সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বিমূর্ত স্বপ্ন ( গল্প )

নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে। কখনো কখনো কিছু ক্ষেত্রে চরম আফসোস জাগে। ভালর জন্য অন্যকে কিছু শিখিয়ে পরে যদি কষ্ট পেতে হয় তখন আফসোস বহুগুণে বেড়ে যায়। কেন শিখাতে গেল তা ভেবে মাথা খুড়ে মরার উপক্রম হয়। এমনও হয় এক দক্ষ সৈনিক এক তরুণকে অস্ত্র শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলল। পরে দেখা গেল যাকে শেখানো হলো তার হাতেই মৃত্যু হলো ঐ দক্ষ সৈনিকের। এই যেন দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা।

নাহ সৌরভের ব্যাপারটা এত কঠিন না। তারপরও ও অনেক আফসোস করছে। বার বার চিন্তা করছে কেন যে শেখাতে গেল। এদিকে বন্ধু সাদিককে ব্যাপারটা খুলে বলেছে। সাদেক কথাটা শুনে এক কথায় উত্তর দিয়েছে, গাধাদের এরকমই হয়।


এই গাধা ডাকটা সৌরভের জন্য নতুন নয়। প্রতিদিন অনেক বার এই ডাক শুনে মোটামুটি অভ্যস্ত সৌরভ। তাই সেটা নিয়ে ও এত ভাবে না। ও বলে, দোস্ত কোন সমাধান তো দিলি না। আমি গাধা তা মানি। চালাকের মত তুই কোন পরামর্শও তো দিলি না!

সাদিক বলে, এখন আর পরামর্শ দিয়ে কি করবো? শিখানোর আগে তো একবারও জিজ্ঞেস করলি না শিখাবি নাকি? এখন আর কিছু করার নাই।

-আরে আমি জানতাম নাকি এরকম হবে? বিশ্বাস কর অনেক কষ্টে আছি।
- আবেগের বশে ভবিষ্যত না ভেবে কাজ করলে এরকম অনেক কষ্ট করতে হয়। এখন কর।
- আরে এটা কি এমন হবে আমি জানতাম নাকি?
সাদিক গম্ভীরস্বরে বলে, কাউকে কিছু বলার আগে ১০০ বার চিন্তা করবি। বিশেষ করে মেয়েদেরকে কিছু শেখানো, কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া থেকে যত দূরে থাকবি তত মঙ্গল।

সৌরভ জানে সাদিক একটু মেয়ে বিরোধী মানুষ। আগে এমনটা ছিল না। বরং অন্ধভাবে বিশ্বাস করত মেয়েদের। কিন্তু সুবর্ণার সাথে সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর ও আর মেয়েদের বিশ্বাস করে না।

সৌরভ বলে, দোস্ত এখন কি করা যায় সেটাই বল। তোর মাথায় অনেক সুন্দর বুদ্ধি খেল করে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় কি জানিস?
-কি ইচ্ছা হয়?
- ওদের বাসায় গিয়ে ইন্টারনেটের লাইন কেটে দিয়ে আসি।
- লাইন কেটে দিয়ে লাভ নেই। এখন মোবাইল সিম দিয়ে সহজে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। সুতরাং যতই কাটাকাটি করিস কোন লাভ হবে না।
-তাহলে বল না। কি করা যায়?
- ওর সাথে সরাসরি কথা বলছিস?
- হুম বলছি। বলে ও এখন নেটেই কম বসে।
- তুই বিশ্বাস করেছিস ওর কথা?
- আরে নাহ। ইদানিং নেট ওর যে নেশা হয়ে গেছে। কম বসবে তা বিশ্বাস হয় না। আমাকে অফলাইন দেখিয়ে রাখে।
- আসলে দোস্ত কারো থেকে জোর করে ভালবাসা আদায় করা যায় না। মহা সত্য কথা হচ্ছে এটাই।


