন আজ নতুন জামা পড়ায় আমাকে কেমন লাগছে?
-হুম ভাল লাগছে।
-আরে আপনি তো দেখেনই নাই। ভাল লাগছে বললেন কিভাবে? দেখে বলেন।

শফিক চোখ তুলে তাকায়। হা অনেক সুন্দর একটা মুখ। গোলাপী রঙের জামা পড়েছে। সুন্দর লাগছে। কিন্তু এইটা ওর কাছে জিজ্ঞেস করছে কেন?
এষার টিউশনিটা বাদ দিতে হবে মনে হচ্ছে। পড়ার চেয়ে গল্প করতেই বেশি পছন্দ করে। এখন মাঝে মাঝে ফোন দেয়। স্যার কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি।
-কি বলবা?
- দুপুরের খাবার খেয়েছেন?
- হা খেয়েছি।
- আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করবেন না?
- হা বলো, খেয়েছো?
- নাহ, বাপী আজ সকালে বের হওয়ার সময় বললেন দুপুরে বাহিরে নিয়ে যাবেন। বাহিরে খাবো। আমি প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে ফোনে জানালেন আজ ফিরতে পারছেন না। কি বিরক্ত লাগে চিন্তা করছেন।
- হা তা তো লাগবেই। বাসায় খেয়ে ফেলো।
- নাহ, আজ দুপুরে কিছুই খাবো না। বাপীর সাথে রাগ করছি।
- তোমার আব্বুর সাথে রাগ করলে কেন? উনি হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে আটকা পড়ছেন এজন্য আসতে পারছেন না।
- আপনাকে বলছে। বাপীর কাছে আমি বুঝি কিছুই না। আজ যখন বাপী এসে শুনবে আমি খাইনি তখন অনেক কষ্ট পাবে। পাক কষ্ট। অনেক ভাল হবে।
-ঠিক আছে। আমার একটু কাজ আছে। ফোন রাখতে হবে।
- স্যার আপনি কি আমার সাথে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করছেন? মন খারাপ তো এজন্যই কল দিয়েছি।
- নাহ নাহ বিরক্ত হবো কেন? তবে আমার একটু কাজ আছে। সেজন্যই রাখতে হচ্ছে।
- ঠিক আছে।

ঘরে দেখে কিছুই রান্না হয় নাই। বুয়া আসে নি। ডিম থাকলে তা ভাজি করে খেয়ে ফেলা যেত। কিন্তু ডিমও নাই। এখন ডিম আনতে গেলে আবার নোংরা পানিগুলো পাড়ি দিতে হবে। তাই আর বের হয় না শফিক। চুলায় ভাত চড়িয়ে দেয়। তারপর কাঁচা পেয়াজ কেটে তা দিয়ে খেয়ে ফেলে ভাতগুলো।

বিকালে আবার টিউশনিতে যেতে হবে। চিন্তা করছে সামনের মাস থেকে এশাকে আর পড়াবে না। মেয়েটা অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এটা সম্ভব না। শফিক নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানে। তাই কখনো রঙ্গীন স্বপ্ন দেখে না। আর অল্প বয়সে মেয়েদের এরকম হয়। সেটাকে পাত্তা দেওয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যত পাত্তা দিতে না চায় তত বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে মেয়েটা।

দুপুরে একটা ঘুম দেয়। ঘুমে স্বপ্ন দেখে সে বিমানে। পাইলটের সিটে বসা। বিমান চালাচ্ছে। হঠাৎ সামনে অনেক উচুঁ পাহাড়। বিমানকে অনেক উপরে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে হবে। না হলে পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খাবে। কিন্তু বিমান উপরে উঠছে না। সজোরে পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খায়। সে সময় ঘুম ভেঙে যায়। কি আজগুবী স্বপ্ন। সে পড়ে ইংরেজীতে অনার্স। আর স্বপ্ন দেখছে পাইলট হওয়ার। স্বপ্নগুলোও আজ রসিকতা করে।

উঠে ঘড়ির দিকে তাকায়। আজ এশাকে পাঁচটায় পড়াতে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন ঘড়িতে ৫.৪৫ বেজে গেছে। তাড়াহুড়া করে বের হয়।

