দেশটা অনেক সুন্দর। অনেক বেশি সুন্দর। ঢাকা শহরের যানযটকে আগে খারাপ লাগত।
এতক্ষণ ধরে ইঞ্জিনের গো গো শব্দ শুনতে শুনতে গাড়ির স্থিরতা। আর সামনের দিকে
চেয়ে থাকা কখন ছুটবে এই যট। কখনো যটে ঘন্টা পার হয়ে যেত। জানালা দিয়ে
ভিক্ষুকের উৎপাত। অনেক বিরক্ত লাগত। এই ভিক্ষুকদের কারণে জানালা খোলা রাখা
যেত না। খোলা রাখলেই গাড়ির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ভিক্ষা খুঁজবে। জানালা
খুলে দিতে ভীষণ ইচ্ছা হতো। কিন্তু ভিক্ষুকের ভয়ে তা বেশির ভাগ সময়ই করা যেত
না। তারপরও মাঝে মাঝে খোলা রাখত। ভিক্ষুক এলে ধমক দিয়ে বসত। সিগনালের
ভিক্ষুক গুলোকে কখনো কখনো ভিক্ষুক মনে হতো না, মনে হতো পেশাদার শ্রমিক।
মানুষের আবেগ ব্ল্যাক মেইল করছে এরা। ................
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঐ ভিক্ষুকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত হয় নাই। উচিত হয় নাই ঐ ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে চরম ধমক দেওয়া। কি মায়াবী মুখ। এই অল্প বয়সেই জীবিকার খাতিরে পথে এসেছে। “ স্যার ফুল নেন, ফুল, ভাবীকে দিবেন। ভাবী অনেক খুশী হবে।”
ভাবীর কথা শুনেই সেদিন মেজাজটা চড়ে উঠেছিল।
“ ওই তোর ফুলের গোষ্ঠী কিলাই। সর গাড়ির সামনে থেকে। গাড়ীতে যে রেখেছিস তোর হাতের ময়লা গাড়ীতে লাগছে, এক্ষুনি সর।”
-ফুল নেবেন না, ভালা কথা। আমারে গালি দেন ক্যান?
“ ওমা এই মেয়ে দেখি মুখে মুখে কথা বলে, তোর তো সাহস অনেক। ফুল বিক্রী করে খাস। এত তেজ কেন তোর?”
-ফুল বিক্রী করি বিধায় কি আমরা মানুষ না। না নিলে কইয়া দিলেই হয় নেবেন না। তা ফুলের গোষ্ঠী কিলান ক্যান?
আসলে তো ফুল বিক্রী করে যারা তারা কি মানুষ না? কিন্তু সেগুলো তো ভাবার মাথা নেই। ভাবীর কথা শুনে ওর গা জ্বলে উঠে। কত ভালবেসে বিয়ে করেছিল। অথচ সেই মেয়ে অন্য একজনে সাথে চলে গেল। কি বিশ্রী ব্যাপার। এতটুকু কিছু বুঝতে দিল না। পৃথিবীর সকল মেয়ের প্রতি সেই থেকে বিতৃষ্ণা জমে গেল। প্রতিষ্ঠানে সে সবার চেয়ে বেশি অবিশ্বাস করে তার মেয়ে কর্মচারীদের। অথচ ওরাই সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তারপরও বিশ্বাস করতে পারে না। একটি মেয়ে ওর বিশ্বাসটাকেই কঠিন ভাবে নাড়িয়ে দিল।
হাত বের করে কড়াস করে একটা থাপ্পর দিয়ে বসে। হয়ত আরো কিছু করত। কিন্তু সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায় গাড়ি চলা শুরু করে। মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গাড়িটির দিকে। এতক্ষণ কথায় তেজ ছিল। মুখে প্রতিবাদের একটা ভাব ছিল। এখন মুখটা অনেক বেশি শান্ত। এরকম থাপ্পড় খাবে চিন্তাও করে নাই। গাড়ির ব্যাক মিরর দিয়ে কিছুক্ষণ দেখা যায় মেয়েটাকে। তাকিয়ে আছে। কি মায়াবী মুখ। অথচ তারপরও অসহ্য লাগছে। একটুও খারাপ লাগে নি তখন আসলামের।
তবে এখন যখন সে মেয়েটার কথা মনে পড়ছে অনেক বেশি খারাপ লাগছে। মেয়েটা অনেক বড় হয়েছে। আট বছর দীর্ঘ একটা সময়। মেয়েটার এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। এখনও কি মেয়েটা ফুল বিক্রী করে ঐ রাস্তায়। কেমন আছে? জানতে বড় ইচ্ছা করে।
