এর আগে পরীক্ষা কিংবা অন্য কোন কাজের কারণে বেশ কয়েকবার ফেসবুক ডিএক্টিভ
করা হয়েছে। কিন্তু কখনো ডিলিট করিনি। এবার তাই করতে যাচ্ছি। মন খারাপ।
ভার্চুয়াল একটা সুন্দর জগত গড়ে উঠেছিল। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বেশ ভাল সময়
কাটতো। আজ থেকে তা বন্ধ হয়ে যাবে।
আচ্ছা ফেসবুকের থেকে যে বিদায় নেওয়া এ ব্যাপারে কি স্ট্যাটাস দেওয়া যায়? কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। নাহ এভাবে লোকদেখানো স্ট্যাটাস দিয়ে লাভ নেই। লুকিয়ে বিদায় নিতে হবে। আর বিদায় নেওয়ার কারণটাও বলা যাবে না। আসলে ভার্চুয়াল জগতে কারো অনুপস্থিতি তেমন অনুভব করার সুযোগ পাওয়া যায় না। যে যায় তার জায়গায় অন্যজন কিংবা একাধিক জন এসে উপস্থিত হয়। আর অন্যদেরও বা কি দোষ দিবো। আমার নিজেরই তো অনেক বন্ধু ফেসবুক ছেড়ে চলে গেছে। তাদের কতজনেরই খবরই বা আমি রেখেছি। মাঝে হঠাৎ বা কোন কারণে ওই আইডি চোখে পড়লে ওর ওয়ালে লিখে আসা কেমন আছো। দায়িত্ব বলতে এতটুকুই পালন করেছি। অভাববোধটা কখনো তো সেভাবে অনুভব করি নাই। নতুনদের সাথে আড্ডা দিয়ে সে আগের মতই সময় কেটেছে।
মাঝে মাঝে তো মনে হয় ভার্চুয়াল জগতটা অনেক বেশি নিষ্ঠুর। এক বন্ধুর সাথে অনেক আড্ডা হতো, তখন আমার বন্ধুত্বের সংখ্যা ছিল একেবারে কম। সময়ের ব্যবধানে বন্ধুর সংখ্যা বেড়েছে। তা কয়েকদিন দিন বিরতির পর বন্ধুটি এলো। ওই বন্ধু তার ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জগত সেভাবে বাড়ায়নি। এসে সে আগের মত নক করে, কথা বলতে চায়। কিন্তু আমার বন্ধুত্ব বেড়ে যাওয়ায় আগের মত সময় পাই না। রিপ্লাই যে দিই না তা নয়, তবে দেরি হয়। একসময় ওই বন্ধু রাগ করে স্ট্যাটাস দেয়। “মানুষ কি সহজে বদলে যায়, বন্ধুত্বের রুপে পরিবর্তন ঘটে, যেখানে অল্প সময়ের অনুপস্থিতিতে বন্ধুত্বের রুপের পরিবর্তন ঘটে সেখানে কি লাভ বন্ধুত্ব নামে মিথ্যা সম্পর্কে জড়িয়ে।”
ওটাই শেষ স্ট্যাটাস। এরপর আর তাকে ফেসবুকে দেখা যায় নি। আমি অনেকবার নক করেছি। কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। আর আমিও যে সেভাবে তার অভাববোধ করেছি তাও না। ফেসবুকে ঠিকই হেসে খেলে আগের মত সময় কাটানো। তারপরও মাঝে মাঝে একটা অপরাধবোধ কাজ করতো। আমার কারণে একজন ফেসবুক ছেড়ে দিয়েছে।
আচ্ছা অন্যকে কষ্ট দিলে নাকি সে কষ্ট নিজের ওপর এসে পড়ে। আমার মনে হয় তাই হয়। ইবার সাথে পরিচয় ফেসবুকেই। অদ্ভূত ধরণের একটা মেয়ে। মেয়েরা এম্নেতেই এক একটা একভাবে অদ্ভূত। অদ্ভূত সব আচরণের মধ্যে তারা থাকতে পছন্দ করে। এ মেয়েটা একটু বেশিই অদ্ভূত। অদ্ভূতের একটা নমুনা দিচ্ছি।
কোন স্ট্যাটাস দিলে সেখানে কমেন্ট করাই সাধারণত নিয়ম। আর এ মেয়ে স্ট্যাটাস দিলে কমেন্ট করে মেসেজে। কোন একটা স্ট্যাটাস দিলেই সেটার কমেন্ট মেসেজে চলে আসে।
আচ্ছা তুমি এভাবে মেসেজে কমেন্ট করো কেন! স্ট্যাটাসে কমেন্ট দিলে কি সমস্যা হয়?
