সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বৈচিত্র ( গল্প )

বইগুলো এলেমেলো করে টেবিলের উপর ছড়ানো। বইগুলো সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করছে মামুন। আগে ঠিক করত না। যেভাবে ছড়িয়ে রাখা হতো সেভাবেই থাকতো। এখন ঠিক করতে হয়। নাহলে লোপা অনেক রাগ করে। ও প্রতিদিন সাজিয়ে দেয় বইগুলো। পরে যদি দেখে বই গুলো এলোমেলো আছে তাহলে ইচ্ছামত বকে। “ সামান্য বইগুলো ভাজ করে রাখতে পারো না, তোমাকে বই ধরতে কে বলে? তুমি বই ধরবা না।”.....


মাঝে মাঝে বকাগুলো শুনতে ভালোই লাগে। মিস্টি গলায় বকা। লোপা গলায় কঠোরতা আনতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। কিন্তু ওর বিরক্ত হওয়াকে বেশ ভয় লাগে মামুনের। তাই এলোমেলো করার পর আবার বইগুলো দেখা শেষে গুছিয়ে রাখে। টেবিলের একপাশে বিশাল একটা খাতার স্তুপ। বই সেলানোর সুতা দিয়ে বাঁধা। পাবলিক পরীক্ষার খাতা। ছয়শত খাতা আছে। সেগুলো দেখে বিরক্ত হয়। গতরাত্রে পঞ্চাশটার মত দেখা হয়েছে। তবে এখন খাতাগুলো নিয়ে বসা দরকার। সামনের শনিবার জমা দিয়ে দিতে হবে। অথচ অনেক খাতা দেখা বাকী। কিন্তু একটুও ইচ্ছা করছে না।

এই অনিচ্ছাটা হয়েছে বিয়ের পর। আগে একরাতেই সব খাতা দেখে ফেলত। যতক্ষণ শেষ না হতো ততক্ষণ উঠত না। তখন একা ছিল। গান চালু করে দিত লো ভলিয়মে। আর গান শুনতে শুনতে খাতাগুলো কাটা শেষ হয়ে যেত। অন্য টিচাররা অবাক হয়ে যেত এত তাড়াতাড়ি খাতা জমা দিচ্ছে দেখে। কিন্তু লোপার সাথে বিয়ে হওয়ার পর কেমন যেন আলস্য জমে বসেছে।

কাজের ব্যাপারে লোপা অনেক সিরিয়াস। বার বার তাগাদা দেয়। তারপরও কেন জানি ইচ্ছা করে না। “ এই তোমার খাতাগুলো যে জমা দিতে হবে খবর আছে, এত কম কম কাটলে হবে? ”

“ ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে ঘুমাতে।”
“ নাহ এখন কোন ঘুম চলবে না, খাতা কাটো।”

মামুন হাই তুলে। দেখে মনে হয় এখুনি ঘুমে চোখ ঢলে পড়বে।

তা দেখে লোপা বলে, এই অভিনয় রাখো। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে চা বানিয়ে আনে। “নাও চা খাও। চা খেলে ঘুম দূর হবে।”
“তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? একটা মানুষ ঘুমাতে চাচ্ছে অথচ তুমি তাকে ঘুমাতে দিচ্ছো না, মেয়েরা যে কেন এত নিষ্ঠুর হয়?”
“মেয়েরা মানে? কি বলছো? অন্য মেয়েদের সাথেও উঠাবসা আছে নাকি তোমার? সাংঘাতিক ব্যাপার তো।”
“ আরে নাহ, তোমাকে বলছি। আর মেয়েরা হবে না। হবে মেয়ে। কথা মিলানোর জন্য মেয়েরা বলছি।”
“ ঠিক আছে আধা ঘুমন্ত মানুষ এখন তুমি। তাই তোমাকে মাফ করে দেওয়া হলো।”
বলেই হাসি দেয় লোপা।
লোপার চুল গুলো ছড়ানো। অনেক লম্বা চুল। মামুন সে চুলে ঘ্রাণ নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ে। আশ্চর্য রকমের এক মাদকতা যেন আছে সে কালো চুলে।