অন্যদিন এশা নিজে দরজা খুলে। কিন্তু আজ দেখে কাজের মেয়ে দরজা খুলছে। এশা নাই নাকি?
টেবিলে সামনে বসতেই এশা বলে, স্যার আজ আর পড়বো না।
-কেন? শরীর খারাপ?
-নাহ। আমি সে পাঁচটা থেকে বসে আছি। আর আপনি এসেছেন এখন। পড়ার আগ্রহটাই চলে গেছে।
-তোমার পরীক্ষা সামনে। আগ্রহ আনার চেষ্টা করো।
- লাভ হবে না।
- ঠিক আছে তাহলে। যখন পড়তে ইচ্ছা হয় পড়ে নিও। ফাঁকি দিও না। আমি যাচ্ছি।
- না, না আপনি যাবেন না।
- তুমি পড়বা না, আমি থেকে কি করবো?
- ঠিক আছে পড়বো। আপনার যেতে হবে না।

ইংরেজী একটা প্যারাগ্রাফ লিখে দেয় শফিক। এটা গুরুত্বপূর্ণ। মুখস্ত করতে হবে।
-হুম স্যার। করবো। স্যার সে পাঁচটা থেকে আমি বসে আছি। অথচ আপনার আসার নাম নেই। আপনার মোবাইলে ফোন দিয়েছি। কিন্তু দেখি সেটা বন্ধ।
- ঘুম গিয়েছিলাম। এজন্য আসতে দেরি হয়ে গেছে। আর মোবাইলটা ডিস্টার্ব করছে। ব্যাটারীর চার্জ থাকে না।
- স্যার আমার একটা অনুরোধ রাখবেন।
- বলো।
- আগে বলেন রাখবেন কিনা?
- বলো, রাখার মত হলে রাখবো।
- আমার বাবা আমাকে একেবারে নতুন একটা মোবাইল দিয়েছে। সেখানে কম্পিউটারের সব কাজ করা যায়। আমি সেটা আপনাকে দিতে চাই। আমারতো আছেই মোবাইল। প্লিজ না করবেন না।
- শুনো এষা, আমি তোমাকে পড়াতে এসেছি। তার বিনিময়ে সেলারি পাই। এর বেশি আমি নিবো না। তোমার বাবা তোমাকে মোবাইল দিয়েছে সেটা তোমার কাছেই রাখো। আমাকে কেন দিবা।
- স্যার আপনাকে অনেক ভাল লাগে আমার। এই আব্দারটা রাখেন প্লিজ।
-এরকম আর কক্ষণো বলবা না। আমি এগুলো শুনার জন্য এখানে আসি না। তোমাকে পড়াতে আসি। সেটাই শুধু আমার কাজ।
শফিকের কথার মধ্যে কি যেন ছিল। কথাটা শুনে এষার মুখ কালো হয়ে যায়। অনেক কষ্টে কান্না সামলাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। শেষে দৌড় মেরে উঠে চলে যায় অন্য রুমে।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর যখন দেখে এশা আর আসছে না তখন ফিরে যায় শফিক। এগুলো প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধান্ত নেয় এষাকে আর পড়াতে আসবে না। তাতে সামনের মাস কষ্ট হবে। হলে হোক। এগুলো মেনে নেওয়া যায় না।

পরের দিন যায় নি দেখে এষা ফোন দেয়, স্যার আসেন নি যে, আমি খুব দুঃখিত আপনাকে না বলে অন্য রুমে চলে গিয়েছিলাম। কেন জানি আপনার কথায় অনেক খারাপ লেগেছে।
-এশা শুনো। আমি আর তোমাকে পড়াতে আসবো না।
-স্যার এটা কি বলছেন? কেন? আমার কি দোষ? আমার কোন আচরণে কষ্ট পেয়েছেন?
-নাহ, আসলে আমার সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তো। সেজন্য।
-স্যার হবে না। আপনাকে আসতেই হবে।
এর মধ্যে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যায়।

কয়েকদিন ধরে খুব ঘুরাঘুরি করে শফিক নতুন আরেকটা টিউশনির জন্য। পেয়েও যায়। তবে একটু দূরে। কথা হয় সামনের মাসের প্রথম তারিখ থেকে পড়াবে।

.............................
সকালে ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠছে আজ। কাপড় কচলাচ্ছিলো। এসময় দরজায় নক। শফিক সাহেব আছেন?
ভদ্র গলা। একটু অবাক হয় শফিক। তাকে সাহেব বলবে কে?