: আমি কমেন্ট শুধু তোমাকে দেখানোর জন্য করি। সেখানে করলে সবাই দেখবে। আমি তো সবাইকে দেখাতে চাই না। আর কমেন্টে তো অপশন দেওয়া নেই অনলি ফর কারো জন্য করে দেওয়া। সেটা যদি কখনো চালু করা হয় তখন স্ট্যাটাসেই কমেন্ট করবো। তার আগ পর্যন্ত মেসেজেই করবো।
তবে যতখানি অদ্ভূত তার চেয়ে বেশি ভাল ইবা। এ জীবনে কারো প্রতি দূর্বল হওয়ার কোন ঘটনা ভুলেও ঘটবে এটা কখনো ভাবনাতেই ছিল না। যেখানে আমি বর্তমান ভালোবাসাকে সস্তা, লোক দেখানো, ক্ষণস্থায়ী বলে অন্যদের সতর্ক করতাম সেখানে আমিই কিনা ভালোবাসায় পড়ে গেলাম। অথচ আমাকে নিরামিষ, রসকষহীন ধরণের মানুষ হিসাবেই অনেকে চিনে।
সকালে ঘুম থেকে উঠার ব্যাপারে চরম অনীহা আমার। সকালের ঘুমটাকে খুব বেশি উপভোগ করি। এর মাশুল ভালই দিতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস মিস হয়ে যায়। ইবাও ঘুম প্রিয় এক মেয়ে। কিন্তু আমি ঘুমের কারণে ক্লাস মিস করি শুনে তার কি চিন্তা!
ও যে বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সেখানে বেশিরভাগ ক্লাসই দশটা এগারটার পর। তাই সকাল বেলায় ইচ্ছামত ঘুমাতে সমস্যা নেই ওর। ইবার মা নেই। ও যখন ছোট তখন ওর মা এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। আত্মীয়, বন্ধুদের পরামর্শ স্বত্বেও মেয়ের অযত্ন হতে পারে এ ভয়ে ওর বাবা আর বিয়ে করে নি। অনেকটা স্বাধীন জীবন এ মেয়ের। বাবার টাকা আছে। ইচ্ছামত সব করতে পারে। টাকা বেশি থাকলে মানুষের খারাপ হতে সময় লাগে না। ওর বান্ধবীরা কোন পার্টিতে মিলিত হলে ড্রিংকস করে নাচানাচি করে। ড্রিংকসের ভয়ে এ মেয়ে পারতপক্ষে কোন পার্টিতে যায় না। কোন বাজে কাজের চিন্তা করলে ওর নাকি মনে হয় মা ওকে দেখছে। নিষেধ করছে।
আমার ক্লাস রুটিন আমার নিজেরই মনে থাকে না অথচ ওর দিব্য মুখস্থ। যেদিন সকালে আমার ক্লাস থাকে সেদিন সকালে ভোরে উঠে যায়। আমাকে ফোন দেয়।
ঘুম ঘুম গলায় ফোন ধরি।
: আজ যে সাহেবের ক্লাস আছে খবর আছে?
: হুম আছে। কিন্তু প্রথম ক্লাস এত বেশি ইম্পর্টেন্ট না।
: জ্বী মশায়, ইম্পর্টেন্ট নাহ। আমি রুটিন জানি। তাই ঘুমের জন্য আমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই। চা খাবে?