সাদিকের মোবাইলে রিং আসে। সাদিক বিরক্ত হয়ে তা কেটে দেয়।
তা দেখে সৌরভ বলে, কিরে কাটলি কেন? কথা বল।

-দোস্ত মন ভাল নেই। তোর কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। সুবর্ণাকেও আমি অনেক ভালবাসতাম। অনেক। প্রতিটি কথা অন্ধের মত বিশ্বাস করতাম। কি লাভ হলো? জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে গেল। তোদের থেকে এক বছর পিছিয়ে গিয়েছি। তাও ভাগ্য ভাল পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছি। না হলে হয় আর পড়ালেখাতেই ফিরে আসতে পারতাম না। অনেকেই পারে না। আমার ব্যাপারগুলো তো জানিস। আসলে আমার মনে হয়, এখনকার বেশির ভাগ মেয়েই ছেলেদেরকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। ভালবাসা ওদের কাছে সময় কাটানো কিছুর মত ব্যাপার। আজ একে ভাল লাগে তো কাল ওকে। প্রতিটি মেয়ে একটা বৃত্ত তৈরি করে। সে বৃত্তের মূল বিন্দুতে মেয়েটি থাকে। আর চারপাশে বেশ কিছু ছেলে রাখে। যাদের সে স্বপ্ন দেখায়। কখনো বা ইচ্ছা হলে সে ছেলেদের মধ্যখান থেকে সবচেয়ে নির্ভযোগ্য কাউকে বেছে নেয়। কখনোবা বৃত্তের কথা ভুলে মা-বাবার পছন্দনুযায়ী কোন ছেলের সাথে নতুন জীবন শুরু করে। একটু ও মনে রাখে না যাদের স্বপ্ন দেখাত তাদের কথা। নতুন জীবন উপভোগ করা শুরু করে কানায় কানায়।

সৌরভ প্রতিবাদ করে, তামান্না সেরকম মেয়ে না। ও অনেক ভাল মেয়ে।
হতাশ চোখে সাদিক তাকায়। দোস্ত আমিও ভাবতাম এটা। পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মেয়ে মনে হতো সুবর্ণাকে। এত্ত ভাল যে মাঝে মাঝে মনে হতো আমি বোধ হয় স্বপ্নে আছি। এত ভাল মেয়ের সাথে সম্পর্ক স্বপ্নে ছাড়া বাস্তবে সম্ভব না।

-তুই কি বলিস তামান্নার সাথে সম্পর্ক ভেঙে ফেলি।
- নাহ এটা আমি বলছি না। তবে এটা মনে রাখিস জোর করে ভালবাসা আদায় করা যায় না। পৃথিবীটা আরো অনেক সুন্দর হতো যদি একটা জিনিষ না থাকতো?

-কি না থাকলে? মেয়ে?
- নাহ। মেয়ে না থাকলে তো পৃথিবীটাই থাকতো না। একটা সময়ের পর মানবশূন্য হয়ে যেত।
- তাহলে কি না থাকলে?
- যদি মেয়েরা অভিনয় করতে না জানতো তবে অনেক সুন্দর হতো এই পৃথিবী। আর আমাদের সবচেয়ে দুর্বলতা কি জানিস?

সৌরভ জানতে চাচ্ছে নাকি এটার দিকে নজর দেয় না সাদিক। বলে যেতে থাকে, আমরা মেয়েদের অভিনয় ধরতে পারি না। যা করে তাই সত্য মনে হয়। আমার দিকেই দেখ। আমি যদি একটু সতর্ক হতাম তাহলে জীবন থেকে একটা শিক্ষাবর্ষ হারিয়ে যেত না। মা-বাবাকে এত দৌড়াদৌড়ি করতে হতো না আমার জন্য। আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হতো না। এই যে আমি এখন স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা হারিয়েছি, এটা হতো না। অনেক কথা বলে ফেললাম, দোস্ত মাইন্ড করিস না।

