সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

দীর্ঘশ্বাস ( গল্প )

রেল লাইনের ধারে বস্তিটা। বেশ কয়েকবার উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে প্রভাবশালী মহল। বস্তিবাসী সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকায় পারে নি। একবার তো আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় বস্তিবাসী। তারপরও বস্তি ছাড়ে নি। আবার আস্তে আস্তে বাসা বেঁধেছে ওরা। ...........


বস্তির দক্ষিণ পাশে একেবারে কোণায় যে বাসাটা তা মনিরের। বাসা বলতে একচিলতে জায়গায় পলিথিনের ছাউনি দিয়ে একটা কাঠামো। পলিথিন যাতে বাতাসে উড়ে যেতে না পারে সেজন্য পলিথিনের উপর বেশ কিছু পাথর আর ইট আছে। ট্রেন যখন যায় তখন বাসাটা কেঁপে উঠে। মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকতে হয়। বাসায় ঢুকে দাঁড়ানো যায় না। বসে থাকতে হয় কিংবা শুয়ে।

মনিরের দুই মেয়ে। দুইটাই ছোট। নাম রেখেছে ময়না আর শেরুফা।

মনির শ্রমিকের কাজ করে। কাজ করার উপর টাকা। যেদিন কাজ করবে সেদিন টাকা। যেদিন করবে না সেদিন টাকা নেই। মনিরের বউ তাছলিমা ও কাজ করে। তিন বাড়ীতে বুয়ার কাজ করে। ময়না আর শেরুফা তখন দাদীর কাছে থাকে। দাদীর সাথে গল্প করে।

দাদী অসুস্থ। ময়না আর শেরুফা দাদীর মাথার পাশে বসে আছে। দাদী একটা ছেড়া কাঁথায় শোওয়া। গায়ে গোলাপী রঙের রিলিফের কম্বল। যদিও ময়লা হতে হতে কম্বলের রঙ কালচে হয়ে গেছে। দাদীর মাথা ব্যথা করছে। তাই শেরুফা মাথা টিপে দিচ্ছে।
-দাদী তোমার সব চুল তো সাদা হইয়া গেছে।
-বুড়া হইছি সাদা হইবো না? তুই যহন বুড়া হইবি তোরও সাদা হইয়া যাইবো।

ময়না আব্দার ধরে দাদী একটা গল্প কও।

দাদী গল্প ধরে। না রুপকথার কোন গল্প না। নিজেন জীবনের গল্প।

-আমাগো বাড়ীর পিছনে আম গাছ সহ আরো গাছ আছিলো। তা হেই গাছগুলোতে অনেক আম ধরত। ভোরে উঠলেই দেখা যাইতো গাছের নীচে অনেক আম পইড়া আছে। এত আম খাইবো কেডা? তোর দাদারে কইতাম, কিছু আম বাজারে লইয়া যাইতে। বিক্রী করলে কিছু টাকা আইবো। কিন্তু তোর দাদারে কোন মতেই রাজি করানো যাইতো না। ঘরের আম ক্যান বিক্রী করবে? বিভিন্ন জনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো তোর দাদা।

আমের কথা শুনে ময়নার জিবে পানি এসে যায়। রাস্তায় মোড়ে বেশ কিছু ফলের দোকান আছে। হলুদ রঙের সুস্বাদু আমগুলো সাজানো থাকে। খাইতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু পায় না। বাবা যে আম আনে না তা না। মাঝে মাঝে আনে। তবে সেগুলো অর্ধেক খাওয়া যায় অর্ধেক খাওয়া যায় না। যেসব আম নরম হয়ে যায় অর্ধেক পঁচে যায় সেগুলো অল্প দামে কিনে আনে মনির। তারপর বাসায় সবাই মিলে মজা করে খায়। ইশ গাছের আম তো অনেক তাজা। অনেক মজার। দাদী আমাগো যদি গাছগুলো থাকত। কি ভালা হইতো। আমি গাছে উডে আম খাইতাম।

দাদী দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। সব ভাগ্য। কি সুন্দর সাজানো জীবন ছিল। আধা পাকা বাড়ি ছিল। হঠাৎ একদিন দেখে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। বিকালের দিকে নদী ভাঙন শুরু হয়। নদীতে বাঁধ ছিল। কিন্তু দুই নম্বরী ব্লক দেওয়া হয়েছিল যে কারণে পানির বেশি কষ্ট করতে হয় নাই। রাতের মধ্যেই পুরা গ্রাম নদী গর্ভে হারিয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাড়ি হারায় গ্রামের সবাই।

-বাড়ি হারানোর দুঃখে তোর দাদা তহন থাইক্যা কেমন যেন হইয়া যায়। মাতবল কমে যায়। কিছু কইলে হু হু কইরতো। নিজে কথা কইতো না। বেশি খারাপ হলে তোর বাবা সরকারি হাসপাতালে লইয়া ভর্তি করাই দেয়। হে আনেই মারা যায়।

