সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

দুঃখ ( গল্প )

ঝর্ণার পানি গুলো পড়ছে অনেক উপর থেকে। একেবারে স্বচ্ছ সে পানি। পানির পড়ার একটা সুন্দর শব্দ। পানি যেখানে পড়ছে সেখানে মাটি জমে গেছে। পাথরের মত শক্ত সে স্থান। পানি পাহাড়ের পথ ধরে অনেক দূর ভিতরে চলে যায়। রকিবের ইচ্ছা হয় ভিতরে গিয়ে সেসব পানি কতদূর যায় তা দেখার। কিন্তু যে পিচ্ছিল আর ঘন বন তা সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। বনের লতাপাতা গাছগুলো অনেক সবুজতর হয়েছে। পাতায় লেগে আছে বৃষ্টির পরশ। সে পাতায় হাত দিলে পিচ্ছিল একটা অনুভূতি। রবিন পাতায় হাত দিয়ে সে পানি স্পর্শ করছে। আর শাহীন দেখছে দূরের পাহাড়টা। ওর একটা স্বপ্ন। উঁচু পাহাড় জয়ের। তবে বর্ষা কাল এখন। তাই যাওয়া যাবে না।


এলাকা বাসী এসে গোসল করে ঝর্ণায়। মাঝখানে মাঝখানে কিছু গভীর খাত আছে। সেখানেই গোসল সারে। ছোট ছেলেমেয়েরা ভেসে থাকে সে গর্তে। কি মজা করে গোসল করে ওরা। হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে চোখ চলে যায় রকিবের। কিশোরী মেয়ে। ছোট ছোট চোখ। সে চোখেও দুষ্ট ভাব। গোসল করছে। শরীরে একটা মাত্র কাপড়। সেটাও চুপসে আছে গায়ের সাথে। কি ধবধবে ফর্সা। পানির কারণে সেটা আরো বেশি শুভ্র হয়েছে।
চোখাচোখি হয়ে যায় মেয়েটির সাথে। মেয়েটি একটি মিস্টি হাসি দেয়। কি ঝকঝকে সাঁদা দাঁত। এই ব্যাপারটা দেখে ফেলে রবিন।- দোস্ত চোখ সামলাও। হেভী পিটানি দেবে কিন্তু।

রকিব চোখ ফিরিয়ে নেয়। যদিও এরকম সুন্দর একটা মেয়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া অনেক কষ্টের। বলে, পিটানি দেবে মানে, কি পিটাবে?

অদূরে সাইনবোর্ডের দিকে তাকাতে বলে রবিন। সেখানে লেখা, "সম্মানিত পর্যটক বৃন্দ, এলাকাবাসী গোসল করার সময় এদিকে নজর দিবেন না। "

আসলে তো সতর্ক বার্তা। এটা চোখেই পড়ে নি। তবে এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখা কি থামাতে পারে এই সামান্য নোটিশ? যদিও নোটিশে শাস্তির কথা কিছু লেখা নাই। তিন বন্ধু বেড়াতে এসেছে।

শাহীন সিগারেট ধরায়। ওদের মধ্যে ও-ই একমাত্র সিগারেট খায়। রকিব, রবিন এই একটা কারণে ওর উপর বিরক্ত। শাহীনের সিগারেট ধরানো দেখে যথারীতি বিরক্ত হয় ওরা দুইজনই। তবে রকিব একটু কম হয়। ওর দৃষ্টি সে মেয়ের দিকে। একটা সিগারেট খাওয়া মানা করার চেয়ে সুন্দর মেয়ের দিকে তাকানোই দায়িত্বপূর্ণ কাজ মনে হয় রকিবের। এরকম সুযোগ পড়ে পাওয়া যাবে না, সিগারেট শাহীন আরো অনেক খাবে। ওকে পরেও মানা করা যাবে। মেয়েটাও তাকায় মাঝে। তাকিয়ে একটা হাসি দিয়েই আবার অন্যদিকে ফিরে যায়। কি অদ্ভূত।

