লাইপ্রুঅনেক বড় সমস্যায় পড়েছে সামত্লিং পাড়ার মানুষ। এলাকাটা অনেক দুর্গম। পাহাড়ী
পা রাস্তা বেয়ে এখান থেকে বাজারে যেতেই লাগে তিনদিন। যাওয়ার রাস্তা খুবই
করুণ। এমন অনেক জায়গা পার হতে হয় যেখানে এক পা কোন মতে রাখা সম্ভব। একটু
এদিক ওদিক হলেই ৩০০ থেকে ৫০০ ফিট নিচে খাদে পড়ে যেতে হবে। ......
শারীরিক কাঠামোর পরিবর্তন দেখে এখানে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া নির্ণয় হয় না। বাজারে যে একবার গেল সে-ই প্রাপ্ত বয়স্ক। একটা শিশুর ১২-১৫ বছর শুধু এ ছোট এলাকাতেই কাটে। এরা রাজধানী শহরের নাম-তো দূরের কথা নিজেরা কোন উপজেলার মানুষ তা-ই জানে না।
একটা খাল বয়ে গেছে এই পাড়ার পাশ দিয়ে। পানির এটাই সম্বল। এতদিন কোন সমস্যা হয় নি। সে পানি দিয়ে চাষবাস করছে। ঘরে ব্যবহার করছে। কিন্তু গত বছর এক সকালে হঠাৎ লক্ষ্য করে খাল দিয়ে আর পানি আসে না। পাড়ার প্রভাবশালী দুজন ব্যাপারটা কি দেখতে যান। বাজারে খবর পান পাহাড় ধসে খালের গতিপথ বদলায় গেছে। এখান দিয়ে আর পানি আসবে না। এর উপর খাঁড়ার ঘা বছর ধরে বৃষ্টির দেখা নেই।
সবার মন খারাপ। মাঠগুলো রুক্ষ হয়ে যায়। ফলন হয় না কিছু। অর্ধাহারে দিন কাটানো শুরু করে এলাকার মানুষ। ভাগ্য ভাল আগে থেকে পোকামাকড় খেত ওরা। ব্যাঙ, সাপ, ললিহট্টা, টিকটিকি, আলো পোকা খেয়ে ওরা পেটের ক্ষুধা সামাল দিতে চেষ্টা করে। একদিন একটা বাঘও পেয়ে যায়। ছোট বাচ্চা বাঘ। এলাকার কারবারী ও হেডম্যানের পরিবার সেটা আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলে। এলাকাবাসীকে এতটুকু দেয় না।
বনের লতা পাতা খেতে খেতে একসময় সেগুলোও শেষ হয়ে যায়। পানির অভাবে আর নতুন করে আর সেগুলো উঠে না। চরম খাদ্য সংকটে পড়ে যায় তারা।
এগুলো দেখে এলাকার শান্ত ছেলে লাইপ্রু সবার অজান্তে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টাতে উঠে বসে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বেশির ভাগ সময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে প্রাণে পানির ব্যবস্থা চায়। এভাবে মাস পার হয়। প্রতিদিন সকাল বেলা সে ঐ জায়গায় যেতেই থাকে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় দেখে সুন্দর আকাশটা কেমন যেন অষ্পষ্ট। সূর্যের দিকে তাকালে চোখে পানি জমে। তারপরও সূর্যের দিকে অবিরত তাকিয়ে থাকা বাদ দেয় না ও। মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠে। বিড়বিড় কথা বলা আগের মতই চলতে থাকে। লাইপ্রু বুঝতে পারে না ওর চোখগুলো অন্ধত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসী এক সময় আর না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় এ এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। অনেক প্রিয় এ এলাকায় আর থাকবে না। সবাই প্রস্তুত হয়। ঘরের বেড়া, চাল ভেঙে ফেলে। পরের দিন সকালে চলে যাবে এরকম কথা হয়।