প্রযুক্তি পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তবে এখনও একটা শ্রেণী ঠিকই মুঠোর বাহিরে। ফেসবুকে অনেককে খুঁজে বের করা সম্ভব। কিন্তু ঐই ফুল বিক্রেতা মেয়েটা কোন দিন ফেসবুকে আসবে না। আধুনিক প্রযুক্তি থেকে একটা অংশ ঠিকই দূরে থাকে। তাদের কে প্রযুক্তি ঠিক স্পর্শ করতে পারে না।
কথাগুলো মনে পড়ছে গাড়িতে বসে। তবে এখানে রাস্তায় যানযট বেশিক্ষন থাকে না। সব কিছু কঠোর সময় মেনে। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ৪ মিনিট পরই সিগনাল উঠে যাবে। গাড়ি চলা শুরু করবে। জানালা দিয়ে কোন ভিক্ষুক আসছে না। অথচ এখন মনে হচ্ছে ভিক্ষুক আসলেই ভাল হতো। কোন ফুল বিক্রেতা এসে আকুতি জানাচ্ছে না ফুল কিনার। ফুল কিনতে হলে সে দূরে ফ্লাওয়ার শপে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশে রাস্তাতে গাড়িতে বসেই ফুল কেনা যায়।
গাড়ী চলছে। পুরানো কথা গুলো বেশি মনে পড়ছে। বয়স বেশি হয়ে গেলেই নাকি পুরানো কথা গুলো মনে পড়ে। কিন্তু বয়সতো তেমন হলো না। এখনও চল্লিশও পার হয় নি। তারপরও আগের কথাগুলো মাথায় এভাবে বাসা বাঁধছে কেন বুঝতে পারছে না।
আচ্ছা রেবেকা এখন কেমন আছে? একটা পুরুষ কিভাবে পালানো নারীকে বিয়ে করে। মহসিন। লোকটাকে কিছুটা চিনে। ওর দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। আগে কোন সম্পর্ক ছিল না। ওদের বিয়েতেই প্রথম পরিচয়। এরপর মাঝে মাঝে আসত। বউয়ের দিক দিয়ে আত্মীয় এজন্য কিছু মনে করতেন না আসলাম। ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসা নিয়ে। ভুলটা ঐ জায়গাতেই হয়ে যায়। কিন্তু যখন হয়ে যায় তখন করার ঐ সময় করার আর কিছুই ছিল না। কিছু কিছু ভুল কখনো শুধরানো যায় না। শুধরানো উচিতও না। কিংবা শুধরানোর কথা-ই ভাবা যায় না। আসলামের মাঝে মাঝে মনে হয় রেবেকাই জিতেছে। হেরেছে মহসিন। মহসিন অবিবাহিত। রেবেকা জীবনে দুইটা বিয়েই করেছে অবিবাহিতকে। ভালোই তো। কিন্তু এগুলো চিন্তা করছে কেন? এতদিন তো মনে পড়ে নাই। ফালতু সব চিন্তা ভাবনা।
ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি থামাতে। পাশে সুইমিং পুল দেখা যাচ্ছে। সেখানে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলে কিছুটা এসব চিন্তা থেকে দূর থাকা যাবে হয়ত।
সাঁতার কাটতে নামে। সুইমিং পুলের নীলাভ পানিগুলো অদ্ভূত সুন্দর। পরিষ্কার ঝলমলে পানি। ইচ্ছামত দাপড়াচ্ছে কেউ কেউ। পানিতে নামছে সত্য। বেশ কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করল যেখানে নেমেছে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এখানেতো কোন যানযট নেই। তারপরও এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কেন? গ্রামের বাড়ির পুকুরের কথা মনে পড়ে যায়। বাবা প্রতি বছর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। ইচ্ছামত সাঁতার কাটা হতো। সে পানি এত পরিষ্কার ছিল না। তারপরও অনেক ভাল লাগত।
কিন্তু যখন টাকা আয় বাড়তে লাগল। তখন টাকা আয়ের সাথে সাথে ব্যস্ততাও বেড়ে গেল। আর বাড়িতে যাওয়া হয়নি। এখন ইচ্ছা হচ্ছে ঐ গ্রামের পানিতে গিয়ে সাঁতার কাটতে। পুকুরটা এখনও আছে কিনা কে জানে?