আকাশে মেঘ জমেছে। চারদিকে সাদা চাদর। দূরের পাহাড়টাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। মেঘের ভেলায় সেটা আড়াল হয়েছে। শুধু মেঘ আর মেঘ। মেঘ গুলো মনে হচ্ছে অনেক নীচে। বৃষ্টি আসছে দেখে মেয়েটা গোসল সেরে তাড়াতাড়ি উঠে চলে যায়। যাওয়ার সময় একটা ভেংচি কেটে যায় রকিবের উদ্দেশ্যে।

বৃষ্টি চলে আসে। ওরা তিন বন্ধু আশ্রয় নেয় গোল ছাউনিতে। ছাউনির উপরে সিমেন্টের গোল ছাদ। ঘুরানো সিমেন্টের চেয়ার। যদিও সেখানে অনেক ময়লা। বসার জো নেই। দেয়ালে কয়লা দিয়ে অনেক কিছু লেখা। কেউ কেউ নিজের মোবাইল নাম্বার লিখে রেখেছে। বাজে কথাও লেখা আছে। মানুষের রুচি যে কত্ত খারাপ। এরকম প্রকাশ্যে জায়গায় এত বিশ্রী কথাগুলো যে কিভাবে লিখে।

ভালই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফোঁটা গুলো অনেক বড় বড়। ঝর্ণার পানি আর বৃষ্টির পানি যোগ হয়ে অন্যরকম লাগছে জায়গাটা। কেউ কেউ মজা করে ভিজছে বৃষ্টিতে।

ওরা দাঁড়িয়ে আছে। শাহীনের হাতে এখনও সিগারেট। সে সিগারেট খাওয়ায় মশগুল। দ্বিতীয়বার ধরিয়েছে। ওর মহা বাজে অভ্যাস। সিগারেট ধরালে পর পর দুইটা খায়। একটাতে নাকি ওর তৃপ্তি মেটে না। ওর খুব আফছোস সিগারেট গুলো কেন যে এত ছোট আকৃতির করা হয়। যাদের সিগারেট বেশি খেতে হয় তাদের জন্য ডাবল আকৃতির সিগারেট বানালেই তো হয়।

রকিব শাহীনকে বলে, দোস্ত সুন্দর একটা মেয়ে দেখেছি আজ। এত্ত সুন্দর মেয়ে। তুই দেখেছিস? মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। বৃষ্টিটা যে কেন আসতে গেল, নাহলে আরো কিছুক্ষণ থাকত। আমার এখন বৃষ্টিকে শত্রু মনে হচ্ছে।

শাহীন মাথা নাড়ে। কোন মেয়ে?
হাত দিয়ে কোণার দিকটা দেখিয়ে দেয়। ঐ যে ঐ জায়গাটাতে গোসল করতেছিল। বিশাল মিস করলি। এত্ত সুন্দর। চোখে মুখে উচ্ছ্বাস রকিবের।

শাহীন ঠোট থেকে সিগারেট নামিয়ে রাখে। দোস্ত এখানে এই সুন্দর পরিবেশে একটা মেয়ের সৌন্দর্য দেখার চেয়ে সিগারেট খাওয়া আমার জন্য অনেক আনন্দের।

রকিব শাহীনের কথা শুনে বিরক্ত হয়। তুই আসলে একটা পাগল। পৃথিবীর সৌন্দর্য চিনলি না।

রবিন চুপচাপ বৃষ্টি দেখছিল। ও বলে, রকিব তুই কি মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?

এটা শুনে রবিনের চোখে মুখে স্বপ্ন খেলা করে। বলে, এরকম একটা মেয়ে পেলে আসলে জীবনটা অনেক সুন্দর হতো। কি মায়াবী মুখ। নির্মল হাসি। চুলগুলো অনেক কালো।

শাহীন বলে, দোস্ত বাস্তবে নামো। ও অন্য ধর্মের। শুধু তাই না অন্য জাতের। একে নিয়ে স্বপ্ন দেখো না। বিপদে পড়বা।

রবিনও গলা মিলায়, তুই পছন্দ করবি ভাল কথা তা এমন জায়গায় পছন্দ যাকে পেতে এত সমস্যায় পড়তে হবে না। এখানে পছন্দ করতেছিস কোন দুঃখে?