: হুম খাবো।
: নিজ হাতেই বানালাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে একাজটা করতে ভাল লাগে। বাবা ঘুমে। তাই একা একাই খাচ্ছি। ইশ তোমাকেও যদি দিতে পারতাম। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে তোমাকে দিচ্ছি। দুই জনে গল্প করতে করতে খাচ্ছি! কি সুন্দর হতো তাই না? আচ্ছা ভবিষ্যতে হবে। এখন ভাল ছেলের মত উঠে পড়ো। ক্লাস যেন কোনভাবে মিস না হয়।
: দ্বিতীয় ক্লাসটা ধরবো। এখন আরেকটু ঘুমাই?
: নাহ সেটা হবে না। তাকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্যই ভোরে উঠলাম। আর সে কিনা বলে আরেকটু ঘুমাবে। হবে না। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি একটু পর আবার ফোন দিচ্ছি।
পছন্দের ঘুমটাকে বিসর্জন দিয়ে উঠে বসি। এ মেয়েটা আমার জন্য এত ভাবে কেন! দুপুর বেলায় হোটেলে খাবো শুনলে চিল্লাচিল্লি শুরু করে। হোটেলে নাকি অনেক পুরানো দিনের তেল ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া তেলাপোকা কিংবা অন্য কোন পোকা থাকলে সেটাকে আর তোলা হয় না। ওইটা সহ রান্না করে ফেলা হয়।
:খবরদার হোটেলে খাবে না। বাসায় গিয়ে দরকার হলে ডিম ভাজি করে ভাত খেয়ে নাও।
: আলসে লাগে। হোটেলের খাবারতো ভালই মজা পাই।
: আলসে লাগে বিধায় তো তোমাকে গিয়ে মাছ রাঁধতে বলছি না। শুধু ডিম ভেজে খেয়ে ফেলতে পারো। এই একটা ব্যাপার জানো? আমি না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
: কি সিদ্ধান্ত?
: সামনের মাস থেকে রান্নার স্কুলে ভর্তি হবো। আম্মু থাকলে তো আম্মুর কাছ থেকেই শিখতাম। এখনতো আম্মু নাই। তাই কি আর করা। রান্নার স্কুল থেকেই শিখবো। তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে না। শোনো আমার রান্না যদি মজা না হয় তাহলেও কিন্তু মজা হয়েছে বলবে।
একটু পরে আবার বলে, নাহ নাহ! মজা না হলে মজা হয় নাই, ঠিক ঠিক বলে দিবে। নাহলেতো চুক্তি ভ ঙ্গ হবে।
ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের মধ্যে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি হয় সেটা না হওয়ার এক চুক্তি হয়েছে ইবার সঙ্গে। ইবা-ই প্রথম এ চুক্তির কথা বললো।
: চলো একটা চুক্তি করি!
: কি চুক্তি?
: উভয়ের মধ্যে কথা বলার সময় আমরা কখনো মিথ্যা বলবো না। কক্ষনো না। মিথ্যা ব্যাপারটা আমার অনেক বেশি পছন্দ।
: আমারো অপছন্দের।
: তাহলে তো মিলেই গেলো। ঠিক থাকবে তো মিথ্যা বলবো না?
: হুম ঠিক থাকবে।
: প্রমিজ!
: হা প্রমিজ।
আচ্ছা আমাকে প্রমিজ বলতে বলছো না যে, আমাকে প্রমিজ বলতে বলো।
আমি হেসে উঠি।
অবাক হয়ে ও জিজ্ঞেস করে, কি হলো হাসলে যে!
তোমার ছেলেমানুষি ভালই লাগে দেখতে।
: এটা ছেলেমানুষীর কি হলো? সত্য বলা কি ছেলেমানুষি?