দরজা খুলে। দেখে স্মার্ট চেহারার এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় টাই। এই পরিবেশে ঠিক মানাচ্ছে না। এসি রুমে কাজ করে এরকম মনে হচ্ছে।

কিন্তু একে তো কখনো দেখছে বলে মনে পড়ে না শফিকের। নাম জানলো কিভাবে।
আমি শফিক, কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম।
-আপনিই তাহলে শফিক। থাক শেষ পর্যন্ত পেলাম। অনেক জায়গায় খুঁজার পর পেয়েছি। শুধু বলা হয়েছে আপনি এই এলাকায় থাকেন। পাশে বাচ্চাদের একটা স্কুল আছে। অনেক গুলো মেস দেখার পর এই মেসে আপনাকে পেলাম।
-কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
- আমাকে চিনবেন না। লতিফ স্যার পাঠিয়েছেন। আপনি এষাকে পড়াতেন না?

-হুম পড়াতাম। কিন্তু এখন পড়াই না।
- স্যার আপনাকে যেতে বলেছে। আপনার সাথে কথা বলবেন। এখন কি সময় হবে আপনার?

আবার নোংরা পানি পাড়ি দিতে হয়। আমার জন্য আপনাকে নোংরা পানি পাড়ি দিতে হচ্ছে। খারাপ লাগছে। আমাকে বললেই হতো। আমি গিয়ে দেখা করে আসতাম। কষ্ট করে আসতে হতো না।
-নাহ নাহ সমস্যা নেই।

লতিফ সাহেবের সামনে চেয়ারে গিয়ে বসল শফিক।
-বসেন। আমি কিছু বলব। মধ্যখানে আপনি কোন কথা বলবেন না। আমি কোন ভূমিকায় যাচ্ছি না। এষাকে আপনি পড়াতেন। ভালই পড়াতেন। যে কারণে ওর পরীক্ষার ফলাফল আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। এষার মা মারা যাওয়ার পর আমি শুধু মেয়ের দিকে চেয়ে আর বিয়ে করি নাই। যদি এশার কষ্ট হয়। মা মরা মেয়েটা অনেক বেশি অভিমানী হয়েছে। আমি জানি আপনি কেন পড়াতে আসছেন না। বুঝেছি। আপনাকে আমি সম্মান করি।
এষা গত কয়েকদিন ধরে খানাদানায় অনেক অনিয়ম করছে। ঠিক মত খাচ্ছে না। এমন কি স্কুলেও যাচ্ছে না। এখন আমি কি করতে পারি আপনি একটা সাজেসন্স দিলে ভাল হয়।

-ওর জন্য অন্য স্যার ঠিক করেন নি।
-করতে চেয়েছিলাম। ও বলেছে অন্য স্যার ঠিক করলে পড়ালেখায় ছেড়ে দিবে। স্যার ছাড়াই পড়বে। আচ্ছা আমার মেয়েকে যদি আপনি আগের মত পড়িয়ে যান তাতে আপনার কি বেশি ক্ষতি হবে?

শফিক কথা বলতে পারে না। কি অবাক পৃথিবী। এই লোক অনেক শিল্প কারখানার মালিক। জাহাজই আছে পাঁচটা। আর উনিই কিনা এভাবে অনুনয় করে বলছেন ওর মত চালচুলাহীন একটা ছেলেকে। কিন্তু পড়ালে কি লাভ হবে। মেয়েটা আরো বেশি ঝুঁকে পড়বে। এটা তো ক্ষতি। এই বয়সের আবেগ ভাল না। এশাকে অনেক পছন্দ করে শফিক। পড়ানো মানে এই আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া। যা এশার জন্য মোটেই ভাল হবে না। কি করবে বুঝতে পারে না শফিক। দ্ধিধায় পড়ে গেছে ও।

লতিফ সাহেব চেয়ে আছেন শফিকের দিকে। কি উত্তর দেয় ও। মা মরা মেয়েটাকে নিয়ে অনেক বেশি টেনশনে আছেন তিনি।