সকাল গুলো এখন শেষ হতে চায় না। মনে হয় এক একটি সকাল দীর্ঘ। অনেক বেশি সময়।
গোয়ালের গরুর দেখে আসা ব্যাপারটা আমার রুটিনে ছিল না কখনো। কিন্তু এখন যোগ
হয়েছে। আরো বেশ কিছু যোগ হয়েছে। হয়ত আরো অনেক হবে। সেদিন আমাকে বাজার থেকে
জিনিষ আনতে পাঠানো হলো সন্ধ্যার সময়। অথচ এই সময়ে বাহিরে যাওয়া আমার মত
বয়সী একটা মেয়ের জন্য ঠিক মানায় না।.......
তারপরও যেতে হয়। আমিও যাই। কোন কিছু না করি না। না করার ক্ষমতাটুকুই আমি হয়ত হারিয়ে ফেলেছি। এক সময় মা অনেক বলতেন, পড়তে। কিন্তু আমার মন পড়ালেখায় ছিল না। সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়িতে থাকতাম। পাড়ার মেয়েদের সাথে বউ ছি খেলতাম। আম্মু বকা দিতেন। “এরকম টো টো করলে তো পরীক্ষায় ফেল মারবি, একটু পড়াশোনা কর। ”
ছোটবেলায় আমাকে ভর্তি করানো হয় নাম করা এক বেসরকারি স্কুলে। স্যাররা অনেক যতœ নিতেন। বাসায় না পড়লেও খারাপ হতো না পরীক্ষা। স্কুল ড্রেস ছিল সুবজ রঙের। স্কুল থেকে এসে আর স্কুল ড্রেস খুলতে ইচ্ছা হতো না। সেটা পড়ে থাকতাম। আম্মুর বার বার তাড়া। “ আরে এখনো স্কুল ড্রেস পড়ে আছিস, তুই যে স্কুলে পড়িস এটা তো আমরা জানি, ড্রেস পাল্টিয়ে আয়।” আলসেমীর কারণে ইচ্ছা করত না।
আর এখন স্কুল থেকে এসেই লেগে যেত হয় কাজে। সীমা, নাহার, ফরিদারা বিকালে মাঠে অন্যদের খেলা দেখে এখনো। আর আমি ঘর ঝাড়– দিই সেসময়। ওরা আমার অনেক প্রিয় বান্ধবী ছিল। কত্ত মজা করে খেলতাম। এখন আর ওদের সাথে কথা বলি না। নিজের কষ্ট গুলো অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। থাক না নিজের কষ্ট নিজের মাঝে।
কেউ এখন পড়তে বলে না। তারপরও আমি পড়ি। রাত জেগে পড়ি। মশার কামড়ে দাগ হয়ে যায় হাত-পা। সেদিকে আমার খেয়াল থাকে না। আমি অনবরত পড়ে যাই। আগে জোরে পড়তাম। একটু থামলেই মা জিজ্ঞেস করতেন, কিরে তোর পড়া থেমে গেল কেন?
