বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আনন্দের অশ্রু ( গল্প )

বই গুলো সব আগাছোলা টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে। শুধু যে টেবিলের উপর আছে তাই নয়। খাটের উপরও বেশ কয়েকটি বই খোলা রাখা। পুরা এলেমেলো অবস্থা। মুহিন সব সময় এরকমই রাখে। কোন গোছগাছ বলতে কিছু যেন ওর মধ্যে নেই। এখন ক্লাস করতে চলে গিয়েছে। এরকম রেখেই চলে যায়।
মা লতিফা বেগম ছেলের বই পত্র গুছিয়ে দেন। একই আকৃতির বইগুলো একসাথে বইয়ের সেলফে রাখেন। আর খাতাগুলো রাখেন পাশেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুন্দর গোছগাছ হয়ে যায় রুমটি।.............


সন্ধ্যায় পড়ার সময় মুহিনের চিৎকার শোনা যায়, মা আমার ইংলিশ গ্রামারের শিটটা কই?

-বুক সেফলফে দেখ, সেখানেই আছে।
- খুঁজতে গিয়ে আবার বই পত্র এদিকে ঐদিকে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু পাওয়া যায় না শিটটি। সব বই খাতা এদিক ঐদিক ফেলানো। যেটা প্রয়োজন সেটাই পাওয়া যাচ্ছে না।

Ñ মা, পাচ্ছি না। এখনই আমার শিটটা খুঁজে দাও। কি বিপদে যে ফেল।
লতিফা বেগম আসেন। তিনিও খুঁজেন।পাওয়া যায় না। টেবিল, খাটের উপর যা যা পেয়েছেন সবই তো সেলফে রাখা হয়েছে। যাবে কোথায় তাহলে।

-তুই বোধ হয় তা অন্য জায়গায় রেখেছিস। এখানে রাখলে তো পাওয়া যেতো। তোর ব্যাগে দেখতো।
- তুমি কি না বলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি টেবিলের উপর রেখেছি। আমি তো সেটা ক্লাসে নিয়ে যায় নি। ব্যাগে রাখবো কোন দুঃখে। তারপরও যখন বলছো খুঁজে দেখছি।

ব্যাগের সব কিছু বের করা হয়। কিন্তু শিটটার হদিস পাওয়া যায় না।

-মা তুমি আর আমার বই পত্র গুছাবে না।
-তুই এভাবে রেখে যাস কেন? তুই গুছিয়ে রাখলেই তো পারিস।
- আমার গুছিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে না। আর তোমাকেও গুছাতে হবে না।

রুক্ষ ভাবে বলে মুহিন। কথার মধ্যে প্রকাশ পায় তেজ।

লতিফা বেগমের খারাপ লাগে। তার স্বামীর প্রায়ই সময় বাজে ব্যবহার করে। অতি বদমেজাজী। ছেলেও কি ঐরকম হয়ে যাচ্ছে।

-তুই এভাবে বলছিস কেন?
-কিভাবে বলছি। শিট হারিয়েছো। এখন কিভাবে বলব। উল্টা পাল্টা কাজ করো সব।

লতিফা বেগমের কান্না আসে। অনেক কান্না। এই ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। আর এই ছেলেই যদি এরকম ব্যবহার করে।

খাবারের ক্ষেত্রেও অসম্ভব জ্বালায় মুহিন। কোন কিছু পছন্দ না হলে তা ফেলে দেয়। ছুড়ে মারে ফ্লোরে। ফ্লোর তরকারিতে ভিজে যায়। লতিফা বেগমের সেগুলো মুছতে হয়।

তারপরও ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তিনি। সব মায়েরা দেখে। তাকেও দেখতে হয়।

০২......
প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়ার সময় কবির সাহেব গুণে গুণে হিসাব করে টাকা দেন। মুহিন গাই গোই করলেও লাভ হয় না। একটুও বেশি দেন না। শুধু গাড়ির ভাড়া আর টিফিনের জন্য যা লাগে ততটুকুই দেন। একটুও বাড়তি দেন না।

সকালে স্কুল থেকে ফিরেছে মুহিন। হাতে পলিথিনের ব্যাগ। মা একটু আসবা।

লতিফা বেগম আসেন।

-পলিথিনে কি এনেছিস।
-তুমিই খোল।

মা খোলেন। বের হয় একটা সুন্দর শাড়ি। ঘিয়া রঙের।

-আজ মা দিবস। তোমার জন্য আনলাম।
মা-র মন খুশীতে ভরে যায়।
-তুই টাকা পেলি কোথায়?
-টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনেছি।
লাজুক গলায় বলে ফেলে মুহিন।

টিফিনের জন্য অল্প টাকা দেওয়া হতো। আর সে টাকা জমিয়ে শাড়ি কিনে ফেলেছে। নিশ্চয় অনেক দিন লেগেছে এতগুলো টাকা জমাতে। এতদিন না খেয়ে ছিল।

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন মা। চোখ থেকে পানি বের হয়। এই পানি যে মহা আনন্দের পানি। অনেক অনেক আনন্দের পানি। চোখের পানি কিছু মুহিনের উপর পড়ে।

-মা, তুমি কাঁদছো কেন?
উত্তর দিতে চান লতিফা বেগম। কিন্তু গলা ধরে আসে। তিনি পারেন না কিছু বলতে। শুধু কান্নার তীব্রটাই বাড়ে। সুখের কান্না যে এত বেশি শক্তিশালী হয় তা এই প্রথম বুঝতে পারলেন।