সুন্দর একটা বাগান। সেখানে অনেক ফুল ফুটে আছে। তবে কোন ফল গাছ নেই। বাগানটি
আয়শা বেগমের। তার স্বামী ফুল খুব পছন্দ করত। মাঝে মাঝে আয়েশা বেগমের রাগ
হত। বাগানে এতক্ষণ বসে থাকার মানে হয়? বিরক্ত হলে বকাঝকা করতেন।.....
: আচ্ছা এতটা সময় ফুলের বাগানে বসে থাকার মানে হয়! দোকানে যে বসছো না খেয়াল আছে?
: সমস্যা নেই। দোকানে রফিক আছে। ভাল লোক।
: তোমার কাছে তো পৃথিবীর তাবৎ লোকই ভালো। দুনিয়াটা এত সহজ না।
স্ত্রীর কথা শুনে মইনুল মুচকি হাসেন। নিড়ানিটা নাড়তে নাড়তে বলেন, ভাল লোককে ভাল বলব না?
আয়েশা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কেমনে? এই হাসি দেখলে আর কড়া ভাষায় কথা বলা যায় না। মঈনুলের একটা মুদির দোকান আছে। সেটার আয় দিয়ে মোটামুটি চলে। কোন সন্তান নেই। এক বছর বয়স না পেরোতেই একমাত্র সন্তানটি ডায়রিয়ায় মারা যায়।
দেশের অবস্থা ভাল না। যেকোন সময় বড় কিছু হয়ে যেতে পারে। তা দেখে একদিন আয়েশা বেগম রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বলেন, চলো আমরা গ্রামের বাড়ীতে চলে যাই। এখানে আর ভাল লাগছে। ভয় ভয় করে।
: দূর, কি যে বলো। আমাদের সাথে কারো শত্রুতা আছে নাকি? কিচ্ছু হবে না। ভয়ের কি আছে?
তারা যান নি। এরিমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এখন কোথাও যাওয়া দুঃসাধ্য। মুদি দোকানটা বাসার কাছে। সুযোগ হলে মঈন সেখানে যান। আর বাসায় থাকলে বাগানে কাটান। মঈন দোকানে বাংলা পত্রিকা রাখেন। পত্রিকার খবরগুলো পড়ে তার মনে হয় এবার বোধ হয় সত্যি সত্যি স্বাধীনতা চলে আসবে। একটা স্বাধীন দেশ হবে। যুদ্ধ করতে যেতে তারও ইচ্ছে করে। কিন্তু বউকে একা বাসায় এভাবে রেখে বের হতে ঠিক সাহসে কুলাতে পারেন না। এই শহরে আত্মীয় স্বজন কেউ নাই। নানা দুশ্চিন্তায় সময় পার হতে থাকে।
একদিন মঈনকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। তাদের সাথে ছিল এলাকার প্রতিবেশী খুইল্যা মিয়া। মঈনের অপরাধ বিনামূল্যে মুদির দোকান থেকে মুক্তিবাহিনীকে চাল ডাল দিয়েছে। এটা সত্য। তবে পাক বাহিনী কেমনে জানল তা মঈনের মাথায় ঢুকে না। আয়েশা পথ আগলে রাখতে চায়।
: আমার স্বামীকে ছেড়ে দিন। ওর কোন দোষ নেই।
স্বামীর জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেন। বড় অফিসারের পা ধরে তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে বলেন।
না ছাড়া হয় না। বরং উর্দুতে ওরা কি কি যেন বলে।
আয়েশা বেগমকে অন্য গাড়িতে তোলা হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনকে দুই গাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেশ স্বাধীন হয়। চারদিকে বিজয়ের পতাকা উড়ে। মঈন ফিরে আসে না। তবে আয়েশা ফিরে আসে গ্রামের বাড়ীতে।
০২
রাবেয়া গল্প করছে আয়েশা বেগমের সাথে। আয়েশা বেগমকে গ্রামের অনেকেই এড়িয়ে চলে। তবে ছিদ্দিক সাহেবের মেয়ে রাবেয়া প্রতিদিন আসে আয়েশা বেগমের সাথে গল্প করতে। গল্প করতে ভাল লাগে রাবেয়ার। রাবেয়া এবার নবম শ্রেণীতে। দু জনে বসে ফুলের বাগানের পরিচর্যা করেন। মাঝে মাঝে সঙ্গী হয় সজল। সে নির্যাতনের পর সজলের জন্ম হয়। গ্রামের কেউ সজলের সাথে কথা বলে না। আয়েশা বেগম নিজে বাজার করেন। সজলকে পাঠান না। বাজারে গেলে সজলকে আজে বাজে কথা শুনতে হয়।