আসলামের ভাল লাগে না। উঠে পড়ে। পাড়ে বসে এক কাপ গরম কফি খায়। কিন্তু কফি তিতা লাগে। আগে তো এত তিতা মনে হতো না। এখন এত তিতা লাগছে। কি হচ্ছে এসব?
রেবেকা যেদিন চলে যায় অনেকে স্বান্তনা দিতে চলে আসে। একদিকে রেবেকা চলে যাওয়ায় নিজের অপমানের চেয়ে বেশি খারাপ লাগছিল অন্যদের স্বান্তনা শুনতে। এত মানুষ জানল কিভাবে? ভাল খবরগুলো তো এত জন জানে না। খারাপ খবরগুলো কি করে তাড়াতাড়ি সবাই জেনে যায়।
কাউকে না জানিয়ে বাসা তালা বদ্ধ করে একটা হোটেলে উঠে আসে। এরই মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। মিল, ফ্যাক্টরি, বাড়ি সব বিক্রী করে দিবে। অতি দ্রুত সব কাজ করে ফেলে। সব কিছু অন্য মালিকানায় হস্তগত হয়। আর আসলাম পাড়ি জমায় গ্রীস।
এই দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন কিছু চিন্তা করে নাই। দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। প্রথমেই মনে হয়েছে গ্রীসের নাম। রেবেকা শুধু সংসার ছেড়ে পালাল। আর আসলাম পুরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে এল। এখন মনে হচ্ছে রেবেকার চেয়ে নিজেকে বেশি অপরাধী।
যেরকম হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে আসা। সেরকম হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছা করে দেশে ফিরার। আবার দেখতে ইচ্ছা করে সিগনালে বসে ভিক্ষুকের উৎপাত। একটু সাহায্য দিলেই কি খুশী হয়ে উঠে ওদের মুখটা। দোয়া করতে থাকে অবিরত। এবার গেলে কোন ফকিরকে ফিরাবে না চিন্তা করে আসলাম। আর সে ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে খুব মনে পড়ে। খোঁজলে কি পাওয়া যাবে সে মেয়েটাকে?
সে মেয়েটার কাছে মাফ চাইবে। ওকে বুঝিয়ে বলবে কেন সেদিন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। ভাবীর কথা বলতে গেল কেন?
আসলাম এগুলো চিন্তা করতে গিয়ে ধাক্কা খায়। কি চিন্তা করছে? নিজেকে কঠোর করতে চেষ্টা করে। জীবনে আবেগের কোন মূল্য নাই। মূল্য থাকলে এত ভালবাসা কখনো পালাতে পারে না।
কঠিন কিছু করতে হবে। এমন কঠিন যাতে মনে হয় নিজে আবেগী না। কি করা যায়। সামনে ড্রাইভার আছে। তার স্ত্রী অনেক অসুস্থ। সে অনুনয় করে বলছে সামনের মাসের বেতনটা অগ্রিম দিতে। আসলাম মনে মনে চিন্তা করছিল আরো বাড়িয়ে কিছু দিবে। এখন মনে হচ্ছে নিজেকে কঠোর প্রমাণ করা যাবে।
ড্রাইভারকে বলে দিবে, এখন তোমাকে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। সামনের মাসের টাকা সামনের মাসে পাবা।
আবেগ আর কঠোরতার মাঝে আসলাম সাঁতার কাটছে। ড্রাইভারকে এখুনি বলে দেওয়া দরকার কথাটা। তাহলে নিজে যে আবেগশূন্য তা নিজের কাছে প্রমাণিত হবে। যা এখন খুব দরকার। কিন্তু মুখ দিয়ে কথাটা এসেও বের হচ্ছে না। কারণ কি? আবেগের কাছে কি হেরে যাবে?
