শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

প্রতিযোগিতা (গল্প)

বইয়ের প্রতি আসক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে তুলির। হাতের মধ্যে একটা বই। ভূতের সব গল্প। আগে হলে এক বসাতেই পড়ে ফেলত। কিন্তু এখন কেন জানি ভাল লাগে না। বইয়ের মাঝে ডুবে থাকার জন্য কত্ত বকা যে খেয়েছে তার হিসাব নেই। চোখ খারাপ হবে এভাবে রাত দিন বই পড়লে। মা সব সময় বলতেন। এখন মা ইটালিতে আছেন। ................

বাহিরের বই পড়লেও পাঠ্য বইয়ের প্রতিও খেয়াল থাকে। ওর ফলাফলই তা বলে। ওর খাতায় নম্বার কম দেওয়ার জন্য স্যারদের অনেক কষ্ট করতে হয়। বিশেষ করে যেসব স্যার নাম্বার কম দিতে চান শিক্ষার্থীদের তাদের জন্য অনেক কষ্টের হয় তুলির খাতা। এত সুন্দর, বিস্তারিত লেখায় নম্বর কম দেওয়া বেশ কঠিন। কিছু কিছু স্যার আছেন যারা নাম্বার দিতে আনন্দ পান। তাদের কাছে তুলির খাতা আসলে তারা চোখ বন্ধ করে নাম্বার দিয়ে দিতে পারেন।

নতুন একজন এসেছে ওদের ক্লাসে। ক্রিস্টা নাম। আগের স্কুলে নাকি রোল এক ছিল। অনেক ব্রিলিয়ান্ট। তা বুঝা গেছে প্রথম দিনই। ইংরেজীতে স্যারকে তো প্রশ্ন করে রীতিমত বিপদে ফেলে দিয়েছিল।

প্রথম দিন এসেই জানতে চাইল এ ক্লাসে রোল এক কে?
অন্যরা দেখিয়ে দিল তুলিকে।

তুলির সাথে পরিচিত হতে আসে। আমি ক্রিস্টা। যদিও নামে মনে হচ্ছে খ্রিস্টান। তবে আমি খ্রিস্টান না। মুসলমান। আমার বাবা খ্রিস্টান ছিল। বাবাই এই নাম রাখছে। যদিও আমার বাবা এখন আর আমাদের সাথে থাকেন না। মায়ের সাথে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

তুলি অবাক হলো। প্রথম পরিচয়েই এত কথা বলে দেয়? নিজের ব্যক্তিগত সব কথা।

তুমি অবাক হচ্ছো তাই না। আমি এমনই।

তুলি বলল, না না। ঠিক আছে। আমি তুলি।

হা তোমার নাম জেনেছি। তুমি এই ক্লাসের রোল এক। কিন্তু এখন একটা সমস্যা হয়ে গেছে।

তুলি হাতের খাতাটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে জিজ্ঞেস করল, কি সমস্যা?

আমি এক না হয়ে থাকতে পারি না। অন্য কেউ এক হবে এটা কেন জানি মেনে নিতে পারি না। বিরক্ত লাগে। কখনো একের বাহিরে থাকি নাই তো। সেজন্য। আর দেখো এই স্কুলে এসে আমার রোল এখন ৪৮।

তুলি হেসে উঠে।
হাসছো কেন?
-তুমি সবার শেষে এসেছো। তাই তোমার রোল ৪৮। পরীক্ষা দিয়েই এক হয়ে যেতে পারবা?
এবার ক্রিস্টা হেসে উঠে। তুমি যেভাবে বলছ মনে হচ্ছে পরীক্ষা দিলেই এক হয়ে যাওয়া যায়। হা হা হা।

পরের ঘন্টার শিক্ষক এসে যাওয়ায় আর আর গল্প হয় না দুজনের।

দুজনের বন্ধুত্ব জমে উঠে। তবে যতই বন্ধুত্ব জমে উঠুক না কেন সমস্যা একটাই দুজনই এক হতে চায়। অন্য কেউ এক হবে তা সহ্য করতে পারবে না কেউ তা ওদের মনোভাব দেখলেই বুঝা যায়।

