শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

গন্ধ ( গল্প )

লাশের গন্ধ। একটা লাশের গন্ধ। নাকে এসে লাগছে তীব্র সে গন্ধ। ফজলুল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। নাক শুঁকে দেখার চেষ্টা করছেন এই গন্ধ আসছে কোথা থেকে। মনে হচ্ছে এখানে কেউ লাশ ফেলে গেছে। এমনও তো হতে পারে খুন করে এখানে গুম করা হয়েছে। এটা মনে হতেই ভয় যেন আরো বাড়ল। ডাক দিলেন আবুলকে। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই।...............


আরো কয়েকবার ডাকলেন। লাভ হলো না। কই গেল? অন্য সময় একবার ডাকেই সাড়া দেয় অথচ আজ এতবার ডাকেও সাড়া নেই। আবুল মারা যায় নি তো। আঁতকে উঠলেন তিনি। এই গন্ধটা আবুলের লাশের গন্ধ নাতো? তাহলে মহা মুসিবত হয়ে যাবে। এম্নেই দলের কয়েকজন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এখন যদি এরকম কিছু ঘটে তাহলে নিশ্চিত কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে। আচ্ছা এটা ওদের ষড়যন্ত্র নাতো। খুনের দায় চাপাতে কেউ মেরে গেল আবুলকে। আর সে মামলায় তাকেও ফাঁসানো হবে। লাশ পাওয়া গেলে এখনি দূরে কোথাও গুম করতে হবে।

টেবিলের উপর পানির বোতল। সাথে বিদেশী মদের বোতলও আছে। সকালে আবুল এনে রেখেছে। ফজলুল সাহেবের পানির পিপাসা লাগে। কিন্তু মাথা কাজ করছে না। ফজলুল সাহেব পানির বদলে মদের বোতল হাতে নেন। গড় গড় করে খেয়ে নেন বোতলের অর্ধেকটা।

এখন আর মদে আগের মত নেশা ধরে না। বেশি খেতে খেতে এই অবস্থা। আবার ডাকেন আবুলকে। নাহ সাড়া নেই। দরজার বাহিরে এসে চারদিকে চোখ বুলান। কোথাও নেই আবুল।

জায়গাটা শহর থেকে দূরে। চারদিকে গাছপালা। এখানে লোকজনও কম রেখেছেন। যাদের রেখেছেন তারা সবাই বিশ্বস্ত।এখানে ফূর্তি করেন। ভারতের সীমান্তের সাথে এটা। দালাল আছে । মাঝে মাঝে বর্ডারের ঐপাশ থেকে অল্পবয়সী মেয়ে নিয়ে আসে। এই কাজ গুলো আবুল করে। দেশের মেয়েদের সাথে কিছু করলে তা মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইদিক থেকে নিরাপদ থাকতেই বাহির থেকে আনা হয়।

ফজলুল সাহেবকে বাহিরে দেখে বক্কর এগিয়ে আসে। বাবুর্চি সে। এই সময়ে স্যার কখনো বের হন না। তাই অবাক হয় ও। “ স্যার কিছু লাগবে? ”

-আবুল কই গেছে? আবুলকে ডাকো।
স্যার সকালে একবার আবুলকে দেখছিলাম। এরপর আর দেখি নাই।
-দেখো নাই কেন?
-স্যার আবুল ভাইতো আমারে কখনো বলে যায় না। আমি কোথাও যাইতে লাগলে উনারে বলে যাই।
-এবার থেকে যে বের হয় আগে থেকে যে কাউকে বলে যাবা। না বলে যেন কেউ বাহির না হয়।

বক্কর মাথা ঝাঁকায়। জ্বী স্যার উনারে বাহির হতে দেখলে জিজ্ঞেস করে নিমু কই যাইতেছে তা।

ফজলুল সাহেবের মাথা ঘুরায়। তবে তা নেশার কারণে না। আবুলের চিন্তায়। আবুল সব সময় তার পাশেই থাকে। আবুলের কিছু হলে সাংবাদিকরা হাজারো রকম প্রশ্ন করবে। দলে যারা প্রতিপক্ষ তারা প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে যে আবুলকে হত্যার জন্য তিনিই দায়ী।