: নাহ নাহ ওইটা বলি নাইতো। বলো প্রমিজ।
: প্রমিজ। আচ্ছা এখন রাখি। আব্বু এসেছে। খেতে যাচ্ছি।
আমার একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে কম্পিউটারে বসলেই প্রথমে ফেসবুকে ঢোকা। আর ঢুকে পড়লে অন্য কোন দিকে নজর থাকে না। ঘোরের মত কাজ করে। ঘন ঘন স্ট্যাটাস দিই। মজা করি। তা সেদিনও সারাদিন মজা করলাম।
ফেসবুক নিয়ে মাঝে মাঝে আমাকে পঁচায় ইবা। “তোমার তো সংসার বলতে ওই ফেসবুকই। এর বাহিরে তো তোমার আলাদ জগত নেই। সব কিছু ফেসবুক কেন্দ্রিক। কিছু হলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বসো। কি মজার সময় কাটে।”
আমি সুযোগ নিই। বলি, ফেসবুকে যদি না আসতাম তাহলে তোমার সাথে পরিচয় হতো?
ও বলে, এটা কি বললে? তার মানে আমার মত আরো কারো সাথে পরিচয় হওয়ার ইচ্ছা আছে। এজন্যই তো বলি রাতদিন ফেসবুকে পড়ে থাকো কেন!কতজন হলে বলো তো বন্ধুত্বের কোটা পূরণ হবে? একজন মানুষের কত বন্ধু লাগে!
কথাখানি ভালই গায়ে লাগে। বন্ধুত্বের সংখ্যা নিয়ে আসলে সেভাবে কখনো ভাবিনি।
এর কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন অনেক বৃষ্টি হলো। ঘর থেকে বের হইনি। সারাদিন কম্পিউটারের সামনেই ছিলাম। আর কম্পিউটারে থাকা মানেই তো ফেসবুকে থাকা। ইবার সাথে সারাদিন কথা হয়নি।
রাতে ইবার ফোন। রাত তখন সাড়ে এগারটা। আমি ফেসবুকে। ইবার কান্না জড়ানো গলা! জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো?
বললাম, ভাল। কিন্তু তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেন! মন খারাপ?
: আজ আম্মুর মৃত্যু বার্ষিকী ছিল। ভেবেছিলাম তুমি কল করবে। বাসায় অনেক জন এসেছিলেন। দোয়া হলো। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু তুমি তো ফোন দিলে না।আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। তাই ফোন দিয়ে দিলাম। আসলে তুমি অনেক ব্যস্ত তাই না?
আজকের তারিখটা কথা মনে পড়তেই আঁতকে উঠলাম। ১৮ জুন।অথচ একটু মনে নাই। এই মেয়েটা আমাকে নিয়ে এত ভাবে আর আমি ওর এরকম দু:খের দিনে একবারও ফোন দিলাম না।
কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
ওই কথা বললো, চুপ করে আছো যে!!
: সরি!! আজকের তারিখটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে খুব খারাপ লাগছে আমার।
: নাহ নাহ ঠিক আছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আর আমি কি পাগল অভিমান করে তোমাকে ফোন দিলাম না। আমিই তো তোমাকে ফোন দিতে পারতাম। আর সবকিছু মনে রাখা সম্ভবও না, মরে রাখার দরকারও হয় না, তাই না?