লাইপ্রুর মন খারাপ। সে এখন চোখে দেখে না। পাহাড়ী এত দূর পথ কিভাবে যাবে? সে চিন্তায় ব্যস্ত। রাতে সবাই ঘুমিয়েছে। লাইপ্রুর ঘুম নেই। সে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে ঐ পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যায় অভ্যস্ততার বশে। চোখে না দেখলেও তার সমস্যা হয় না জায়গাটিতে পৌঁছতে।
আকাশের দিকে অন্ধ লাইপ্রু তাকিয়ে থাকে। কি দেখে কি জানি? তবে হঠাৎ কি যেন হয়? ওর মাথাটা চরম ভাবে দুলতে থাকে। অসহ্য ব্যাথা হয়। কিছুক্ষণ পর মাথা ঢুলানি শেষ হয়। লাইপ্রু এক সময় আবিষ্কার করে ও ঠান্ডা কিছুর ভিতর। হাত দিয়ে ধরে বুঝতে পারে এগুলো মেঘ।
মেঘগুলো কথা বলে উঠে, আমরা আফ্রিকার এক দুর্গম বনের মেঘ। এখানে আসতে পুরা একদিন লেগেছে। তোমার ডাকে চলে এসেছি এতটা পথ। তুমি আমাদের এত ডাকাডাকি করতে কেন? সূর্যের সাথে আমাদের চরম শত্রুতা। আমাদের জন্য সে সূর্যের সাথে ঝগড়া করতে করতে তুমি তোমার চোখ হারিয়েছো। তুমি যা বলবে আমরা তাই করব। তুমি তোমার দুহাত ঝাড়া দাও। দেখবা তোমার এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে।
গ্রামবাসীর ঘুম ভেঙে যায়। তুমুল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পুরা এক বছর পর বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই বৃষ্টিতে ভিজে লাফালাফি শুরু করে দেয়। সবার মনে আনন্দ এলাকা ছাড়তে হবে না দেখে।
কিন্তু যার চোখ হারানোর কারণে এ বৃষ্টির আগমণ তার কথা গ্রামবাসী কেউ জানে না। এরপর থেকে লাইপ্রু যতদিন বেঁচে ছিল ঐ এলাকায় ততদিন পানির অভাব হয়নি।
প্রথম আলো ব্লগে লেখাটি :
শারীরিক কাঠামোর পরিবর্তন দেখে এখানে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া নির্ণয় হয় না। বাজারে যে একবার গেল সে-ই প্রাপ্ত বয়স্ক। একটা শিশুর ১২-১৫ বছর শুধু এ ছোট এলাকাতেই কাটে। এরা রাজধানী শহরের নাম-তো দূরের কথা নিজেরা কোন উপজেলার মানুষ তা-ই জানে না।
একটা খাল বয়ে গেছে এই পাড়ার পাশ দিয়ে। পানির এটাই সম্বল। এতদিন কোন সমস্যা হয় নি। সে পানি দিয়ে চাষবাস করছে। ঘরে ব্যবহার করছে। কিন্তু গত বছর এক সকালে হঠাৎ লক্ষ্য করে খাল দিয়ে আর পানি আসে না। পাড়ার প্রভাবশালী দুজন ব্যাপারটা কি দেখতে যান। বাজারে খবর পান পাহাড় ধসে খালের গতিপথ বদলায় গেছে। এখান দিয়ে আর পানি আসবে না। এর উপর খাঁড়ার ঘা বছর ধরে বৃষ্টির দেখা নেই।
সবার মন খারাপ। মাঠগুলো রুক্ষ হয়ে যায়। ফলন হয় না কিছু। অর্ধাহারে দিন কাটানো শুরু করে এলাকার মানুষ। ভাগ্য ভাল আগে থেকে পোকামাকড় খেত ওরা। ব্যাঙ, সাপ, ললিহট্টা, টিকটিকি, আলো পোকা খেয়ে ওরা পেটের ক্ষুধা সামাল দিতে চেষ্টা করে। একদিন একটা বাঘও পেয়ে যায়। ছোট বাচ্চা বাঘ। এলাকার কারবারী ও হেডম্যানের পরিবার সেটা আগুনে পুড়িয়ে খেয়ে ফেলে। এলাকাবাসীকে এতটুকু দেয় না।