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঐ ভিক্ষুকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত হয় নাই। উচিত হয় নাই ঐ ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে চরম ধমক দেওয়া। কি মায়াবী মুখ। এই অল্প বয়সেই জীবিকার খাতিরে পথে এসেছে। “ স্যার ফুল নেন, ফুল, ভাবীকে দিবেন। ভাবী অনেক খুশী হবে।”
ভাবীর কথা শুনেই সেদিন মেজাজটা চড়ে উঠেছিল।
“ ওই তোর ফুলের গোষ্ঠী কিলাই। সর গাড়ির সামনে থেকে। গাড়ীতে যে রেখেছিস তোর হাতের ময়লা গাড়ীতে লাগছে, এক্ষুনি সর।”
-ফুল নেবেন না, ভালা কথা। আমারে গালি দেন ক্যান?
“ ওমা এই মেয়ে দেখি মুখে মুখে কথা বলে, তোর তো সাহস অনেক। ফুল বিক্রী করে খাস। এত তেজ কেন তোর?”
-ফুল বিক্রী করি বিধায় কি আমরা মানুষ না। না নিলে কইয়া দিলেই হয় নেবেন না। তা ফুলের গোষ্ঠী কিলান ক্যান?
আসলে তো ফুল বিক্রী করে যারা তারা কি মানুষ না? কিন্তু সেগুলো তো ভাবার মাথা নেই। ভাবীর কথা শুনে ওর গা জ্বলে উঠে। কত ভালবেসে বিয়ে করেছিল। অথচ সেই মেয়ে অন্য একজনে সাথে চলে গেল। কি বিশ্রী ব্যাপার। এতটুকু কিছু বুঝতে দিল না। পৃথিবীর সকল মেয়ের প্রতি সেই থেকে বিতৃষ্ণা জমে গেল। প্রতিষ্ঠানে সে সবার চেয়ে বেশি অবিশ্বাস করে তার মেয়ে কর্মচারীদের। অথচ ওরাই সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তারপরও বিশ্বাস করতে পারে না। একটি মেয়ে ওর বিশ্বাসটাকেই কঠিন ভাবে নাড়িয়ে দিল।
হাত বের করে কড়াস করে একটা থাপ্পর দিয়ে বসে। হয়ত আরো কিছু করত। কিন্তু সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায় গাড়ি চলা শুরু করে। মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গাড়িটির দিকে। এতক্ষণ কথায় তেজ ছিল। মুখে প্রতিবাদের একটা ভাব ছিল। এখন মুখটা অনেক বেশি শান্ত। এরকম থাপ্পড় খাবে চিন্তাও করে নাই। গাড়ির ব্যাক মিরর দিয়ে কিছুক্ষণ দেখা যায় মেয়েটাকে। তাকিয়ে আছে। কি মায়াবী মুখ। অথচ তারপরও অসহ্য লাগছে। একটুও খারাপ লাগে নি তখন আসলামের।
তবে এখন যখন সে মেয়েটার কথা মনে পড়ছে অনেক বেশি খারাপ লাগছে। মেয়েটা অনেক বড় হয়েছে। আট বছর দীর্ঘ একটা সময়। মেয়েটার এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। এখনও কি মেয়েটা ফুল বিক্রী করে ঐ রাস্তায়। কেমন আছে? জানতে বড় ইচ্ছা করে।
প্রযুক্তি পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তবে এখনও একটা শ্রেণী ঠিকই মুঠোর বাহিরে। ফেসবুকে অনেককে খুঁজে বের করা সম্ভব। কিন্তু ঐই ফুল বিক্রেতা মেয়েটা কোন দিন ফেসবুকে আসবে না। আধুনিক প্রযুক্তি থেকে একটা অংশ ঠিকই দূরে থাকে। তাদের কে প্রযুক্তি ঠিক স্পর্শ করতে পারে না।