আমি কথা খোঁজে পাচ্ছিলাম না।
এ মেয়ে একদিন বলেছিল, আবেগ লুকিয়ে রাখা ব্যক্তিদের তালিকা করলে আমি নাকি সে তালিকায় প্রথম দিকে থাকার ক্ষমতা রাখি। হয়তবা।
এটার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ফেসবুকে আর আসবো না। যে ফেসবুক প্রিয় মানুষের সবচেয়ে কষ্টের দিন ভুলিয়ে দেয় সে ফেসবুকে আর নয়। আর আসবো না।
আমি আমার একাউন্ট ডিলিট করে দিলাম। মুক্ত হলাম একটা জগত থেকে। খারাপ লাগছিল তারপরও কেমন যেন একটা ভাল লাগা। এত আবেগ দিয়ে যে আমায় পছন্দ করে তার জন্য কিছুটা ত্যাগ করলাম এটা ভেবে।
একই সাথে অন্য ভাবনাও এলো। এ মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো তো আমি? নিজের প্রতি যে বিশ্বাস আমার কম। এ মেয়েকে কোনদিন ঠকাতে পারবো না। নাকি এ সম্পর্ক থেকে পালাবো? # ফেবু লিংক
আচ্ছা ফেসবুকের থেকে যে বিদায় নেওয়া এ ব্যাপারে কি স্ট্যাটাস দেওয়া যায়? কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। নাহ এভাবে লোকদেখানো স্ট্যাটাস দিয়ে লাভ নেই। লুকিয়ে বিদায় নিতে হবে। আর বিদায় নেওয়ার কারণটাও বলা যাবে না। আসলে ভার্চুয়াল জগতে কারো অনুপস্থিতি তেমন অনুভব করার সুযোগ পাওয়া যায় না। যে যায় তার জায়গায় অন্যজন কিংবা একাধিক জন এসে উপস্থিত হয়। আর অন্যদেরও বা কি দোষ দিবো। আমার নিজেরই তো অনেক বন্ধু ফেসবুক ছেড়ে চলে গেছে। তাদের কতজনেরই খবরই বা আমি রেখেছি। মাঝে হঠাৎ বা কোন কারণে ওই আইডি চোখে পড়লে ওর ওয়ালে লিখে আসা কেমন আছো। দায়িত্ব বলতে এতটুকুই পালন করেছি। অভাববোধটা কখনো তো সেভাবে অনুভব করি নাই। নতুনদের সাথে আড্ডা দিয়ে সে আগের মতই সময় কেটেছে।
মাঝে মাঝে তো মনে হয় ভার্চুয়াল জগতটা অনেক বেশি নিষ্ঠুর। এক বন্ধুর সাথে অনেক আড্ডা হতো, তখন আমার বন্ধুত্বের সংখ্যা ছিল একেবারে কম। সময়ের ব্যবধানে বন্ধুর সংখ্যা বেড়েছে। তা কয়েকদিন দিন বিরতির পর বন্ধুটি এলো। ওই বন্ধু তার ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের জগত সেভাবে বাড়ায়নি। এসে সে আগের মত নক করে, কথা বলতে চায়। কিন্তু আমার বন্ধুত্ব বেড়ে যাওয়ায় আগের মত সময় পাই না। রিপ্লাই যে দিই না তা নয়, তবে দেরি হয়। একসময় ওই বন্ধু রাগ করে স্ট্যাটাস দেয়। “মানুষ কি সহজে বদলে যায়, বন্ধুত্বের রুপে পরিবর্তন ঘটে, যেখানে অল্প সময়ের অনুপস্থিতিতে বন্ধুত্বের রুপের পরিবর্তন ঘটে সেখানে কি লাভ বন্ধুত্ব নামে মিথ্যা সম্পর্কে জড়িয়ে।”
ওটাই শেষ স্ট্যাটাস। এরপর আর তাকে ফেসবুকে দেখা যায় নি। আমি অনেকবার নক করেছি। কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি। আর আমিও যে সেভাবে তার অভাববোধ করেছি তাও না। ফেসবুকে ঠিকই হেসে খেলে আগের মত সময় কাটানো। তারপরও মাঝে মাঝে একটা অপরাধবোধ কাজ করতো। আমার কারণে একজন ফেসবুক ছেড়ে দিয়েছে।
আচ্ছা অন্যকে কষ্ট দিলে নাকি সে কষ্ট নিজের ওপর এসে পড়ে। আমার মনে হয় তাই হয়। ইবার সাথে পরিচয় ফেসবুকেই। অদ্ভূত ধরণের একটা মেয়ে। মেয়েরা এম্নেতেই এক একটা একভাবে অদ্ভূত। অদ্ভূত সব আচরণের মধ্যে তারা থাকতে পছন্দ করে। এ মেয়েটা একটু বেশিই অদ্ভূত। অদ্ভূতের একটা নমুনা দিচ্ছি।
কোন স্ট্যাটাস দিলে সেখানে কমেন্ট করাই সাধারণত নিয়ম। আর এ মেয়ে স্ট্যাটাস দিলে কমেন্ট করে মেসেজে। কোন একটা স্ট্যাটাস দিলেই সেটার কমেন্ট মেসেজে চলে আসে।
আচ্ছা তুমি এভাবে মেসেজে কমেন্ট করো কেন! স্ট্যাটাসে কমেন্ট দিলে কি সমস্যা হয়?
