সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অসহায় জীবন ( গল্প )

ঘরটার একটা অংশ ভাঙা। পিছনের পাক ঘরটা প্রায় সম্পূর্ণটাই। আগে সেখানে রান্না হতো। কিন্তু এখন সে অংশ ভাঙা। ছাদের কিছুটা ঝুলে আছে। ছাদের লোহার সাথে কংক্রিট সিমেন্ট লেগে আছে। যে কোন সময় নিচে পড়তে পারে। সেজন্য সেখানে এখন আর রান্না করা হয় না। পরিত্যক্ত পড়ে আছে সে কক্ষটি। ঠিক করতে হবে। কিন্তু যে ঠিক করবে সেই যে অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে আছে।

ইউনুছ আহমদের বাসা এটা। ফলের ব্যবসা করে। যদিও এখানে যে কোন ব্যবসাই ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও চলার জন্য ব্যবসা করতে হয়। আর কারো হাতে তেমন বেশি টাকা নেই। অনেকে বাকী নিয়ে যায়। সংসার কোন মতে চলে। ইউনুছের বউ ছিদ্দীকা রাগ করে। তুমি মানুষকে এভাবে বাকী দাও কেন? সংসারের যে কি অবস্থা খেয়াল আছে? উত্তরে ইউনুছ কিছু বলে না। শুধু হাসে।


তবে এক সপ্তাহ ধরে ইউনুছ বের হতে পারছে না ঘর থেকে। ওর ডান পায়ের হাটুর নিচের অংশ নাই। ইসরাইলী বাহিনীর বিমান থেকে মাঝে মাঝেই বোমা পড়ে। তা দোকানে ছিল ইউনুছ। উপরে জঙ্গী বিমানের আওয়াজ পেয়ে সে ঢুকে পড়েছিল ফলের বক্সগুলোর নিচে। আত্ম রক্ষার জন্য। বোম পড়ছে। কান ফাটা আওয়াজ। বাসার কথা ভাবে ইউনুছ। বিশেষ করে ওর ছোট্ট মেয়েটার কথা। মেয়ের কথা মনে হতেই বের হয়ে আসে নিচ থেকে। ঘরের দিকে ছুটে। মেয়ের যাতে কিছু না হয়।

এদিকে উপর থেকে ইসরাইলি বাহিনী মনে করে ছুটছে কোন অপরাধী। ওরা ইউনুছকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। নাহ দৌড়ের উপর থাকায় বেঁচে যায় ইউনুছ। তবে বাসার কাছাকাছি আসতেই একটা গুলি ওর পায়ে লাগে। আর কি হয়েছে জানে না ইউনুছ। তবে যখন জ্ঞান ফিরে দেখে বাসার খাটে শুয়ে আছে। ওর পা কেটে ফেলা হয়েছে। তবে সেদিকে খেয়াল থাকে না ইউনুছের। মেয়েকে খুঁজে। আমার আয়েশা কই? আয়েশাকে দেখে শান্ত হয় ওর মন।

সাতদিন ধরে ঘরে পড়ে আছে। কোন আয় রোজগার নেই। এখানে এনজিও সংস্থা একটি আছে। সেখান থেকে কিছু দেওয়া হয়। তবে তাতে তিনজনের হয় না। ছিদ্দীকা ওর অংশটুকু ইউনুছকে দিতে চায়। শরীর থেকে অনেক রক্ত গেছে। ডাক্তার বলছে ফলমূল বেশি খেতে হবে। কিন্তু ইউনুছকে দিলে বেশির ভাগ সময়ই নিজে খায় না। গল্প বলে বলে মেয়েকে খাইয়ে দেয়। মেয়ে না খেলে রাগ করে। নিজে একটুও ধরে না। বাধ্য হয়ে মেয়েকে খেতে হয়।

ছিদ্দীকার ভয় করে। পাশের বাসার হাজেরা বলছে ইসরাইলি বাহিনী নাকি এনজিওদেরকে ত্রাণ সামগ্রী আনতে বাধা দিচ্ছে। ত্রাণ বাহী জাহাজের উপর বোমা মেরেছে। অনেকে মারা গেছে। ত্রাণ না পেলে যে কি হবে ভাবতেই গা শিউরে উঠে ছিদ্দীকার। তবে ইউনুছকে এসব কিছু বলে না।

মেয়ের সাথে কথা বলে যায় ইউনুছ। ফল আনার জন্য দূরে চলে যেতে হতো। মেয়েকে কাছে বেশি পাওয়া যেত না। কিংবা রাতে ফিরলে দেখা যেত মেয়ে ঘুমাচ্ছে। এখন পাশে থাকছে সব সময়। মেয়ে অনেক কথা বলে। ভাল লাগে আহত ইউনুছের।

-আচ্ছা বাবা ওরা গুলি করে কেন? তুমি কি খাবার খাওনি, সেজন্য গুলি করেছে।
ইউনুছের হেসে ফেলে। ছিদ্দীকা খেতে না চাইলে ওর মা ভয় দেখায় ইসরাইলিরা গুলি করা শুরু করবে না খেলে। তাই মেয়ে এই কথা জিজ্ঞেস করছে।