আর এখন পড়ালেখার অভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। আস্তে আস্তে পড়ি। অনেক ফিসফিসিয়ে টাইপের। যাতে ঘরের অন্য কারো ঘুম নষ্ট না হয়।
ভাগ্যিস আমি একটা সন্তানই ছিলাম মা-র । আমার ভাই বোন থাকলে তাকেও আমার মত কষ্ট করতে হতো। আমি মা-র কাছে আব্দার ধরতাম, মা আমাকে একটা ছোট ভাই অথবা বোন এনে দাও। ফরিদার কি মজা ছোট ভাই আছে। খেলে। আমি খেলতে পারি না।
মা আমার কথায় হাসতেন। আমার প্রতি যত্ন বেশি নিতে পারার জন্য মা আর সন্তান নেননি। হয়ত পরে নিতেন। আরো কিছু সময় পর। না নিয়ে ভালোই করেছেন। থাকলে অনেক বেড়ে যেত কষ্ট। ওকেও একই রকম নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হতো। নিজের কষ্ট সহ্য করা যায়। কিন্তু আপন ভাই-বোন কষ্ট পাচ্ছে তা সহ্য করা কষ্টকর।
আমার মাথায় কিছু জিদ চাপছে। সব বুজে চলেও দেখিয়ে দেওয়া। কিন্তু কিভাবে দেখিয়ে দেবো সেটাই মাথায় ঢুকে না।
বাবার সাথে এখন তেমন কথা হয় না। যার সম্পর্কে এত সমালোচনা শুনেন তার সাথে কথা বলা একটু কষ্টকরই বটে। বাবারও কষ্ট হয়। তার মেয়ে এরকম হলো কেন? বাবা চাকরি করেন দূর এক শহরে। সপ্তাহে সপ্তাহে আসেন। নতুন মা বাবাকে বুঝান আমি কতটা খারাপ। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক কথা বলেন। তবে আমি প্রতিবাদ করি না। কথা দিয়ে কোন প্রতিবাদ করি না আমি। সব নিরবে শুনে যাই। বাবার মুখ দেখে মনে হয় বাবা সব কথাই বিশ্বাস করছেন।
বাবা-রা এত সহজে এত পর হয়ে যান কিভাবে?
পড়ালেখা করে কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তুু সেখানেও বাধা। এত বড় মেয়ে ঘরে রাখা ঠিক না। বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। চেহারা সুন্দর। কখন কি না কি হয়। এরকম বিভিন্ন কিছু বুঝিয়ে আমার বিয়ে দেওয়া হয়। যাতে আর পড়তে না পারি।
বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো কাশেমের সাথে। আধা পাগল একটা ছেলে। বাবার সম্পত্তি আছে। তবে ছেলের কোন হুশ নেই। রাত দুইটায় চালের উপর বসে থাকে। অনেক জোর করে আনতে হয় ঘরে।
দুঃখ একবার শুরু হলে তা বোধ হয় পিছু ছাড়ে না। আমারেও ছাড়ছে না।
..............................................০২........................
আগের ঘরে সৎ মায়ের অত্যাচার। বিয়ের পর জামাইয়ের পাগলামী। তারপরও কিভাবে যেন আমি অন্য হয়ে গেলাম। কালো গাউন পড়ে এখন আদালত পাড়ায় আমার অবাধ পদাচরণ। দেশের মানুষ মোটামুটি ভাবে জানে আমার নাম। অনেক বড় বড় মামলায় আইনজীবি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। আছি একটা বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে।
এগুলো সম্ভব হয়েছে আমার শ্বাশুড়ির কারণে। মায়ের বাড়ীতে কাজ করতে করতে কাজ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। শ্বশুর বাড়ীতেও কাজ করতে চাইতাম। কিন্তু শ্বাশুড়ী দিতেন না। “ মা, তোমার কষ্ট আমি বুঝি, তোমার কাজ করার দরকার নেই, অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকতে হবে তোমাকে, আমি তোমার শ্বশুর কে বলে কয়ে রাজি করিয়েছি। তুমি মেট্রিকটা দিয়ে দাও। পারবা না?
চোখে পানি এসে গিয়েছিল। “ মা অন্যরা কি ভাববে? বাড়ীর বউ বাহিরে পড়ালেখা করে, নানা জনে কথা রটাবে।”
“মুখ থাকলে কথা বলবেই, তা ভয় পেতে হবে নাকি? আর তোমার যে একটা পাগলের সাথে সংসার করতে হচ্ছে সে কষ্ট কি অন্যরা নিচ্ছে, সব কষ্ট তো তোমার একারই। তুমি রাজি হয়ে যাও। আমি জানি তুমি ভাল করবে পরীক্ষায়। ”
একটা পাগলের সাথে বিয়েও যে জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায় সেদিন বুঝলাম।
বিদেশে ডাক্তার দেখানো হয়েছে অনেক। কিন্তু লাভ হয় নি। কাশেমের পাগলামী কিছুটা বেড়েছে এখন।
আমার মেয়ে সুদীপ্তা। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বাবার পাগলামী দেখে আমাকে প্রশ্ন করে, মা বাবা এরকম করে কেন?