: আমি কমেন্ট শুধু তোমাকে দেখানোর জন্য করি। সেখানে করলে সবাই দেখবে। আমি তো সবাইকে দেখাতে চাই না। আর কমেন্টে তো অপশন দেওয়া নেই অনলি ফর কারো জন্য করে দেওয়া। সেটা যদি কখনো চালু করা হয় তখন স্ট্যাটাসেই কমেন্ট করবো। তার আগ পর্যন্ত মেসেজেই করবো।
তবে যতখানি অদ্ভূত তার চেয়ে বেশি ভাল ইবা। এ জীবনে কারো প্রতি দূর্বল হওয়ার কোন ঘটনা ভুলেও ঘটবে এটা কখনো ভাবনাতেই ছিল না। যেখানে আমি বর্তমান ভালোবাসাকে সস্তা, লোক দেখানো, ক্ষণস্থায়ী বলে অন্যদের সতর্ক করতাম সেখানে আমিই কিনা ভালোবাসায় পড়ে গেলাম। অথচ আমাকে নিরামিষ, রসকষহীন ধরণের মানুষ হিসাবেই অনেকে চিনে।
সকালে ঘুম থেকে উঠার ব্যাপারে চরম অনীহা আমার। সকালের ঘুমটাকে খুব বেশি উপভোগ করি। এর মাশুল ভালই দিতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস মিস হয়ে যায়। ইবাও ঘুম প্রিয় এক মেয়ে। কিন্তু আমি ঘুমের কারণে ক্লাস মিস করি শুনে তার কি চিন্তা!
ও যে বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সেখানে বেশিরভাগ ক্লাসই দশটা এগারটার পর। তাই সকাল বেলায় ইচ্ছামত ঘুমাতে সমস্যা নেই ওর। ইবার মা নেই। ও যখন ছোট তখন ওর মা এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। আত্মীয়, বন্ধুদের পরামর্শ স্বত্বেও মেয়ের অযত্ন হতে পারে এ ভয়ে ওর বাবা আর বিয়ে করে নি। অনেকটা স্বাধীন জীবন এ মেয়ের। বাবার টাকা আছে। ইচ্ছামত সব করতে পারে। টাকা বেশি থাকলে মানুষের খারাপ হতে সময় লাগে না। ওর বান্ধবীরা কোন পার্টিতে মিলিত হলে ড্রিংকস করে নাচানাচি করে। ড্রিংকসের ভয়ে এ মেয়ে পারতপক্ষে কোন পার্টিতে যায় না। কোন বাজে কাজের চিন্তা করলে ওর নাকি মনে হয় মা ওকে দেখছে। নিষেধ করছে।
আমার ক্লাস রুটিন আমার নিজেরই মনে থাকে না অথচ ওর দিব্য মুখস্থ। যেদিন সকালে আমার ক্লাস থাকে সেদিন সকালে ভোরে উঠে যায়। আমাকে ফোন দেয়।
ঘুম ঘুম গলায় ফোন ধরি।
: আজ যে সাহেবের ক্লাস আছে খবর আছে?
: হুম আছে। কিন্তু প্রথম ক্লাস এত বেশি ইম্পর্টেন্ট না।
: জ্বী মশায়, ইম্পর্টেন্ট নাহ। আমি রুটিন জানি। তাই ঘুমের জন্য আমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই। চা খাবে?