বক্করকে বলবেন নাকি লাশের গন্ধের ব্যাপারে। গন্ধের কথা মনে হতেই তা আবার নাকে এসে লাগে। বলতে গিয়েও বলেন না। বক্কর ভয় পাবে। থানা পুলিশ করতে চাইবে। এখন যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।

দুপুরে দলের প্রধানের সাথে মিটিং আছে। সেখানে যেতে না পারলে প্রতিপক্ষরা উল্টাপাল্টা বোঝাবে তার সম্পর্কে। যাওয়া উচিত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যাওয়া যাবে না।

নিজ রুমে ঢুকেন। গন্ধটা বেড়েছে। একেবারে নাকে এসে আঘাত হানছে। খাটের নিচে উঁকি দেন। নাহ এক্কেবারে খালি। কিছু নেই। আলমারীতে রাখে নাই তো লাশ?

আলমারীর চাবি বের করেন ড্রয়ার থেকে। বিশাল আলমারী। আলমারী খুলে দেখেন। নাহ সেখানেও নাই। তাহলে গন্ধটা আসছে কোথা থেকে?

লেমন ফ্রেশনারের স্প্রেটা হাতে তুলে নেন। নিজ হাতে কখনো স্প্রে করেন না। আবুলই স্প্রে করে দেয়। চারদিকে স্প্রে করে দেন।

গন্ধ দূর হয়। কিন্তু তা কিছুক্ষণের জন্য। আবারো গন্ধ। লাশের কথা ভুলার জন্য অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করেন। যা হবে হোক আজ মিটিংয়ে যাবেন সিদ্ধান্ত নেন।

ব্রিজের টেন্ডারটা মহসিনকে পাইয়ে দিতে হবে। মহসিন তার পক্ষের ক্যাডার। কোথাও শক্তিঘটিত কিংবা অস্ত্র নিয়ে সমস্যা হলে মহসিনকে বললেই হয়। সে খতম করে দেয় সমস্যা। সাহসী। ভয় পায় না কিছু। পার্টি অফিসে দেখা হয়েছিল গত বুধবার। দেখেই সালাম দেয়। “ স্যার ব্রিজের কাজটা আমি পাচ্ছিতো?”
ফজলুল সাহেব মহসিনের পিঠ চাপড়ে বলছিলেন, অবশ্যই। তুমিই পাবা।

রাজনীতিবিদ হলে এই এক ব্যাপার। কখনো না বলা যায় না। সব কাজে হা। ছাত্ররাজনীতি যখন করতেন তখন থেকেই এই হা বলা। কেউ বিভাগ পরিবর্তন করবে। অথচ বিভাগ পরিবর্তনের সময় শেষ হয়ে গেছে। যদিও জানে না ঐ শিক্ষার্থী। তা সাহায্যের জন্য আসলে বলে দিত, সমস্যা নাই। হয়ে যাবে। আশ্বাস দেওয়া ছাড়া বড় নেতা হওয়া যায় না।

তবে মহসিনের ব্যাপারে শুধু আশ্বাস দিলে হবে না। কাজটা পাইয়ে দিতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়লে ডাকলে নানা অজুহাত দেখিয়ে আসবে না। একসময় নিজেও এরকম করতেন। কোন নেতা কাজ না দিলে এরপর থেকে ঐই নেতা কোন সাহায্যের জন্য ডাকলে যেতেন না।

লাশের গন্ধ বাড়ছে। এত তাড়াতাড়ি লাশ পঁচে নাকি? এরকম গন্ধ বাড়ছে কেন তাড়াতাড়ি? বমি আসতে চায়। ফজলুল সাহেব টেবিলের উপর থেকে মদের বোতলটা নেন। ঢক ঢক বাকীটুকুও খেয়ে ফেলেন। তারপর চেয়ারে বসে পড়েন।

নেশা ধরে না। লাশের গন্ধ আরো বাড়ে। হঠাৎ নিজের মাথা নিচু করেন। প্রথমবার অবিশ্বাসের সাথে শুঁকেন। দ্বিতীয় বার আবার। ভাল ভাবে শুঁকেন ভিতরে যত বাতাস আছে নাক দিয়ে সব বাতাস টেনে গন্ধের উৎস ধরার চেষ্টা করেন। পাওয়া গেছে। কিন্তু এই কি? লাশের গন্ধ তার শরীর থেকেই আসছে। কিন্তু তিনি তো জীবিত। তার শরীর থেকে গন্ধ আসবে কেন?