বনের লতা পাতা খেতে খেতে একসময় সেগুলোও শেষ হয়ে যায়। পানির অভাবে আর নতুন করে আর সেগুলো উঠে না। চরম খাদ্য সংকটে পড়ে যায় তারা।
এগুলো দেখে এলাকার শান্ত ছেলে লাইপ্রু সবার অজান্তে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টাতে উঠে বসে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বেশির ভাগ সময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে প্রাণে পানির ব্যবস্থা চায়। এভাবে মাস পার হয়। প্রতিদিন সকাল বেলা সে ঐ জায়গায় যেতেই থাকে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় দেখে সুন্দর আকাশটা কেমন যেন অষ্পষ্ট। সূর্যের দিকে তাকালে চোখে পানি জমে। তারপরও সূর্যের দিকে অবিরত তাকিয়ে থাকা বাদ দেয় না ও। মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠে। বিড়বিড় কথা বলা আগের মতই চলতে থাকে। লাইপ্রু বুঝতে পারে না ওর চোখগুলো অন্ধত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসী এক সময় আর না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় এ এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। অনেক প্রিয় এ এলাকায় আর থাকবে না। সবাই প্রস্তুত হয়। ঘরের বেড়া, চাল ভেঙে ফেলে। পরের দিন সকালে চলে যাবে এরকম কথা হয়।
লাইপ্রুর মন খারাপ। সে এখন চোখে দেখে না। পাহাড়ী এত দূর পথ কিভাবে যাবে? সে চিন্তায় ব্যস্ত। রাতে সবাই ঘুমিয়েছে। লাইপ্রুর ঘুম নেই। সে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে ঐ পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যায় অভ্যস্ততার বশে। চোখে না দেখলেও তার সমস্যা হয় না জায়গাটিতে পৌঁছতে।
আকাশের দিকে অন্ধ লাইপ্রু তাকিয়ে থাকে। কি দেখে কি জানি? তবে হঠাৎ কি যেন হয়? ওর মাথাটা চরম ভাবে দুলতে থাকে। অসহ্য ব্যাথা হয়। কিছুক্ষণ পর মাথা ঢুলানি শেষ হয়। লাইপ্রু এক সময় আবিষ্কার করে ও ঠান্ডা কিছুর ভিতর। হাত দিয়ে ধরে বুঝতে পারে এগুলো মেঘ।
মেঘগুলো কথা বলে উঠে, আমরা আফ্রিকার এক দুর্গম বনের মেঘ। এখানে আসতে পুরা একদিন লেগেছে। তোমার ডাকে চলে এসেছি এতটা পথ। তুমি আমাদের এত ডাকাডাকি করতে কেন? সূর্যের সাথে আমাদের চরম শত্রুতা। আমাদের জন্য সে সূর্যের সাথে ঝগড়া করতে করতে তুমি তোমার চোখ হারিয়েছো। তুমি যা বলবে আমরা তাই করব। তুমি তোমার দুহাত ঝাড়া দাও। দেখবা তোমার এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে।
গ্রামবাসীর ঘুম ভেঙে যায়। তুমুল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পুরা এক বছর পর বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই বৃষ্টিতে ভিজে লাফালাফি শুরু করে দেয়। সবার মনে আনন্দ এলাকা ছাড়তে হবে না দেখে।
কিন্তু যার চোখ হারানোর কারণে এ বৃষ্টির আগমণ তার কথা গ্রামবাসী কেউ জানে না। এরপর থেকে লাইপ্রু যতদিন বেঁচে ছিল ঐ এলাকায় ততদিন পানির অভাব হয়নি।
প্রথম আলো ব্লগে লেখাটি :