এই তোমার মাথাটা একটু আনো।
“লোপা তা শুনে দূরে সরে যায়। এখন সেসব হবে না। তাড়াতাড়ি চা খাও।”
“আরে চা তো অনেক গরম। ঠান্ডা হোক একটু।”
“ঘুম দূর করার জন্য তো গরম চা-ই খেতে হয়। ঠান্ডা চা খেলে তো আরো ঘুম চলে আসবে।”
“এত গরম যে গরম জিহ্বা পুড়ে যাবে তো।”
“জিহ্বা পুড়ে যাক, তারপরও খাও। আর কোন কথা না। চা খেয়েই বাকী খাতাগুলো গুড বয়ের মত দেখো।”
এই কথা বলেই রুম ছেড়ে চলে যায় লোপা।

চা খেয়ে আরো কিছু খাতা দেখে। আধা ঘন্টা পর আর ইচ্ছা করে না। ইংরেজী খাতা। অনেকে উল্টা পাল্টা লিখছে। বাংলাতে তারপরও মজার লেখা পাওয়া যায়। কিন্তু ইংরেজী মজার লেখা পাওয়া যায় না। বেশির ভাগই ভুল। ভুল চিহ্নিত করতে গিয়ে অনেক কালি চলে যায়। মামুন একটা জিনিষ ভাবে খাতা কাটতে গিয়ে কোন বিষয়ে কালি বেশি খরচ হয়? মনে হয় ইংরেজীতেই। কারণ ইংরেজীতেই শিক্ষার্থীরা বেশি ভুল করে। আর ভুল করে মার্ক করতে কালিও বেশি যায়। পঞ্চাশটার মত খাতা কাটা হয়।

লোপার পায়ের শব্দ শোনা যায়। সাথে সাথে মামুন একটা ভাব নেয়। মাথাটা একটু নিচে নামায় রাখে। সাথে একটু ঢুলুনিও দেয়। দেখলে মনে হবে ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে।

এরকম দেখে লোপা বলে, “ঠিক আছে আর কাটতে হবে না। ঘুমাতে আসো।”
মামুন মনে মনে খুশী হয়। যদিও উপরে তা প্রকাশ করে না। অভিনয় তাহলে সফল। সে ঘুমন্ত হাতে খাতা গুলো গুছিয়ে রাখতে যায়।

তা দেখে মানা করে লোপা। “তোমার গুছাতে হবে না। ঘুমে তো পুরা শেষ। ফ্রেশ হয়ে বিছনায় চলে যাও। আমি গুছিয়ে রাখছি।”

এখন আবার বিরক্ত হাতে খাতাগুলো দেখা শুরু করে মামুন। লোপা পাশের ফ্ল্যাটে গেছে। ঐ মহিলার সাথে খুব ভাব। নতুন কিছু রান্না করলে একজন অন্য জনকে পাঠায়। একদিন এরকম পাঠিয়েছে। খাসির মাথা মুগ ডাল দিয়ে।

মামুন খাচ্ছে। লোপা জিজ্ঞেস করে, কেমন লাগছে ভাবীর রান্না?
মামুনের ইচ্ছা করে একটু রাগাতে লোপাকে। সে বলে, হুম মজা।
-তা তো হবেই। কিন্তু কেমন হয়েছে, সেটা জিজ্ঞেস করলাম। মানে কোন পর্যায়ের?
-আরে অনেক মজার। বেহেসশতে গিয়েও এই ভাবীর রান্না খুঁজব। এইরকম অমৃত মনে হচ্ছে।
হাসতে হাসতে বলে মামুন। মনে করেছিল এই কথা শুনে লোপা একটু রাগ করবে।

লোপা রাগ না করে উল্টা হাসতে হাসতে বলে, আর আমার রান্না দোজখে গিয়ে খেতে ইচ্ছা করবে তাই না???

আরে সেটা বলি নাই তো।
চোখ পাকিয়ে লোপা বলে, কিছু বলতে হবে না, বুঝি বুঝি সব বুঝি।

আরো বেশ কিছু খাতা দেখা হয়। তবে না পারতে দেখার মত। এ যেন চোখ বুলিয়ে নেওয়া। মাঝে মাঝে চিন্তা হয় ওরা প্রত্যেকজন কি যত্ন করে খাতায় লিখে। কিন্তু কি তাচ্ছিল্যের সাথে খাতাগুলো কাটা হয়। মামুন চেষ্টা করে নাম্বার ভালোই দিতে। কড়া ভাবে কখনো কাটে না। লিখলে নাম্বার দিয়ে দেয়।

একটা খাতা কাটছে। শেষ পাতায় গিয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ইংরেজী ২য় খাতায় বাংলা লেখার কোন সুযোগ নেই। সব উত্তর ইংরেজীতে লিখতে হয়। কিন্তু এখানে বাংলা লিখলো কেন? বিরক্ত হয়ে কি লিখেছে সেটা পড়া শুরু করে,