রকিব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, দোস্ত হাজারো সমস্যা মাড়িয়ে যে ভালবাসা অর্জিত হয় সেটাই তো প্রকৃত ভালবাসা। সমস্যা ডিঙিয়ে পাওয়ার মধ্যেই আনন্দ।

ওদের একদিন পরই যাওয়ার কথা। রকিব মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আরো কিছুদিন থাকবে। যে করে হোক রবিন আর শাহীনকে রাজি করাবে। এই মেয়েও নিশ্চয় পছন্দ করেছে কিছুটা হলেও। নাহলে ওর দিকে চেয়ে এত সুন্দর করে হাসবে কেন? বাসা থেকে মেনে না নিলে অন্য জায়গায় উঠবে। শেয়ার ব্যবসায় নেমে বেশ কিছু টাকা জমেছে। টাকা নিয়ে সমস্যা হবে না। এর মধ্যে অন্য কিছু করার চেষ্টা করবে।

ওরা যেখানে উঠেছে সেটা দুই তলা। তবে পাকা না। গাছের দুই তলা। উপরে কাঠ দিয়ে মেঝে। সেটাই রেস্ট হাউস হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়। উপরে থাকে। নিচে রেস্টুরেন্ট। যদিও খাবারের দাম অনেক বেশি। একটা ডিম ভাজিই ২০ টাকা।

ওরা ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য নিচে নামে। ভাত খাচ্ছে। সাথে হরিণের গোস্তও আছে। তবে চড়া দাম। হরিণের গোস্ত আগে কখনো খায়নি কেউই। সেজন্য টেস্ট করার জন্য ওরা নেয়। ভালই। একটা টক টক ভাব।

শাহীন বলে, গল্প করার নতুন একটা বিষয় পেয়ে গেলাম। ঢাকায় গিয়েই ক্লাসমেটদের বলব, হরিণের গোস্ত খাইছি। এত্ত মজা।

রবিন বলে, কই এত্ত মজা? তোর কাছে কি বেশি মজা লাগছে নাকি?

আরে না, আমার কাছেও তেমন বেশি মজা লাগছে না। কিন্তু গল্প করার সময় তো বলতেই হবে বেশি মজা। আর ওরা টেস্ট করার কই সুযোগ পাবে। আফসোছ করবে। জীবনে একটা মজার জিনিষ খেতে পারল না। এটা উপভোগ করবো।

রকিব যেন বাস্তবে নেই। ওর চোখে এখন সে মেয়েটি। হঠাৎ চমকে উঠে। আরে স্বপ্ন দেখছে না তো। ঐ মেয়েটিতোই। এখন থ্রিপিস পড়েছে। নীল রঙের। কপালে একটা টিপ। হাতে চুড়ি। গোসল করার সময় হাতে চুড়ি ছিল না। কি সুন্দর লাগছে। গোসল করার সময় একরকম সুন্দর লেগেছে। এখন লাগছে একরকম সুন্দর।

ও তাকিয়েই থাকে। মেয়েটি বুঝতে পারে। সেও হাসি দেয়।

শাহীন চিমটি মারে রকিবকে। দোস্ত এভাবে ধ্যানে পড়লে গলায় ভাত আটকাবে। শেষে শ্বাস নিতে না পেরে কঠিন অবস্থা হয়ে যাবে। এখানে আশে পাশে ডাক্তারও নাই। বাঁচানোই দায় হবে। দেখে শুনে খা। খাওয়া শেষ কর আগে তারপর ধ্যান করিস মন ভরে।

রকিব লজ্জা পায়। আরে এই মেয়ে তাহলে আশে পাশেই থাকে। ভালই হলো। যে করে হোক এই মেয়েকে মনের কথা জানাতেই হবে। কি সুন্দর হাসি দিলো। নিশ্চয় মেয়েটাও পছন্দ করেছে।

ভাত খাওয়া শেষ হয়। ওরা উপরে উঠতে যায়। রকিব বলে আমি একটু পরে আসছি। তোরা যা। ওরা বুঝে। ঠিক আছে বন্ধু তোমার জন্য শুভ কামনা। ওরা উঠে যায়।

রকিব নিচে বসে আছে। যদি মেয়েটা আরেকবার আসে এই অপেক্ষায়। মনে প্রাণে কামনা করে মেয়েটা আবার আসুক। কিন্তু কই দেখা যায় না তো।
যে করে হোক আরো কিছুদিন থাকতে হবে। যেভাবেই হোক ওদের বুঝাতে হবে। দরকার হলে বাড়তি দিনের খরচ ও নিজ থেকে দেবে এরকম একটা চিন্তা করে রকিব।

