সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আতঙ্ক ( গল্প )

বৃহস্পতিবার। দিনটা অন্য দিনের চেয়ে সুন্দর আবিরার। প্রতি সপ্তাহে এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে সে। এই দিনে স্কুল লাইব্রেরী থেকে বই নেওয়া যায়। সে বই এক সপ্তাহ রাখা যায়। আবিরা বই পড়তে অনেক পছন্দ করে। তবে সমস্যা একটা। একটার বেশি বই নেওয়া যায় না। একটা বই পড়তে বেশি হলে একদিন লাগে। অনেক বই ই এক বসাতে পড়া হয়ে যায়।

লাইব্রীয়ানের দায়িত্ব পালন করেন শিশির স্যার। আবিরা একদিন স্যারকে বলে বসে, স্যার একটার বেশি বই দেওয়া যায় না?


স্যার একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। চোখ তুলে তাকান। চোখে বিস্ময় ভর করছে। নিয়মের মধ্যেই আছে প্রতি সপ্তাহে একটার বেশি বই নেওয়া যাবে না। এই মেয়ে আরো বেশি চাচ্ছে কেন?
-একটার বেশি বই কি করবে? একটা বই পড়তেই তো এক সপ্তাহ লেগে যাওয়ার কথা।
-স্যার, এই যে আজ এই বইটি নিয়েছি না, এটা তো আজই শেষ করে ফেলব।
-বলো কি? একদিনে পড়ে ফেলো?
- জ্বী স্যার। আমি দ্রুত বই পড়তে পারি।
- নিশ্চয় ফাঁকি দিয়ে দিয়ে পড়ো।

আবিরা কথাটা বুঝে না। পাঠ্য বই পড়ার সময় অনেক ফাঁকি দেয়। কিন্তু গল্পের বই ফাঁকি এটা কিভাবে সম্ভব? গল্প বই পড়ার সময় ফাঁকি দেওয়া যে যায়, এটা আবিরা কল্পনাও করতে পারে না।

- স্যার বুঝি নাই। আমি একটা গল্পের বই পেলে সেটা পড়ে শেষ না করা পর্যন্ত উঠতে পারি না। কি ফাঁকি?

স্যার হাসেন। মানে এক পৃষ্ঠা পড়ে দুই পৃষ্ঠা না পড়ে বই শেষ করে ফেলো না তো? সেটাকে ফাঁকি দেওয়া বলা হয়।
-না তো। আমি তো সব পৃষ্ঠাই পড়ি।

আবিরার চোখ বস্তাবন্দী বইয়ের দিকে। বস্তার মুখ দিয়ে উকিঁ দেওয়া বইগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে সব নতুন চক চকে বই। সেগুলো এখনও খোলা হয় নাই। ইশ কবে যে খুলবে।

-স্যার দেন না আরো কয়েকটা বই।
-দেওয়া যাবে একটা শর্তে।

আবিরা খুশী হয়ে উঠে। অনেক দিন স্যারকে বলবে বলবে করছিল। সাহস পাচ্ছিল না। আজ বলে ফেলতে পারায় অনেক ভাল লাগছে। তার উপর স্যার বলছে একটা শর্তে দেওয়া যাবে। কি শর্ত কে জানে।
স্যার জিজ্ঞেস করেন, কি শর্ত পালন করতে রাজি আছো?
-কি শর্ত সেটা বলেন নাইতো।
- শর্ত আজ বলবো না। অন্যদিন বলব। স্যারের চোখে মুখে দুষ্টামি।
- তার মানে আজ আমাকে একটার বেশি বই নিতে দিবেন না?