কথাগুলো মনে পড়ছে গাড়িতে বসে। তবে এখানে রাস্তায় যানযট বেশিক্ষন থাকে না। সব কিছু কঠোর সময় মেনে। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ৪ মিনিট পরই সিগনাল উঠে যাবে। গাড়ি চলা শুরু করবে। জানালা দিয়ে কোন ভিক্ষুক আসছে না। অথচ এখন মনে হচ্ছে ভিক্ষুক আসলেই ভাল হতো। কোন ফুল বিক্রেতা এসে আকুতি জানাচ্ছে না ফুল কিনার। ফুল কিনতে হলে সে দূরে ফ্লাওয়ার শপে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশে রাস্তাতে গাড়িতে বসেই ফুল কেনা যায়।
গাড়ী চলছে। পুরানো কথা গুলো বেশি মনে পড়ছে। বয়স বেশি হয়ে গেলেই নাকি পুরানো কথা গুলো মনে পড়ে। কিন্তু বয়সতো তেমন হলো না। এখনও চল্লিশও পার হয় নি। তারপরও আগের কথাগুলো মাথায় এভাবে বাসা বাঁধছে কেন বুঝতে পারছে না।
আচ্ছা রেবেকা এখন কেমন আছে? একটা পুরুষ কিভাবে পালানো নারীকে বিয়ে করে। মহসিন। লোকটাকে কিছুটা চিনে। ওর দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। আগে কোন সম্পর্ক ছিল না। ওদের বিয়েতেই প্রথম পরিচয়। এরপর মাঝে মাঝে আসত। বউয়ের দিক দিয়ে আত্মীয় এজন্য কিছু মনে করতেন না আসলাম। ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসা নিয়ে। ভুলটা ঐ জায়গাতেই হয়ে যায়। কিন্তু যখন হয়ে যায় তখন করার ঐ সময় করার আর কিছুই ছিল না। কিছু কিছু ভুল কখনো শুধরানো যায় না। শুধরানো উচিতও না। কিংবা শুধরানোর কথা-ই ভাবা যায় না। আসলামের মাঝে মাঝে মনে হয় রেবেকাই জিতেছে। হেরেছে মহসিন। মহসিন অবিবাহিত। রেবেকা জীবনে দুইটা বিয়েই করেছে অবিবাহিতকে। ভালোই তো। কিন্তু এগুলো চিন্তা করছে কেন? এতদিন তো মনে পড়ে নাই। ফালতু সব চিন্তা ভাবনা।
ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি থামাতে। পাশে সুইমিং পুল দেখা যাচ্ছে। সেখানে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলে কিছুটা এসব চিন্তা থেকে দূর থাকা যাবে হয়ত।
সাঁতার কাটতে নামে। সুইমিং পুলের নীলাভ পানিগুলো অদ্ভূত সুন্দর। পরিষ্কার ঝলমলে পানি। ইচ্ছামত দাপড়াচ্ছে কেউ কেউ। পানিতে নামছে সত্য। বেশ কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করল যেখানে নেমেছে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এখানেতো কোন যানযট নেই। তারপরও এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কেন? গ্রামের বাড়ির পুকুরের কথা মনে পড়ে যায়। বাবা প্রতি বছর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। ইচ্ছামত সাঁতার কাটা হতো। সে পানি এত পরিষ্কার ছিল না। তারপরও অনেক ভাল লাগত।
কিন্তু যখন টাকা আয় বাড়তে লাগল। তখন টাকা আয়ের সাথে সাথে ব্যস্ততাও বেড়ে গেল। আর বাড়িতে যাওয়া হয়নি। এখন ইচ্ছা হচ্ছে ঐ গ্রামের পানিতে গিয়ে সাঁতার কাটতে। পুকুরটা এখনও আছে কিনা কে জানে?