সজল একটু লাজুক প্রকৃতির। রাবেয়া যখন আসে, সে আড়ালে চলে যায়। তা দেখে রাবেয়ার মজা লাগে। কারো সৌন্দর্য দেখলে তাদের উদ্দেশ্যে রাত জেগে চিঠি লিখা যায়। তারপরও মনে হয় ঠিকমত মনের ভাব প্রকাশ করা যায়নি। রাবেয়া ঐ ধরণের সুন্দর। স্কুলে যাওয়ার পথে অনেকে তাকে চিঠি দেয়, কথা বলতে চায়। এমনকি একদিন স্কুলের এক শিক্ষকও তাকে চিঠি দিয়ে বসে। কি আবেগিক কথাবার্তা! অথচ রাবেয়া নিজ থেকে সজলের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু সজল কথা বলে না। ডাক দিলে অন্য কোথাও চলে যায়।
একদিন রাবেয়া বলেই ফেলে- খালা, তোমার ছেলে এত লাজুক কেন? আমার সাথে কথা বলতে ভয় পায়।
কথাটা শুনে আয়েশা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
: ছোটকাল থেকেই আমার সজলের সাথে বাহিরের কেউ কথা বলে না। ও ওর জীবনে যা কথা বলছে তা আমার সাথে নয়ত নিজে নিজে। আচ্ছা মা, বলতো সজলের কি দোষ? মানুষে আমাকে ঘৃণা করে করুক, সজলকে ঘৃণা করে কেন? কেউ কি পারে তার জন্ম কোত্থেকে হবে তা নির্ধারণ করে নিতে?
কথাগুলো বলতে গিয়ে আয়েশা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন।
রাবেয়ারও কান্না আসে। যুদ্ধে অনেকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে এগুলোর জন্য ঘৃণা করতে হবে কেন? রাবেয়া মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সজলকে ও বিয়ে করবে। সজলের মনের কষ্টগুলো সব ভুলিয়ে দেবে ভালবাসা দিয়ে। বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী কেউ রাজি হবে না এটা ও জানে। বাধা দেবে।
যে সুন্দর মিষ্টি মুখ অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব আসে ওর জন্য। সে যখন এরকম সমাজ বিচ্ছিন্ন কাউকে বিয়ে করার কথা কাউকে বলবে তখন তাকে সবাই পাগল ভাববে এটাই স্বাভাবিক।
কেউ রাজি না হোক। শত বাধা আসুক। তারপরও সজলকেই বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলে রাবেয়া। অন্তত একজন বীরঙ্গনা নারীকে তো খুশী করা যাবে হোক তা সমাজ বিচ্ছিন্ন ভালোবাসা।
: আচ্ছা এতটা সময় ফুলের বাগানে বসে থাকার মানে হয়! দোকানে যে বসছো না খেয়াল আছে?
: সমস্যা নেই। দোকানে রফিক আছে। ভাল লোক।
: তোমার কাছে তো পৃথিবীর তাবৎ লোকই ভালো। দুনিয়াটা এত সহজ না।
স্ত্রীর কথা শুনে মইনুল মুচকি হাসেন। নিড়ানিটা নাড়তে নাড়তে বলেন, ভাল লোককে ভাল বলব না?
আয়েশা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন। মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কেমনে? এই হাসি দেখলে আর কড়া ভাষায় কথা বলা যায় না। মঈনুলের একটা মুদির দোকান আছে। সেটার আয় দিয়ে মোটামুটি চলে। কোন সন্তান নেই। এক বছর বয়স না পেরোতেই একমাত্র সন্তানটি ডায়রিয়ায় মারা যায়।
দেশের অবস্থা ভাল না। যেকোন সময় বড় কিছু হয়ে যেতে পারে। তা দেখে একদিন আয়েশা বেগম রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বলেন, চলো আমরা গ্রামের বাড়ীতে চলে যাই। এখানে আর ভাল লাগছে। ভয় ভয় করে।
: দূর, কি যে বলো। আমাদের সাথে কারো শত্রুতা আছে নাকি? কিচ্ছু হবে না। ভয়ের কি আছে?