“স্যার দয়া করে আমাকে পাশ করায় দিবেন। ২য় বর্ষে উঠতেই আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমার শ্বাশুড়ী অনেক যন্ত্রণা করেন। বাসায় ননদরাও খুব ফ্যাশনেবল। সব কিছু করে ঐ পড়ালেখা ছাড়া। শ্বাশুড়ী অনেক জ্বালান। তাদের কারণে পড়তে পারি নাই। স্যার কষ্ট করে আমাকে পাশ করায় দিবেন। অন্য বিষয়ে পাশ করব এই বিষয়টা ছাড়া। আমি যদি ফেল করি তাহলে আমাকে আমার স্বামী তালাক দিয়ে দেবেন। স্যার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও আমাকে পাশ করায় দিবেন। স্যার একটু দয়া করেন। আমাকে পাশ করালে তো আপনার ক্ষতি হবে না। প্লিজ পাশ করিয়ে দিবেন।"

হাতের লেখা বেশ সুন্দর। কিন্তু পড়ালেখায় এই হাল কেন? পরীক্ষায় খাতায় অপ্রাসঙ্গিক কিছু লেখা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু এই মেয়ে এসব লিখল কেন? এই মেয়ে কি তা জানে না?

লোপাকে দেখাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু লোপা তো পাশের ফ্ল্যাটে। খাতাটা আলাদা করে রাখে মামুন। অন্য খাতাগুলো কাটছে।

কলিংবেলের আওয়াজ। কাজের মেয়ে আছে পাকঘরে। তার অপেক্ষা না করে মামুন নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। খাতাটা এক্ষুনি না দেখিয়ে শান্তি পাচ্ছে না সে।
দরজা খুলেই বলে, লোপা, একটা মজার ব্যাপার হয়ে গেছে।
:কি?
আলাদা করে রাখা খাতাটা লোপার দিকে বাড়িয়ে দেয়। “ পড়ে দেখ”

পড়া শেষ হয়। মামুন ভেবেছিল লোপা মজা পেয়ে হেসে উঠবে। কিন্তু এই কি? লোপা লেখাটা পড়ে গম্ভীর হয়ে গেছে কেন?

গম্ভীর হয়ে লোপা ঘোষণা করে, এই মেয়েকে তুমি পাশ করিয়ে দেবা।
-বলো কি? কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
-কেন? সম্ভব নয় কেন?
খাতার আগের পৃষ্ঠা গুলো উল্টিয়ে দেখায় মামুন। দেখো এই মেয়ে সব মিলে পেয়েছে তেরো। বিশের উপর পেলে চেষ্টা করা যেত।
-হা দেখছি। কিন্তু তারপরও তো ইচ্ছা করলে পাশ করিয়ে দেওয়া যায়। তুমি চিন্তা করো এই একটা পাশ দ্বারা এই মেয়ের বিয়েটা টিকে যাবে। পাশ করালে তোমার তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না।

-ঐ মেয়ে হয়ত মিথ্যা লিখেছে। আর এরকম পাশ করানো তো অন্যায়।
-তুমি নিশ্চিত জানো সে মিথ্যা লিখেছে? জানো না যখন ধরে নাও ঐ মেয়েটা সত্যই লিখেছে। আর একটা অন্যায় করে যদি একজনের সংসার টিকিয়ে রাখা যায় সেটা করা তো ভাল।

মামুন ঘাবড়ে যায়। লোপা এই লেখা দেখে এভাবে ইমোশনাল হয়ে পড়বে তা চিন্তা করে নাই। চিন্তা করলে এই খাতাটাই দেখাতো না। এখন আফছোস হচ্ছে কি জন্য যে দেখালো।

লোপার মুখের গম্ভীরতা কমে না। মেয়েটার কথাকে লোপা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। মামুন বলে, তুমি বুঝার চেষ্টা করো।

লোপা থামিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায়। “এই মেয়েকে পাশ না করানো পর্যন্ত আমি তোমার সাথে কোন কথা বলছি না। এর পরে আমার সাথে তোমার প্রথম কথা হবে, মেয়েটাকে পাশ করিয়েছি। সেটা বলতে পারলে আমার সাথে কথা বলতে আসবা। অন্যথায় কোন কথা না।”

এটা বলেই চলে যায় লোপা।

মামুন চিন্তায় পড়ে যায়। কিজন্য যে দেখাতে গেল?