বিশাল দেহী একটা লোক ঢুকে। দেখলেই ভয় করে এই ধরণের। রকিবের দিকে এগিয়ে আসে। একটু এদিকে আসেন।

রকিবের ভয় ভয় করে। মেয়েটা কিছু বলে নাইতো। ও ডিস্টার্ব করছে। কিন্তু কোন ডিস্টার্ব করে নি তো। শুধু তাকিয়ে ছিল। এটা কি অপরাধ। একবার চিন্তা করে উপরে উঠে যাবে।

আবার লোকটি ডাক দেয়। ভাই এদিকে আসেন।

এবার লোকটির সাথে এগিয়ে যায়। বাহিরে আসে। ভয় কাটে নি। মনে হচ্ছে কঠিন কিছু করবে।

কিছুদূর যেতেই লোকটা দাঁড়ায়। বলে, আপনি নাকি লাকিকে পছন্দ করেছেন? ওর দিকে চেয়ে হেসেছেন।

কি বলছে এসব? বুঝে না রকিব। না তো। লাকী কে?

-যখন গোসল করতেছিল তখন যে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সে-ই।
এবার বুঝতে পারে। কিন্তু ওর নাম লাকি হতে যাবে কেন? ওদের নাম তো অন্যরকম হয়।

ওর আসল নাম অন্য। তবে আপনাদের মত পর্যটকদের কাছে এই নামেই পরিচিত। সমস্যা নাই। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাজার দিলেই হবে। যদিও এখন ব্যস্ত আছে ও অন্য জনের সাথে। আপনি বুকিং দিলে রাতে ঠিক করতে পারি।

রকিবের ইচ্ছা হয় কানে হাত দিতে। ওর মাথা ঘুরায় কিচ্ছু বলতে পারে না। এমন সুন্দর একটা মেয়ে এরকম কাজ করে এটা বিশ্বাস করা যায়?

যে করে হোক কাল ভোরেই এইখান থেকে চলে যেতে হবে। শাহীন আর রবিন যদি জানে ও যে মেয়েকে পছন্দ করেছে সে এমন কাজ করে তবে আর রক্ষা নাই। বন্ধুদেরকে বলে দিবে। বিশ্রী অবস্থা হবে। এটা নিশ্চিত রবিন মজা করে বলবে, সমস্যা ডিঙিয়ে যে ভালবাসা সেটাই প্রকৃত ভালবাসা এখন বিয়ে কর।

ওরা যাতে কোন মতেই জানতে না পারে। এখন বলতে হবে কাল একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। হঠাৎ মনে পড়েছে। অবশ্যই যেতে হবে। কোন মতেই মেয়েটার ব্যাপারটা জানানো যাবে না।

যাওয়ার কথা ওদেরকে বলতেই ওরা রাজি হয়ে যায়। রকিব অবাক হয়। ভেবেছিল অনেক বুঝাতে হবে।

ওরা স্বান্তনা দেয়, দোস্ত আসলে তোর মনের অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি। তোর চেহারা দেখেই বুঝছি। তোর এখানে আর একটুও থাকতে ইচ্ছা করছে না।

রকিব বুঝতে পারে না কিছু। ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শাহিন বলে, ঐ মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে পাশের রুমে ঢুকছে। মেয়েটার হাসির শব্দ, আর না থাক। তবে আমরা বুঝতে পারছি মেয়েটা কি করে।

রকিব অসহায় ভাবে, এটা তোরা ঢাকায় গিয়ে সবাইকে বলে দিবি তাই না।

রবিন বলে, দোস্ত বন্ধুর কঠিন দুর্বলতা নিয়ে মজা করার মধ্যে কি লাভ? আমরা এই কসম কাটছি এই কথা কাউকে বলা তো দূরের কথা। আমরা নিজেরাই ভুলে যাবো। তুই চিন্তা করিস না। বুঝছি তুই অনেক ধাক্কা খেয়েছিস। খারাপ লাগছে অনেক। আমাদের ও খারাপ লাগছে। ক্ষণিকে পছন্দ নিয়ে আর ভাবিস না। চল তার চেয়ে আমরা কার্ড খেলতে বসি।