মন খারাপ হয়ে যায় আবিরার। খুশী হয়ে উঠেছিল একটার বেশি বই নিতে পারবে ভেবে। কিন্তু আজও একটাই নিতে হবে। অথচ অনেক গুলো উপন্যাস বই পছন্দ হয়ে আছে। স্কুল লাইব্রেরীতে অনেক বই। প্রতি সপ্তাহে একটা করে নিলে এই বই গুলো পড়া শেষ হতে অনেক বছর লেগে যাবে। অথচ সামনের বছর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে দিবে। এর পর তো আর বই নিতে পারবে না এই স্কুল লাইব্রেরী থেকে। ইশ এরকম যদি একটা নিজের লাইব্রেরী থাকত। তবে রাতদিন সেখানে বসে বসে গল্পের বই পড়া যেত।

-স্যার প্লিজ দেন না।
অনুনয় করে আবিরা।
-নাহ, এখন দেওয়া যাবে না। শর্ত পালনের পর।

নিরাশ মুখে বাসায় ফিরে আবিরা। রাতেই বইটা শেষ হয়ে যায়। এরপর ভাবতে বসে স্যার কি শর্তের কথা বলবেন। খারাপ কিছু না তো। যারা বই পড়ে তারা পৃথিবীর অনেক কিছু সম্পর্কে আগে জেনে যায়। বয়স ভিত্তিক যেগুলো জানার কথা বই পড়লে সেগুলোও অনেক আগে জেনে যাওয়া যায়। এজন্য খারাপ চিন্তাও ভর করে আবীরার মাথায়।

স্যার উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসলে। স্যারের কাছে যখন বই খুঁজছিল তখন স্যার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আবীরা দেখতে বেশ সুন্দরী। আয়নার সামনে যখন দাঁড়ায় তখন ওর নিজেরই ভাল লাগে নিজেকে দেখে। চেহারায় একটা মায়া জড়ানো।

স্বস্তি পায় না আবিরা। বার বার মনে হয় স্যার অন্য কিছু বলে বসবেন। সুযোগ পেলে অনেকে নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে পারেন না, ভুলে যান বাস্তবতা। এরকম কিছু হয়ে গেলে। অন্যের দুর্বলতাকে অনেকে ব্যবহার করতে চায়। স্যার সেরকম করে ফেললে।

নাহ ভাবতে পারে না আবিরা। মাথায় অনেক বাজে চিন্তা ভর করছে। সেগুলো দেখে নিজের উপর নিজের বিরক্ত লাগে ওর। নিজেকে খারাপ মনে হচ্ছে। স্যার সম্পর্কে এরকম ভাবতে যাবে কেন? সাথে সাথে এটা ও মনে হয় স্যার শর্তের কথা বলতে গিয়ে দুষ্ট হাসি দিলেন কেন?

পরের দিন বন্ধ। সারাদিন চিন্তায় চলে যায়। কিচ্ছু ভাল লাগে না। একবার ভাবে লাইব্রেরী থেকে বেশি বই নেওয়ার দরকার নেই। আগের মত একটা করেই নিবে। কোন শর্ত পালন করতে পারবে না।

শনিবার স্কুল বসে। আবিরা শেষ বেঞ্চিতে বসে। ওর পাশে বসে লিজা। ওরা ইচ্ছা করেই শেষ বেঞ্চে বসে। গল্প করে। লিজাকে ব্যাপারটা খুলে বলে।

লিজা বলে, খবরদার তুই কোন শর্তে রাজি হবি না।
- তোর কি মনে হয়? আতঙ্কিত স্বরে জানতে চায় আবিরা।
- বাজে কিছু বলে বসতে পারে। তুই তো অনেক সুন্দরী। তার উপর...... .. বলে থেমে যায় লিজা।
- আরে উনি আমাদের স্যার না?
- পুরুষ মানুষের কোন ঠিক নাই। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন এনজিওর বড় কমকর্তা থাকে। সে সম্পর্ক করে বসে আছে বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে। চিন্তা কর অবস্থা। অথচ ঐ লোককে দেখলে কেউ বিশ্বাসও করবে না এত বাজে কাজ করে। আর তাছাড়া স্যারটাকে আমারো কেমন কেমন সন্দেহ জনক মনে হয়। কথা বলার সময় মুচকি হেসেছিলেন?
- হুম।
- আরে আমি যা সন্দেহ করছি তাই হবে। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বলে লিজা।
- তুই কি সন্দেহ করছিস?
- এতকিছু জেনে লাভ নেই। তুই খবরদার ঐ স্যারের কাছে যাবি না।
- কিন্তু আমার কাছে যে বই আছে সেটা ফেরত দিতে হবে তো। আর তাছাড়া ঐ স্যারের কাছে না গেলে নতুন বই পাবো কিভাবে।
- এই বই তোকে শেষ করল। আমার কি বইয়ের জন্য তুই বিপদে পড়।