আসলামের ভাল লাগে না। উঠে পড়ে। পাড়ে বসে এক কাপ গরম কফি খায়। কিন্তু কফি তিতা লাগে। আগে তো এত তিতা মনে হতো না। এখন এত তিতা লাগছে। কি হচ্ছে এসব?
রেবেকা যেদিন চলে যায় অনেকে স্বান্তনা দিতে চলে আসে। একদিকে রেবেকা চলে যাওয়ায় নিজের অপমানের চেয়ে বেশি খারাপ লাগছিল অন্যদের স্বান্তনা শুনতে। এত মানুষ জানল কিভাবে? ভাল খবরগুলো তো এত জন জানে না। খারাপ খবরগুলো কি করে তাড়াতাড়ি সবাই জেনে যায়।
কাউকে না জানিয়ে বাসা তালা বদ্ধ করে একটা হোটেলে উঠে আসে। এরই মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। মিল, ফ্যাক্টরি, বাড়ি সব বিক্রী করে দিবে। অতি দ্রুত সব কাজ করে ফেলে। সব কিছু অন্য মালিকানায় হস্তগত হয়। আর আসলাম পাড়ি জমায় গ্রীস।
এই দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোন কিছু চিন্তা করে নাই। দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। প্রথমেই মনে হয়েছে গ্রীসের নাম। রেবেকা শুধু সংসার ছেড়ে পালাল। আর আসলাম পুরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে এল। এখন মনে হচ্ছে রেবেকার চেয়ে নিজেকে বেশি অপরাধী।
যেরকম হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে আসা। সেরকম হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে ইচ্ছা করে দেশে ফিরার। আবার দেখতে ইচ্ছা করে সিগনালে বসে ভিক্ষুকের উৎপাত। একটু সাহায্য দিলেই কি খুশী হয়ে উঠে ওদের মুখটা। দোয়া করতে থাকে অবিরত। এবার গেলে কোন ফকিরকে ফিরাবে না চিন্তা করে আসলাম। আর সে ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে খুব মনে পড়ে। খোঁজলে কি পাওয়া যাবে সে মেয়েটাকে?
সে মেয়েটার কাছে মাফ চাইবে। ওকে বুঝিয়ে বলবে কেন সেদিন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। ভাবীর কথা বলতে গেল কেন?
আসলাম এগুলো চিন্তা করতে গিয়ে ধাক্কা খায়। কি চিন্তা করছে? নিজেকে কঠোর করতে চেষ্টা করে। জীবনে আবেগের কোন মূল্য নাই। মূল্য থাকলে এত ভালবাসা কখনো পালাতে পারে না।
কঠিন কিছু করতে হবে। এমন কঠিন যাতে মনে হয় নিজে আবেগী না। কি করা যায়। সামনে ড্রাইভার আছে। তার স্ত্রী অনেক অসুস্থ। সে অনুনয় করে বলছে সামনের মাসের বেতনটা অগ্রিম দিতে। আসলাম মনে মনে চিন্তা করছিল আরো বাড়িয়ে কিছু দিবে। এখন মনে হচ্ছে নিজেকে কঠোর প্রমাণ করা যাবে।
ড্রাইভারকে বলে দিবে, এখন তোমাকে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। সামনের মাসের টাকা সামনের মাসে পাবা।
আবেগ আর কঠোরতার মাঝে আসলাম সাঁতার কাটছে। ড্রাইভারকে এখুনি বলে দেওয়া দরকার কথাটা। তাহলে নিজে যে আবেগশূন্য তা নিজের কাছে প্রমাণিত হবে। যা এখন খুব দরকার। কিন্তু মুখ দিয়ে কথাটা এসেও বের হচ্ছে না। কারণ কি? আবেগের কাছে কি হেরে যাবে?