: হুম খাবো।
: নিজ হাতেই বানালাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে একাজটা করতে ভাল লাগে। বাবা ঘুমে। তাই একা একাই খাচ্ছি। ইশ তোমাকেও যদি দিতে পারতাম। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে চা বানিয়ে তোমাকে দিচ্ছি। দুই জনে গল্প করতে করতে খাচ্ছি! কি সুন্দর হতো তাই না? আচ্ছা ভবিষ্যতে হবে। এখন ভাল ছেলের মত উঠে পড়ো। ক্লাস যেন কোনভাবে মিস না হয়।
: দ্বিতীয় ক্লাসটা ধরবো। এখন আরেকটু ঘুমাই?
: নাহ সেটা হবে না। তাকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্যই ভোরে উঠলাম। আর সে কিনা বলে আরেকটু ঘুমাবে। হবে না। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি একটু পর আবার ফোন দিচ্ছি।
পছন্দের ঘুমটাকে বিসর্জন দিয়ে উঠে বসি। এ মেয়েটা আমার জন্য এত ভাবে কেন! দুপুর বেলায় হোটেলে খাবো শুনলে চিল্লাচিল্লি শুরু করে। হোটেলে নাকি অনেক পুরানো দিনের তেল ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া তেলাপোকা কিংবা অন্য কোন পোকা থাকলে সেটাকে আর তোলা হয় না। ওইটা সহ রান্না করে ফেলা হয়।
:খবরদার হোটেলে খাবে না। বাসায় গিয়ে দরকার হলে ডিম ভাজি করে ভাত খেয়ে নাও।
: আলসে লাগে। হোটেলের খাবারতো ভালই মজা পাই।
: আলসে লাগে বিধায় তো তোমাকে গিয়ে মাছ রাঁধতে বলছি না। শুধু ডিম ভেজে খেয়ে ফেলতে পারো। এই একটা ব্যাপার জানো? আমি না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
: কি সিদ্ধান্ত?
: সামনের মাস থেকে রান্নার স্কুলে ভর্তি হবো। আম্মু থাকলে তো আম্মুর কাছ থেকেই শিখতাম। এখনতো আম্মু নাই। তাই কি আর করা। রান্নার স্কুল থেকেই শিখবো। তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে না। শোনো আমার রান্না যদি মজা না হয় তাহলেও কিন্তু মজা হয়েছে বলবে।
একটু পরে আবার বলে, নাহ নাহ! মজা না হলে মজা হয় নাই, ঠিক ঠিক বলে দিবে। নাহলেতো চুক্তি ভ ঙ্গ হবে।
ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের মধ্যে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি হয় সেটা না হওয়ার এক চুক্তি হয়েছে ইবার সঙ্গে। ইবা-ই প্রথম এ চুক্তির কথা বললো।
: চলো একটা চুক্তি করি!
: কি চুক্তি?
: উভয়ের মধ্যে কথা বলার সময় আমরা কখনো মিথ্যা বলবো না। কক্ষনো না। মিথ্যা ব্যাপারটা আমার অনেক বেশি পছন্দ।
: আমারো অপছন্দের।
: তাহলে তো মিলেই গেলো। ঠিক থাকবে তো মিথ্যা বলবো না?
: হুম ঠিক থাকবে।
: প্রমিজ!
: হা প্রমিজ।
আচ্ছা আমাকে প্রমিজ বলতে বলছো না যে, আমাকে প্রমিজ বলতে বলো।
আমি হেসে উঠি।
অবাক হয়ে ও জিজ্ঞেস করে, কি হলো হাসলে যে!
তোমার ছেলেমানুষি ভালই লাগে দেখতে।
: এটা ছেলেমানুষীর কি হলো? সত্য বলা কি ছেলেমানুষি?
: নাহ নাহ ওইটা বলি নাইতো। বলো প্রমিজ।
: প্রমিজ। আচ্ছা এখন রাখি। আব্বু এসেছে। খেতে যাচ্ছি।
আমার একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে কম্পিউটারে বসলেই প্রথমে ফেসবুকে ঢোকা। আর ঢুকে পড়লে অন্য কোন দিকে নজর থাকে না। ঘোরের মত কাজ করে। ঘন ঘন স্ট্যাটাস দিই। মজা করি। তা সেদিনও সারাদিন মজা করলাম।
ফেসবুক নিয়ে মাঝে মাঝে আমাকে পঁচায় ইবা। “তোমার তো সংসার বলতে ওই ফেসবুকই। এর বাহিরে তো তোমার আলাদ জগত নেই। সব কিছু ফেসবুক কেন্দ্রিক। কিছু হলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বসো। কি মজার সময় কাটে।”
আমি সুযোগ নিই। বলি, ফেসবুকে যদি না আসতাম তাহলে তোমার সাথে পরিচয় হতো?
