শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৫

দৃশ্য (অনুগল্প)

শেষ পর্যন্ত হিসাব মিললো না। মেলার কথাও না। নিজ দেশের দুইজনের মধ্যেই যেখানে শুভ পরিণতির দিকে যায় না সেখানে দুই দেশের।
এরপরও জুলিয়া সর্বশেষ চেষ্টা করেছে। ওই দেশে কয়েকটা ভাষা শিক্ষার কোর্স থাকলেও বাংলা ভাষা শিক্ষার কোর্স কোন প্রতিষ্ঠানে নেই। কি আর করা। আরিফকে চমকায় দিতে হবে। দেড়শ কিলোমিটার দূরে লইয়াঞ্জ শহরে কিছু বাংলাদেশি থাকে। সেখানে একটা কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। একটা বড় বাজারও আছে যেখানে বাংলাদেশি প্রায় সব কিছু পাওয়া যায়। ওইসব দোকানে সাধারণ ওই দেশের নাগরিকরা কাজ করে না। এটা একটা সম্মানের ওপর আঘাত বটে। কিন্তু জুলিয়া ওইসবের ধার ধারেনি। তাকে বাংলা শিখতেই হবে। সেখানে একটা দোকানে সেলসগার্লের কাজ নিলো। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে এতটুকু পথ নিজে ড্রাইভ করে চলে যেতো।

জুলিয়ার যে চাকরি দরকার তাও না। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবার মৃত্যুর পর ওর নামে অনেক সম্পদ উইল করে দিয়ে গেছে। মা অন্য এক লোকের সাথে বিয়ে বসেছে। জুলিয়ার সাথে ওর মায়ের তেমন যোগাযোগ নেই। জুলিয়াই রাখে নি। প্রথম দিকে রাখত। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখলো তার সাথে যোগাযোগে মায়ের কোন আগ্রহ নেই। তখন সেও বাদ দিয়ে দিলো।
গাড়ি চালাচ্ছে জুলিয়া। অডিউ ডিভাইসে একটা গান বাজছে। এদেশের কেউ গানগুলো বোঝার কথা না। জুলিয়াও বুঝতেছে না। কেমন নরম নরম সুর। কি বলা হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। তারপরও তার অদ্ভূত ভাল লাগছে। কেননা এটা আরিফ গিফট দিয়েছি। যাওয়া আসার পথে এ গানগুলোই শুনে। বাংলাতে রবীন্দ্র সংগীত বলে। কথা গুলো বোঝা যাচ্ছে না তারপরও কেমন একটা আবেশ আনে দেয়....
আরিফের পরিবারের গল্প গুলো যখন শুনে তখন জুলিয়ার ইচ্ছা করে বাংলাদেশে চলে যেতে। পরিবারগুলো কি সুন্দর বন্ধনে আবদ্ধ। মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে নেওয়ার চিন্তা কেউ সেখানে করে না। বাসার সবাই একসাথে বসে খাবার খায়। খাবার খেতে গেলে কি সুন্দর আড্ডা হয়। অনেক বেশি ইচ্ছা করে আরিফের সাথে চলে যেতে....

গত একমাস ধরে বাংলা শিখছে। কিছু কিছু শব্দ আয়ত্বে এসেছে। জুলিয়ার ভাবতে ভাল লাগে আরিফকে বাংলা বলে অবাক করে দেবে। তার কলিগ থেকে শুনেছে বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে নাকি মেয়েরা রুমালে ফুল তুলে তার প্রিয় মানুষকে দেয়। জুলিয়া কয়েকটা দোকান ঘুরে সুই সুতা সংগ্রহ করে। ওর নিজের কাছে খুব দামী একটা রুমাল আছে। সেটা নিয়ে যায়। ওই কলিগকে সেখানে লিখে দিতে বলে, আমি তোমাকে ভালবাসি একথাটা রুমালে লিখতে। ওইটায় সুই সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলবে। কলিগটা অবাক হয়।
ছয় মাসের মধ্যে বাংলা অনেকটা আয়ত্বে এসে যায় জুলিয়ার। আরিফের সাথে দেখা করতে যায়। সাথে রুমালও নিয়ে যায়।

আরিফের মুখ শুকনো। ও কাচুমাচু করতে থাকে। ওর কাচুমাচু দেখে বাংলায় কিছু বলতে সাহস হয় না। চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকে আরিফের কথা শোনার জন্য।
আরিফ বলে, একটা সমস্যা হয়ে গেছে।

জুলিয়া কিছু বলে না। কি সমস্যা হলো ওর মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন!

আরিফ বলে যায়, বাড়ী থেকে আম্মা ফোন করেছিলেন। আব্বার শরীর অসুস্থ। আব্বা চান আমি যেন একবার দেশে যাই। আব্বার এক বন্ধুর মেয়েকে আব্বু দেখে রেখেছেন। তার ইচ্ছা ওই মেয়ের সাথেই যেন আমার বিয়ে হয়। তুমি তো জানো আমাকে এদেশে পাঠানোর জন্য আব্বু কত কষ্ট করেছে। আমার প্রতি তোমার আবেগের কথা জানি। কিন্তু আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আব্বুর কথা না শুনলে অনেক কষ্ট পাবেন।
জুলিয়া কিছু বলে না। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। স্বান্তনা দেওয়া চেষ্টা করে আরিফকে।
বাসায় আসার পথে গাড়ি চালাচ্ছে জুলিয়া। গাড়ীর মিটার স্প্রীড অনেকটুকু উঠে যায়। বিপদজনক গতিতে গাড়ি চলে। হঠাত করে গতি কমিয়ে আনে গাড়ির। পাগলামী করার মানে কি! ওদের পারিবারিক সম্পর্ক শক্ত বিধায়ইতো তো বাবার কথা রাখতে অপরিচিত একটা মেয়েকে বিয়ে করতে আরিফ রাজি হয়ে গেলো। এটাতে আরিফের তো কোন দোষ নেই। আর ওদের এ বন্ধনটার জন্যই তো সে আরিফকে ভালবেসেছিল। যে বিষয়ে ভালবাসা সে বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেকে ধ্বংস করার কোন মানে হয় না। তবে ওর খারাপ লাগে শেখা বাংলা ভাষাটায় কখনো কথা বলা হবে না। যার জন্য ভাষাটা শেখা সে যখন নাই কি হবে ভাষাটা দিয়ে...... চোখের পানি স্ট্রিয়ারিং ভিজে যায়। একটা মায়াবী সোনালী কেশী মেয়ের থেকে চোখের পানি পড়ছে। অদ্ভূত এক দৃশ্য।

ফেসবুকে : দৃশ্য