অন্যদের বাবারা তো এরকম করে না।
কিছু বলতে পারি না মেয়েকে। তবে বলতে ইচ্ছা করে তোর বাবা তো একই আছে। আমার বাবা তো পুরাই বদলে গিয়েছিলেন।
তারপরও যেতে হয়। আমিও যাই। কোন কিছু না করি না। না করার ক্ষমতাটুকুই আমি হয়ত হারিয়ে ফেলেছি। এক সময় মা অনেক বলতেন, পড়তে। কিন্তু আমার মন পড়ালেখায় ছিল না। সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়িতে থাকতাম। পাড়ার মেয়েদের সাথে বউ ছি খেলতাম। আম্মু বকা দিতেন। “এরকম টো টো করলে তো পরীক্ষায় ফেল মারবি, একটু পড়াশোনা কর। ”
ছোটবেলায় আমাকে ভর্তি করানো হয় নাম করা এক বেসরকারি স্কুলে। স্যাররা অনেক যতœ নিতেন। বাসায় না পড়লেও খারাপ হতো না পরীক্ষা। স্কুল ড্রেস ছিল সুবজ রঙের। স্কুল থেকে এসে আর স্কুল ড্রেস খুলতে ইচ্ছা হতো না। সেটা পড়ে থাকতাম। আম্মুর বার বার তাড়া। “ আরে এখনো স্কুল ড্রেস পড়ে আছিস, তুই যে স্কুলে পড়িস এটা তো আমরা জানি, ড্রেস পাল্টিয়ে আয়।” আলসেমীর কারণে ইচ্ছা করত না।
আর এখন স্কুল থেকে এসেই লেগে যেত হয় কাজে। সীমা, নাহার, ফরিদারা বিকালে মাঠে অন্যদের খেলা দেখে এখনো। আর আমি ঘর ঝাড়– দিই সেসময়। ওরা আমার অনেক প্রিয় বান্ধবী ছিল। কত্ত মজা করে খেলতাম। এখন আর ওদের সাথে কথা বলি না। নিজের কষ্ট গুলো অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। থাক না নিজের কষ্ট নিজের মাঝে।
কেউ এখন পড়তে বলে না। তারপরও আমি পড়ি। রাত জেগে পড়ি। মশার কামড়ে দাগ হয়ে যায় হাত-পা। সেদিকে আমার খেয়াল থাকে না। আমি অনবরত পড়ে যাই। আগে জোরে পড়তাম। একটু থামলেই মা জিজ্ঞেস করতেন, কিরে তোর পড়া থেমে গেল কেন?
আর এখন পড়ালেখার অভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। আস্তে আস্তে পড়ি। অনেক ফিসফিসিয়ে টাইপের। যাতে ঘরের অন্য কারো ঘুম নষ্ট না হয়।
ভাগ্যিস আমি একটা সন্তানই ছিলাম মা-র । আমার ভাই বোন থাকলে তাকেও আমার মত কষ্ট করতে হতো। আমি মা-র কাছে আব্দার ধরতাম, মা আমাকে একটা ছোট ভাই অথবা বোন এনে দাও। ফরিদার কি মজা ছোট ভাই আছে। খেলে। আমি খেলতে পারি না।
মা আমার কথায় হাসতেন। আমার প্রতি যত্ন বেশি নিতে পারার জন্য মা আর সন্তান নেননি। হয়ত পরে নিতেন। আরো কিছু সময় পর। না নিয়ে ভালোই করেছেন। থাকলে অনেক বেড়ে যেত কষ্ট। ওকেও একই রকম নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হতো। নিজের কষ্ট সহ্য করা যায়। কিন্তু আপন ভাই-বোন কষ্ট পাচ্ছে তা সহ্য করা কষ্টকর।
আমার মাথায় কিছু জিদ চাপছে। সব বুজে চলেও দেখিয়ে দেওয়া। কিন্তু কিভাবে দেখিয়ে দেবো সেটাই মাথায় ঢুকে না।
বাবার সাথে এখন তেমন কথা হয় না। যার সম্পর্কে এত সমালোচনা শুনেন তার সাথে কথা বলা একটু কষ্টকরই বটে। বাবারও কষ্ট হয়। তার মেয়ে এরকম হলো কেন? বাবা চাকরি করেন দূর এক শহরে। সপ্তাহে সপ্তাহে আসেন। নতুন মা বাবাকে বুঝান আমি কতটা খারাপ। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক কথা বলেন। তবে আমি প্রতিবাদ করি না। কথা দিয়ে কোন প্রতিবাদ করি না আমি। সব নিরবে শুনে যাই। বাবার মুখ দেখে মনে হয় বাবা সব কথাই বিশ্বাস করছেন।
বাবা-রা এত সহজে এত পর হয়ে যান কিভাবে?