ও বলে, এটা কি বললে? তার মানে আমার মত আরো কারো সাথে পরিচয় হওয়ার ইচ্ছা আছে। এজন্যই তো বলি রাতদিন ফেসবুকে পড়ে থাকো কেন!কতজন হলে বলো তো বন্ধুত্বের কোটা পূরণ হবে? একজন মানুষের কত বন্ধু লাগে!
কথাখানি ভালই গায়ে লাগে। বন্ধুত্বের সংখ্যা নিয়ে আসলে সেভাবে কখনো ভাবিনি।
এর কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন অনেক বৃষ্টি হলো। ঘর থেকে বের হইনি। সারাদিন কম্পিউটারের সামনেই ছিলাম। আর কম্পিউটারে থাকা মানেই তো ফেসবুকে থাকা। ইবার সাথে সারাদিন কথা হয়নি।
রাতে ইবার ফোন। রাত তখন সাড়ে এগারটা। আমি ফেসবুকে। ইবার কান্না জড়ানো গলা! জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো?
বললাম, ভাল। কিন্তু তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেন! মন খারাপ?
: আজ আম্মুর মৃত্যু বার্ষিকী ছিল। ভেবেছিলাম তুমি কল করবে। বাসায় অনেক জন এসেছিলেন। দোয়া হলো। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু তুমি তো ফোন দিলে না।আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। তাই ফোন দিয়ে দিলাম। আসলে তুমি অনেক ব্যস্ত তাই না?
আজকের তারিখটা কথা মনে পড়তেই আঁতকে উঠলাম। ১৮ জুন।অথচ একটু মনে নাই। এই মেয়েটা আমাকে নিয়ে এত ভাবে আর আমি ওর এরকম দু:খের দিনে একবারও ফোন দিলাম না।
কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
ওই কথা বললো, চুপ করে আছো যে!!
: সরি!! আজকের তারিখটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে খুব খারাপ লাগছে আমার।
: নাহ নাহ ঠিক আছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আর আমি কি পাগল অভিমান করে তোমাকে ফোন দিলাম না। আমিই তো তোমাকে ফোন দিতে পারতাম। আর সবকিছু মনে রাখা সম্ভবও না, মরে রাখার দরকারও হয় না, তাই না?
আমি কথা খোঁজে পাচ্ছিলাম না।
এ মেয়ে একদিন বলেছিল, আবেগ লুকিয়ে রাখা ব্যক্তিদের তালিকা করলে আমি নাকি সে তালিকায় প্রথম দিকে থাকার ক্ষমতা রাখি। হয়তবা।
এটার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ফেসবুকে আর আসবো না। যে ফেসবুক প্রিয় মানুষের সবচেয়ে কষ্টের দিন ভুলিয়ে দেয় সে ফেসবুকে আর নয়। আর আসবো না।
আমি আমার একাউন্ট ডিলিট করে দিলাম। মুক্ত হলাম একটা জগত থেকে। খারাপ লাগছিল তারপরও কেমন যেন একটা ভাল লাগা। এত আবেগ দিয়ে যে আমায় পছন্দ করে তার জন্য কিছুটা ত্যাগ করলাম এটা ভেবে।
একই সাথে অন্য ভাবনাও এলো। এ মেয়েটার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো তো আমি? নিজের প্রতি যে বিশ্বাস আমার কম। এ মেয়েকে কোনদিন ঠকাতে পারবো না। নাকি এ সম্পর্ক থেকে পালাবো? # ফেবু লিংক