ইটালি থেকে তুলির মা ফোন করে সন্ধ্যায়।
-কেমন আছিস?
-ভাল আছি। তুমি কখন আসছো।
-আমার এই কোর্স শেষ হতে আরো ৪ মাস লাগবে। এর পর দেখি।
- মা কি হবে এত কোর্স শেষ করে। আমি তোমাকে অনেক মিস করছি।
মা হাসেন।
-আচ্ছা তুই নাকি প্রতিদিন টেবিলে বসে থাকিস অনেক রাত পর্যন্ত। এখন কি গল্পের বই টেবিলে বসে পড়িস? আগে তো শুইয়ে শুইয়ে পড়তি।
-না, গল্পের বই না। পাঠ্য বই পড়তে হচ্ছে। ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে এসেছে। খুব ব্রিলিয়ান্ট। ওর নাকি এক ছাড়া ভাল লাগে না। ও যদি আমাকে এবার ফেলে দেয়। এই ভয়ে একটু বেশি পড়ছি।
-ভাল ভাল। তোর জন্য কি পাঠাবো?
- কিচ্ছু লাগবে না। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসো।
-নতুন যে আসছে তার নাম কিরে? কথা বলেছিস ওর সাথে?
-হুম, নাম ক্রিস্টা। মা ও না খুব দুঃখী মেয়ে। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছেন। ওর মা রাত দিন বাহিরে থাকেন। ওর সাথে কথাই বলার সময় পান না। ও যদি ফোন করে কেটে দেয়। ওর নানুই ওকে দেখাশোনা করে। ওর খুব ইচ্ছা করে মাকে ডাকতে। কিন্তু সুযোগ পায় না। ওর মা অনেক রাতে ঘরেই আসেন না। ক্রিস্টা অনেক ভাল মেয়ে।
-এ অল্প পরিচয়ে তোকে এত কিছু বলল?
-ও অনেক কথা বলে। আরো অনেক কিছু বলেছে। তবে এত কষ্ট ওর তারপরও সব সময় অনেক হাসিখুশী থাকে।
-ঠিক আছে তুই ঠিকমত খেয়ে নিস। আমার ক্লাসে যেতে হবে একটু পর। পরে কথা হবে।

....................................................০২...............................

পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। দুজনেরই পরীক্ষা অনেক ভাল হয়েছে। সবার দৃষ্টি কে প্রথম হয়। ক্রিস্টা অনেক চৌকষ মেয়ে। ক্লাসে স্যারকে অনেক প্রশ্ন করে ফেলে। যেকোন প্রশ্নের উত্তর দেয় সবার আগে। তাই সবার ধারণা ক্রিস্টাই প্রথম হবে। তুলি স্যারদের তেমন প্রশ্ন করে না। স্যাররা ওকে জিজ্ঞেস করলেই মাত্র উত্তর দেয়। অন্যথায় চুপ থাকে।

তুলিরও মন খারাপ। এবার বোধ হয় একটা হাত ছাড়া হবে। ক্রিস্টার প্রতি একটু রাগও হয়। কেন যে আসতে গেল? আর যেন স্কুল খুঁজে পায় নি।

দশটার দিকে রেজাল্ট দেওয়া হলো। শফিক স্যার ক্লাস টিচার। তিনি বললেন, এবার ফাস্ট হয়েছে তুলি।

তুলির বিশ্বাস হচ্ছিল না। হারানো গেল ক্রিস্টাকে। অনেক খুশী লাগছে। ক্রিস্টার দিকে চোখ গেল ওর। দেখে ক্রিস্টার চোখে পানি। রোল এক না হওয়ায় নিশ্চয় অনেক মন খারাপ হয়েছে। এত হাসিখুশী মেয়েটা এভাবে কাঁদছে।

স্যার যাওয়ার পর স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে ক্রিস্টাকে। ক্রিস্টা বলে, না ঠিক আছে। তুমি ভাল করছো, তোমাকে অভিনন্দন। মিস্টি খাওয়াচ্ছো কখন? নাহ নাহ মিস্টি নাহ। আমি মিস্টির চেয়ে আইসক্রিম বেশি পছন্দ করি। আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে হবে বলে দিচ্ছি।

অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণের চেষ্টা করে ক্রিস্টা। কিন্তু কান্না চেপে রাখতে পারে না। কান্না উগলে পড়ে কথায়। রোল এক হাত ছাড়া হবে কখনো ভাবে নি।

তুলির নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ধূর! রোল এক করাটাই ভুল হয়েছে। ক্রিস্টার মনে এম্নেই এত কষ্ট। তার উপর এক না হওয়ার কষ্ট।

তুলি ক্রিস্টাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনেই কাঁদে। প্রতিযোগিতায় জয় পরাজয় আছেই। তারপর পরাজিতের জন্য এমন কান্না একটু অন্যরকমই দেখায়।

তবে তুলি জানে না ক্রিস্টার মত অন্য এক কষ্টও তাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে। তুলির মা ইটালিতে যে আছেন সেখানে একজনকে পছন্দ করেছেন। ঐ লোকের সাথে সেটেল হওয়ার চিন্তা করছেন।

ওদের মধ্যে এ যেন কষ্টের প্রতিযোগিতা।

তুলি যেহেতু জানে না ব্যাপারটা। তাই ব্যাপারটা ওর জন্য গোপনই থাকুক।