সাদিকের চোখে মুখে কান্নার আবহ। যেন কান্না করে দিবে। সামলানোর চেষ্টা করছে।
সৌরভ নিজে স্বান্তনা নিতে আসছিল। এখন উল্টা সাদিককে স্বান্তনা দিতে হচ্ছে। - দোস্ত মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। জীবনের অনেক পথ বাকী। অনেক সুন্দর কিছু তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

সাদিক চোখ মুছে। কিছু পানি জমছিল। মুছার ভঙ্গি এমন যেন চোখে ময়লা পড়ছে তা সরিয়ে নিচ্ছে। - শোন দোস্ত মানুষকে স্বান্তনা দেওয়া অনেক সহজ। এই যে তুই আসলি তোকে কিছু সুন্দর কথা বলে তোর মনের আফছোস দূর করে দিতে পারতাম। সত্য যে সত্যই। স্বান্তনা দিলে তা কখনো মিছে হয় না। আমি কেন জানি শক্ত হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। জানি তামান্নার প্রতি তোর আবেগ অনেক। অথচ আমি তোকে ভুল বুঝাচ্ছি। কষ্ট দিচ্ছি অনেক। অনেক বেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছে মন। আগের মত নাই আমি আর। দিন দিন যেন পাথর হয়ে যাচ্ছি।

নিজেকে আর সামলাতে পারে না সাদিক। একবারেই কেঁদে ফেলে।

ওর এই অবস্থা দেখে সৌরভেরও খারাপ লাগে। দোস্ত তুই এখনও শক্ত হসনি। ভুল ধারণা তোর। পাথর হয়ে গেলে এভাবে চোখের পানি আসতো না। তুই সে আগের মতই আছিস। মনে আছে স্কুলের বিদায়ের দিন কি কাঁদাটাই না কেঁদেছিলে বক্তৃতায়। এখন আমার সে আগের মতই লাগছে তোকে। তুই একটুও বদলাসনি। সেদিনের মতই আছিস।

হেসে উঠে সাদিক। বিদঘুটে সে হাসি। হাসি থামিয়ে বলে, বাসায় এখন আব্বু আম্মু আমার সাথে কথা বলতে ভয় পায়। কখন কি না কি করে ফেলি সেজন্য। কিছু বলার আগে চিন্তা করে তা শুনে আমার প্রতিক্রিয়া কি হবে। অথচ আগে কি সুন্দর সম্পর্কটাই না ছিল। এখন আমার রুমে ঢুকার আগে জিজ্ঞেস করে আসবে নাকি? চিন্তা করছিস সন্তানের রুমে ঢুকার আগে মা-বাবার অনুমতি নেওয়া কি বিশ্রী ব্যাপার। বার বার ইচ্ছা হয় বলি আগের মত হয়ে ফ্রি কথা বলতে। কিন্তু আমার মাঝে যে একটা খোলস তৈরি হয়ে গেছে। সেটা থেকে বের হয়ে কোন মতেই তা পারি না বলতে। আচ্ছা দোস্ত অনেক কথা বলে ফেলছি। মন খারাপ করিস না।

-আরে নাহ। কষ্টের কথা বলে ফেললে মন হালকা হয়।
- ঠিক বলছিস। এখন ভাল লাগছে। তুই এখন এই ব্যাপারে তামান্না সাথে সরাসরি কথা বল। নীরব অভিমান অনেক সময় সম্পর্ক ভাঙার কঠিন কারণ হয়ে যায়। যার সাথে অভিমান করলি সে যদি না জানে তবে কি লাভ হলো অভিমানের।

-হা সেটাই করতে হবে। সরাসরি জিজ্ঞেস করবো, আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগে কি না?
- তোর ইচ্ছা। আমি মানা করবো না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিষ্কার থাকলেই লাভ। তবে হতাশ হবি না। হতাশা জীবনকে বেঁকিয়ে দেয়।

রচনাকাল- সকাল ৬.১৫ , ১৬ আগস্ট ২০১০।