তারা যান নি। এরিমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এখন কোথাও যাওয়া দুঃসাধ্য। মুদি দোকানটা বাসার কাছে। সুযোগ হলে মঈন সেখানে যান। আর বাসায় থাকলে বাগানে কাটান। মঈন দোকানে বাংলা পত্রিকা রাখেন। পত্রিকার খবরগুলো পড়ে তার মনে হয় এবার বোধ হয় সত্যি সত্যি স্বাধীনতা চলে আসবে। একটা স্বাধীন দেশ হবে। যুদ্ধ করতে যেতে তারও ইচ্ছে করে। কিন্তু বউকে একা বাসায় এভাবে রেখে বের হতে ঠিক সাহসে কুলাতে পারেন না। এই শহরে আত্মীয় স্বজন কেউ নাই। নানা দুশ্চিন্তায় সময় পার হতে থাকে।
একদিন মঈনকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। তাদের সাথে ছিল এলাকার প্রতিবেশী খুইল্যা মিয়া। মঈনের অপরাধ বিনামূল্যে মুদির দোকান থেকে মুক্তিবাহিনীকে চাল ডাল দিয়েছে। এটা সত্য। তবে পাক বাহিনী কেমনে জানল তা মঈনের মাথায় ঢুকে না। আয়েশা পথ আগলে রাখতে চায়।
: আমার স্বামীকে ছেড়ে দিন। ওর কোন দোষ নেই।
স্বামীর জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেন। বড় অফিসারের পা ধরে তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে বলেন।
না ছাড়া হয় না। বরং উর্দুতে ওরা কি কি যেন বলে।
আয়েশা বেগমকে অন্য গাড়িতে তোলা হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনকে দুই গাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেশ স্বাধীন হয়। চারদিকে বিজয়ের পতাকা উড়ে। মঈন ফিরে আসে না। তবে আয়েশা ফিরে আসে গ্রামের বাড়ীতে।
০২
রাবেয়া গল্প করছে আয়েশা বেগমের সাথে। আয়েশা বেগমকে গ্রামের অনেকেই এড়িয়ে চলে। তবে ছিদ্দিক সাহেবের মেয়ে রাবেয়া প্রতিদিন আসে আয়েশা বেগমের সাথে গল্প করতে। গল্প করতে ভাল লাগে রাবেয়ার। রাবেয়া এবার নবম শ্রেণীতে। দু জনে বসে ফুলের বাগানের পরিচর্যা করেন। মাঝে মাঝে সঙ্গী হয় সজল। সে নির্যাতনের পর সজলের জন্ম হয়। গ্রামের কেউ সজলের সাথে কথা বলে না। আয়েশা বেগম নিজে বাজার করেন। সজলকে পাঠান না। বাজারে গেলে সজলকে আজে বাজে কথা শুনতে হয়।
সজল একটু লাজুক প্রকৃতির। রাবেয়া যখন আসে, সে আড়ালে চলে যায়। তা দেখে রাবেয়ার মজা লাগে। কারো সৌন্দর্য দেখলে তাদের উদ্দেশ্যে রাত জেগে চিঠি লিখা যায়। তারপরও মনে হয় ঠিকমত মনের ভাব প্রকাশ করা যায়নি। রাবেয়া ঐ ধরণের সুন্দর। স্কুলে যাওয়ার পথে অনেকে তাকে চিঠি দেয়, কথা বলতে চায়। এমনকি একদিন স্কুলের এক শিক্ষকও তাকে চিঠি দিয়ে বসে। কি আবেগিক কথাবার্তা! অথচ রাবেয়া নিজ থেকে সজলের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু সজল কথা বলে না। ডাক দিলে অন্য কোথাও চলে যায়।
একদিন রাবেয়া বলেই ফেলে- খালা, তোমার ছেলে এত লাজুক কেন? আমার সাথে কথা বলতে ভয় পায়।
কথাটা শুনে আয়েশা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
: ছোটকাল থেকেই আমার সজলের সাথে বাহিরের কেউ কথা বলে না। ও ওর জীবনে যা কথা বলছে তা আমার সাথে নয়ত নিজে নিজে। আচ্ছা মা, বলতো সজলের কি দোষ? মানুষে আমাকে ঘৃণা করে করুক, সজলকে ঘৃণা করে কেন? কেউ কি পারে তার জন্ম কোত্থেকে হবে তা নির্ধারণ করে নিতে?
কথাগুলো বলতে গিয়ে আয়েশা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন।
রাবেয়ারও কান্না আসে। যুদ্ধে অনেকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে এগুলোর জন্য ঘৃণা করতে হবে কেন? রাবেয়া মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সজলকে ও বিয়ে করবে। সজলের মনের কষ্টগুলো সব ভুলিয়ে দেবে ভালবাসা দিয়ে। বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী কেউ রাজি হবে না এটা ও জানে। বাধা দেবে।
যে সুন্দর মিষ্টি মুখ অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব আসে ওর জন্য। সে যখন এরকম সমাজ বিচ্ছিন্ন কাউকে বিয়ে করার কথা কাউকে বলবে তখন তাকে সবাই পাগল ভাববে এটাই স্বাভাবিক।
কেউ রাজি না হোক। শত বাধা আসুক। তারপরও সজলকেই বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে ফেলে রাবেয়া। অন্তত একজন বীরঙ্গনা নারীকে তো খুশী করা যাবে হোক তা সমাজ বিচ্ছিন্ন ভালোবাসা।