আরো কয়েকবার গন্ধ নেন। নাহ ভুল না। তার শরীর থেকেই আসছে এই বিদঘুটে গন্ধ। বক্করকে ডাকেন।

বক্কর ছুটে আসে।
-কোন গন্ধ পাচ্ছো?
বক্কর নাক দিয়ে শুঁকে চারপাশটা। - জ্বী স্যার, লেবুর গন্ধ চারদিকে।
-অন্য কোন গন্ধ পাচ্ছো না?
আবার চারপাশটা শুঁকে নেয় বক্কর। না স্যার আর কোন গন্ধ নাই।

বাথরুমে ঢুকে গোসল সারেন ফজলুল সাহেব। নাহ গন্ধ যায় নি। বরং বেড়েছে। নাকের সমস্যা নাকি??

আর ঘর থেকে বের হন না। বিকালে দিকে আবুল আসে। সাথে একটা অল্প বয়স্ক মেয়ে। নীল রঙের সেলোয়ার কামিজ পড়া। মাথায় ওড়না। দেখতে কেমন পবিত্র পবিত্র লাগে। অনেক সুন্দর মায়াবী মুখ। এই মেয়ে এসব করে ভাবতে অবিশ্বাস লাগে।

তবে ফজলুল সাহেব আজ মেয়ে সঙ্গ নেন না। লাশের গন্ধের কারণে ঘুমাতে পারেন না রাতে।

পরের দিন সকালে নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ এক ডাক্তারের কাছে যান। সেখানে দেখেন লতিফ সাহেব বসা। এই ব্যাটার হেভি বুদ্ধি। অল্প দিনেই অনেক টাকা বানায় নিয়েছে। একই দলের রাজনীতিবিদ। ওনার আবার কি সমস্যা?

সালাম দেন ফজলুল সাহেব। -আপনার আবার কি সমস্যা?
লতিফ সাহেব বলেন, আমারো তো প্রশ্ন আপনারই বা কি সমস্যা? যে কারণে এত সকালে ডাক্তারের কাছে ছুটে এলেন।

সমস্যার কথা কেউ বলেন না।
ফজলুল সাহেব বলেন, কাল পরিবারে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেজন্য মিটিংয়ে যেতে পারি নাই। মিটিংয়ে কি কি আলোচনা হয়েছে?

লতিফ সাহেব বলেন, আমিও একটা কাজে আটকা পড়ায় মিটিংয়ে যেতে পারি নাই। আমি তো ভাবলাম আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালই হলো। মিটিং সম্পর্কে জানা যাবে।

কিন্তু ডাক্তারের কাছে আসার আসল কারণ কেউ বলে না। ঐ মিটিংয়ে আরো বেশ কয়েক জন অনুপস্থিত ছিল। যারা একই রকম সমস্যায় ভুগছে। দেখা গেছে যারা দুর্নীতি করে বেশি টাকা করে ফেলছে অল্প সময়ে তারাই এই লাশের গন্ধে আক্রান্ত।

ওরা শুধু লাশের গন্ধ পায়। ডাক্তাররা এই রোগের কারণ ধরতে পারছেন না। রোগের প্রতিকারও হচ্ছে না। লাশের গন্ধে পার হচ্ছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সময়। অন্য কোন কাজ করতে পারছে না। ওরা মুক্তি চায় লাশের গন্ধ থেকে। আর জাতি মুক্তি চায় ওদের থাবা থেকে। কোনটা হবে?


# রচনাকাল-সকাল ৭.০৫ , ১৪ আগস্ট,২০১০।