বৃহস্পতিবার আসে। বই ফেরত দিতে হবে। দ্বিধাদন্ধে থাকে আবিরা। কি বলে স্যার। স্কুল ছুটির পর লাইব্রেরীতে ঢুকার নিয়ম। ছুটির সাথে সাথে অনেকে বাসায় চলে যায়। মনে করছিল লিজাকে সঙ্গে করে লাইব্রেরীতে যাবে। কিন্তু লিজাটা আজ স্কুলেই আসে নি।

তৃতীয় তলায় লাইব্রেরী। বিশাল করিডোর। একেবারে কোণার দিকে। কয়েক জন লাইব্রেরীতে ঢুকছে। যেতে ভয় করছে। বার বার মনে হচ্ছে স্যার অন্যরকম কিছু বলবেন। যা শুনে কানে হাত দিতে ইচ্ছা হবে। কিন্তু স্যারের সামনে সেটাও করা যাবে না। আতঙ্কে থাকে আবীরা।

ঘোরের মধ্যে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আবিরা।
স্যার ওকে দেখে মুচকি হাসেন। কি পড়া হলো?
মাথা নাড়ে আবীরা।
-সামনে বসো।

একবার ইচ্ছা হয় বসবে না। চলে যাবে। কিন্তু সেটা বেয়াদবী হবে। জড়তা নিয়ে বসে আবীরা। হাতের বইটা টেবিলের উপর রাখে।
স্যার একটা রাইটিং প্যাড বাড়িয়ে দেন।
-শর্তের কথা মনে আছে তো? এখন দেখি। সেটা যদি পারো তোমার ইচ্ছা মত বই নিতে পারবে।
আবীরা আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, কি শর্ত?

রাইটিং প্যাডটা খুলে দেখো। সেখানে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। এটা একটা পরীক্ষা। প্রশ্ন গুলোর উত্তর যদি ঠিকমত হয় তবে ধরা হবে তুমি পেরেছো। এর পর অনেক বই নিতে পারবে।
-কি প্রশ্ন।
-আরে প্যাডটা খুলে দেখো। তুমি এত ঘামছো কেন? কঠিন কোন প্রশ্ন নাতো। সেদিন যে বইটা তুমি নিয়েছো সে বইটা আমিও পড়েছি। সেখান থেকে কিছু প্রশ্ন রেখেছি। এখন যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারো তবে আমি ধরে নেব তুমি মনযোগী পাঠক। মনযোগী পাঠককে বেশি বই দিতে আমার আপত্তি নেই।

বইটা ঠিকমত পড়া হয় নাই বিভিন্ন চিন্তায়। তবে বইয়ের ঘটনা ঠিকই মনে আছে। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দেয় তাড়াতাড়ি।

স্যার সেগুলো দেখেন। আশ্চর্য। তুমি তো সত্যিই অনেক মনযোগ দিয়ে বই পড়ো। দশটার মধ্যে নয়টার উত্তরই দিয়েছো অনেক সুন্দর করে। আজ পাঁচটা বই নিতে পারবে। আমি পিয়নকে বলে রাখবো। আমি না থাকলেও সে বই দিয়ে দিবে তোমাকে।

আবিরা স্বাভাবিক হয়। স্যার একটু পানি খাওয়া যাবে?
হা অবশ্যই যাবে, পিওন ডাক দেন। এক গ্লাস পানি আনার জন্য।

লজ্জা লাগে আবীরার। স্যারকে নিয়ে কি বাজে জিনিষই না ভেবেছে। আর লিজাটাও না। কোথায় সাহস দেবে। উল্টা সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়ে ভীতু করে দিয়েছে।

ভাগ্যিস মানুষের করা চিন্তা গুলো অন্য কেউ দেখতে পায় না। যদি দেখতে পেত কি যে বিশ্রী অবস্থা হতো। স্যার নিশ্চয়ই অনেক খারাপ ভাবত।