পড়ালেখা করে কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তুু সেখানেও বাধা। এত বড় মেয়ে ঘরে রাখা ঠিক না। বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। চেহারা সুন্দর। কখন কি না কি হয়। এরকম বিভিন্ন কিছু বুঝিয়ে আমার বিয়ে দেওয়া হয়। যাতে আর পড়তে না পারি।
বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো কাশেমের সাথে। আধা পাগল একটা ছেলে। বাবার সম্পত্তি আছে। তবে ছেলের কোন হুশ নেই। রাত দুইটায় চালের উপর বসে থাকে। অনেক জোর করে আনতে হয় ঘরে।
দুঃখ একবার শুরু হলে তা বোধ হয় পিছু ছাড়ে না। আমারেও ছাড়ছে না।
..............................................০২........................
আগের ঘরে সৎ মায়ের অত্যাচার। বিয়ের পর জামাইয়ের পাগলামী। তারপরও কিভাবে যেন আমি অন্য হয়ে গেলাম। কালো গাউন পড়ে এখন আদালত পাড়ায় আমার অবাধ পদাচরণ। দেশের মানুষ মোটামুটি ভাবে জানে আমার নাম। অনেক বড় বড় মামলায় আইনজীবি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি। আছি একটা বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসাবে।
এগুলো সম্ভব হয়েছে আমার শ্বাশুড়ির কারণে। মায়ের বাড়ীতে কাজ করতে করতে কাজ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। শ্বশুর বাড়ীতেও কাজ করতে চাইতাম। কিন্তু শ্বাশুড়ী দিতেন না। “ মা, তোমার কষ্ট আমি বুঝি, তোমার কাজ করার দরকার নেই, অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকতে হবে তোমাকে, আমি তোমার শ্বশুর কে বলে কয়ে রাজি করিয়েছি। তুমি মেট্রিকটা দিয়ে দাও। পারবা না?
চোখে পানি এসে গিয়েছিল। “ মা অন্যরা কি ভাববে? বাড়ীর বউ বাহিরে পড়ালেখা করে, নানা জনে কথা রটাবে।”
“মুখ থাকলে কথা বলবেই, তা ভয় পেতে হবে নাকি? আর তোমার যে একটা পাগলের সাথে সংসার করতে হচ্ছে সে কষ্ট কি অন্যরা নিচ্ছে, সব কষ্ট তো তোমার একারই। তুমি রাজি হয়ে যাও। আমি জানি তুমি ভাল করবে পরীক্ষায়। ”
একটা পাগলের সাথে বিয়েও যে জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায় সেদিন বুঝলাম।
বিদেশে ডাক্তার দেখানো হয়েছে অনেক। কিন্তু লাভ হয় নি। কাশেমের পাগলামী কিছুটা বেড়েছে এখন।
আমার মেয়ে সুদীপ্তা। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বাবার পাগলামী দেখে আমাকে প্রশ্ন করে, মা বাবা এরকম করে কেন?
অন্যদের বাবারা তো এরকম করে না।
কিছু বলতে পারি না মেয়েকে। তবে বলতে ইচ্ছা করে তোর বাবা তো একই আছে। আমার বাবা তো পুরাই বদলে গিয়েছিলেন।