ইউনুছ উঠে বসার চেষ্টা করে। পায়ে এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভাবতে কষ্ট হয় আর কখনো হাঁটতে পারবে না। কিন্তু এটাই যে এখানে স্বাভাবিক। ইসরাইলিদের হামলায় অনেকে পঙ্গু হয়েছে। নিজে ব্যবসা করার আগে এক মুদির দোকানে চাকরি করত। সে মুদির দোকানের মালিক দুইটি চোখই হারিয়েছেন বোমার স্প্রিন্টারের আঘাতে। এই যে নিয়তি এই এলাকার মানুষের। প্রতিদিন বেঁচে থাকায় যে বড় বিস্ময়।

বসে মেয়েকে আরো কাছে টানে ইউনুছ। নাহ মা, না খাওয়ার জন্য না, ওরা আমাদের শত্রু মনে করে। তাই গুলি করে।

৪ বছরের মেয়ে আয়শার মাথায় শত্রু ব্যাপারটা ঢুকে না ব্যাপারটা। সে জিজ্ঞাসা করে, বাবা শত্রু কি?
ইউনুছ ব্যাখ্যা করে, ওরা মনে করে ওদের ক্ষতি করবো আমরা।
আয়শা বলে, ওদের গুলি আছে। আমাদের গুলি নাই। আমরা ওদের ক্ষতি করবো কেমনে?

ইউনুছ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। ছিদ্দীকা আসে ওষুধ নিয়ে। পেয়ালা করে পানি দেয়। ছিদ্দীক পানি দেয়।
আয়েশা বলে, বাবা আমি বড় হলে গুলি দিয়ে ওদেরও গুলি করবো। ওরা তোমাকে গুলি করছে। আমাদের বাসা ভেঙে দিয়েছে। আমিও ওদের বাসা ভেঙে দিবো।

ইউনুছ হাসে মেয়ের কথা শুনে।

এরপর অনেক দিন কেটে যায়। একজীবনে একবার হামলাই যে হয় তা শেষ না। কারো কারো উপর বারংবারও হামলা চলে। সেসরকম দুর্ভাগাদের মধ্যে একজন ইউনুছ। আর তেমন কাজ করতে পারতো না পা হারিয়ে ইউনুছ। দোকানে বসে থাকতো। কিন্তু আবার হামলা হয়। এবার আর বাঁচতে পারে না। মারা যায়।

আয়েশার বয়স চৌদ্দ। বাবার লাশ ছুয়ে সে শপথ করে, বাবা আমি এর প্রতিশোধ নেবো।

যখন সারা বিশ্বে এই বয়সের মেয়েরা বিদ্যালয়ে পড়ে, বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়, বিভিন্ন খেলাধূলা করে, নেটে অচেনা মানুষদের সাথে মজা করে তখন ফিলিস্তিনে আয়েশা থাকে সম্পূর্ণ অন্য জগতে। গেরিলাতে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত সে। ঘর থেকে পালিয়ে এসেছে। মা-কেও বলে না।

ট্রেনিংয়ে ওকে নিতে চাওয়া হয় না। এত অল্প বয়সে তোমার এসব কাজে যাওয়ার দরকার নেই। বুঝানো হয়। কেননা আবেগে অনেকে এভাবে যোগ দেয়। পরে ধরা খেয়ে যায়। অন্যদের কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। এজন্য ওকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

কিন্তু আয়েশার মনে পিতৃ হত্যার প্রতিশোধের অটল প্রতিজ্ঞা। সে বুঝে না ওদের হাজারো বুঝানো কথা। বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে।

যখন দেখে নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। তখন আয়েশা বলে, ঠিক আছে আপনারা নিতে চান না। ভাল কথা। তবে আমি কিন্তু ঠিকই আক্রমণ করবো। যদিও তেমন কিছু ক্ষতি করতে পারবো না। তারপরও করবো। ট্রেনিং না থাকার কারণে অযথা একটা জীবন নষ্ট হবে।

ট্রেনিং যারা দেয় তারা বুঝে, এই মেয়ের মাথায় এটা ঢুকে গেছে। বের হবে না। অটলতা আছে। তাই শেষে নিয়ে ফেলা হয় ওকে।

পরিশেষ-
খবরে প্রকাশ এক আত্মঘাতী হামলায় ৭ ইসরাইলী সৈন্য ও ২ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত। জানা যায়, একটা সামরিক কনভয়ে একটা অল্পবয়স্ক মেয়ে আসে। তাকে চেক করতে গেলে সে তার শরীরে বাঁধা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী, জার্মানী চ্যান্সেলর এই হামলায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। এটাকে তার কাপুরুষিত বর্বচোরিত হামলা হামলা হিসাবে অভিহিত করে বলেছে এই ধরণের হামলা শান্তি আলোচনা বিঘ্ন ঘটাবে।

একসময় ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। ফিলিস্তানীরা আর অবরুদ্ধ থাকবে না। তখন হয়ত আয়েশা বীরের মর্যাদা পাবে। তবে কেউ বলতে পারছে না তা কখন হবে?