সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

শান্তিকানন আর নেই (গল্প)

ঋতু খাটের এককোণায় বসে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। এরই মধ্যে ওর মা ফিরোজা বেগম ভাত খেতে ডাকলেন। ঋতু কোন সাড়া দিলো না। মা এসে বোঝালেন : ভাগ্য যা ছিলো তা হয়েছে। মন খারাপ করিসনে। আয় অল্প একটু খেয়ে নেয়। এবার টাকা জমিয়ে অন্য কোথাও জায়গা কিনব। সেখানে বাগানের জন্য অনেক বড় জায়গা রাখা হবে। তুই তোর ইচ্ছে মতো সব গাছ লাগাতে পারবি। আয় মা খেতে আয়। ভাত ঠান্ডা হয়ে গেল।....


ঋতু পিচ্ছি খোকা নয়। ও এবার জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। মায়ের কথা যে শুধুই স্বান্তনা, তা যে রাখা সম্ভব নয় তা ও বেশ ভালো ভাবেই জানে। এই জায়গাটা পেতে অনেক ঝামেলা হয়েছে। আবার নতুন জায়গা।

রুমের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ইট-সিমেন্টের কণা পড়ে আছে। ফিরোজা বেগম পরিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। ঋতু করতে দেয় নি- থাক মা। পরে করো। মেয়ের মানসিক অবস্থা দেখে ফিরোজা বেগম রুম পরিষ্কার না করেই বের হয়ে গেলেন।

খাটের পাশ দিয়ে তিনটা টব রাখা। ভীষণ বেমানান লাগছে। সকালেও এগুলো বারান্দার গ্রিলে লটকানো ছিলো। বাহির থেকে কেউ আসলে বলত - বারান্দায় টব গুলো চমৎকার মানিয়েছেতো। বিকেল বেলায় ঋতু টব গুলোতে পানি দিত। গ্রিলের ফাঁকে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত অদ্ভূত সব কল্পনা করত। তবে চোখে অবশ্যই চশমা থাকতে হতো। চশমা ছাড়া ও সবকিছুই ঝাপসা দেখে। একবার চশমার একটা লেন্স ভেঙে যাওয়ায় সেকি দুরাবস্থা ওর। আকাশের দিকে তাকায়। অথচ সবকিছুই মনে হয় ঘোলা। কেমন এলোমেলো লাগে। বাবাকে বলে সেদিনই চশমা ঠিক করে আনিয়েছিলো।
বাড়ির সামনে যে অল্প জায়গা আছে সেখানে ঋতু বাগান করে। বাগানটার একটা নামও দিয়ে দেয় ও – শান্তি কানন। বিভিন্ন ফুল গাছ লাগায় ও সেখানে। গাধাঁ ফুলটাই বেশি। গোলাপ লাগানো হলেও সেখানে কোন ফুল ধরেনি। ওর ইচ্ছে ছিলো সামনে বৃক্ষ মেলা এলে ভালো গোলাপ চারা কিনবে। মাঝে মাঝে লতিফ সাহেবও বাগানে মেয়েকে সাহায্য করতেন। তার একটিই মেয়ে। মেয়েকে খুউব খুউব ভালবাসেন। যদি ও আর্থিক অসমর্থতার জন্য অনেক কিছু ইচ্ছে করলেও দিতে পারেন না। প্রকাশ পায় না বিপুল ভালবাসা। তিনি মাঝে মাঝে চিন্তা করেন মেয়েটি এত ভাল কেন হলো। মেয়েটি কখনো এমন কোন আব্দার করে না যা তার মত কেরাণি মানুষের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। এই বয়সী মেয়েদের কত চাহিদা থাকে। কত কিছু কিনতে চায় তারা। মেয়ের ফুলের প্রতি এত আগ্রহ দেখে তিনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেন এবার বৃক্ষ মেলা এলেই মেয়েকে অনেক চারা কিনে দেবেন। এজন্য তিনি কিছু টাকা আলাদা করে রাখছেন। টাকা জমানোর জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি অফিসে সকালের নাস্তা খান না।


ঋতুর প্রিয় বারান্দাটা আর নেই। সেটি সরকারী জায়গার মধ্যে পড়েছে এই ছোট্ট কথা বলে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সামনের বাগানটা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীন সদস্যদের বুটের জুতার আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে। কোন প্রাকৃতিক কারণ নয় চোখের সামনে ঘর ভাঙা বাহিনী তা ভাঙল অথচ কেউ এতটুকু প্রতিবাদ করতে পারল না। যখন ভাঙা শুরু করে তখন ঋতু ভিতরের রুমে চলে আসে। ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। সারা পৃথিবীটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসে। ঋতু ভাবে ও তো ভাঙছে না। ভাঙছে ঐই পোষাকী বাহিনী। তাহলে ওর শরীর ওকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছে কেন।

মাথাটা একটু ঠিক হলে ঋতু ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে রাখে। চোখ ফেলে বাগানটার উপর। খালি চোখে ও বুঝতে পারে না বাগানটা আছে কি নাই। চশমাহীন চোখে দেখে মনে মনে জোর করে ভাবার চেষ্টা করে বাগানটা ঠিক আছে। আগের মতই আছে সব।
বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ও। বারান্দা কিংবা বাগানের দিকে তাকানোর সময় ও জীবনে আর কক্ষণো চশমা ব্যবহার করবে না। ওর সুপ্ত বাসনা ছিল ল্যাসিক অপারেশন করে চশমা থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু ঠিক করে এখন যেমন আছে, তেমনই থাকবে। কোন অপারেশন করবে না।

আরেকটা ছোট সিদ্ধান্তও নেয়..................................................... কক্ষণো যাবে না।

{জরুরী অবস্থা সময় যখন অবাধে ঘর ভাঙা হচ্ছিলো তখন লেখা,. }