কিছুক্ষণ থামেন শ্বাস নেওয়ার জন্য। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আবার শুরু করেন, আমাগো হেই বাড়ী থাকলে তোরা আম জাম কাঁঠাল সব খাইতে পারতি। দাদী আর কথা বলতে পারেন না। মাথা ব্যথা অনেক বেড়েছে। সাথে পেটের ভিতরও ব্যথা করছে।

দুপুরের দিকে তাছলিমা ফিরে আসে। শ্বাশুড়ির মাথায় তেল ঢেলে দেয়। পেটেও গরম সরিষার তেল মালিশ করে দেয়।

এই বস্তিতে এক এনজিও কাজ করে। তাদের একজন ডাক্তার আছে। সপ্তাহে একদিন আসে। সে ডাক্তারকে গত বুধবার দেখানো হয়েছিল। কিছু ওষুধের নাম লিখে দিয়েছে।

মনির প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধের দোকানে গিয়েছিল। কিন্তু প্রতিটা ক্যাপসুলের দাম ৫০ টাকা করে। তাই দুইটার বেশি আনা হয় নাই। ক্যাপসুলটা খাইলে ব্যথা ভাল হয়ে যায়। এখন ক্যাপসুল নাই।

তছলিমা শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকান। মুখ কুঁচকায় আছে। ঠোঁট গুলো শুকনা কটকটে হয়ে গেছে। বুঝা যাচ্ছে ব্যথা অনেক বাড়ছে।

-মা চিন্তা কইরেন না। ময়নার বাপ আইলে ওষুধ আনতে কমু। ওষুধ খাইলে ব্যথা ঠিক হইয়া যাইবো।

সন্ধ্যায় মনির আসে।
-বউ খাওন দাও। মা-র কি অবস্থা?
-ওষুধ আনান লাইগবো। আমার কাছে ত্রিশ টাকা আছে। লইয়া যাইয়েন। মা-র লাইগ্যা ওষুধ আনেন।
-এহনই যাইতেছি। বলে উঠে দাঁড়ায় মনির।

দাঁড়ান, এহনই যাইতে হইবো না। মা অহন ঘুম যাইতেছেন। আপনি খাইয়া লন আগে। সারাদিন উপোষ আছিলেন।

মনির খেতে বসে। ওর আলু ভর্তা অনেক ভাল লাগে। আজ আলু ভর্তা করা হইছে। ভাল লাগছে। যদিও ভাত শক্ত। সমস্যা নেই। এখনও তো দাঁত আছে।

এসময় কিছু মানব ছায়া দেখা যায়। ঘরে ঢুকে তিন জন পুলিশ। কিছু বুঝার আগেই উলট পালট করে দেয় ঘরের সব। হাড়ি পাতিল সব এদিকে ঐদিকে ছুড়ে মারে তল্লাশীর নামে। ময়না আর শেরুফা ভয়ে দাদীর বুকের কাছে লেপ্টে থাকে।

বস্তির আরো অনেক বাসায় এরকম তল্লাশী চালায়। আগামী কাল হরতাল। সে উপলক্ষ্যে বস্তিতে এই অপারেশন। অনেক পুরুষকে আটক করা হয়।

মনির মা-র অসুখের কথা বলে। লাভ হয় না। বরং একটা লাঠির আঘাত জুটে।

অনেকের সাথে তাকেও থানায় আটক রাখা হয়।

হঠাৎ এক নেতাকে দেখে মনির। আগে হরতালে এই নেতার পক্ষ হয়ে কাজ করছে। পিকেটিং করছে। যে টাকা দেবে বলছিল তা দেয় নাই। এখন এই নেতা প্রভাবশালী। তার দল ক্ষমতায়।

মনির ঐ নেতার কাছে মুক্তির আব্দার জানায়। এই কি নেতা ওর দিকে তাকায় না পর্যন্ত। অথচ এই নেতার সাথে কত মিছিল করেছে।

চলে যায় ঐ নেতা। এক পুলিশ সদস্য বলে, ঢিলা কোথাকার। ঐ নেতাই তো তোদের নাম গুলো দিলো ধরার জন্য। আর তুই সে নেতার কাছে মুক্তির জন্য বলছিস।

মনির বুঝে না। বিহবলের মত তাকিয়ে থাকে। মায়ের ওষুধ কি আনা হয়েছে?

মনির দেখে। একটু পর পর এক একটা দল আনা হচ্ছে। জায়গা হচ্ছে না থানায়। চিপাচিপি করে রাখা হয়েছে। হয়ত আরো আনা হবে।

যাদের আনা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই শ্রমজীবি মানুষ। ওদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ।

( স্বাধীন দেশে হরতাল ঠিক না। হরতালে সরকারের কি ক্ষতি হয় জানি না তবে এটা জানি জনগণের সীমাহীন দুর্ভোগ হয়। হরতালের বিকল্প ভাবার সময় এসেছে। অবসান হোক নষ্ট রাজনীতি )