সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সত্যায়িত হতে গিয়ে

সত্যায়িত হতে গিয়ে যেসব বালক/ বালিকা নিরুপায়ত্তোর জীবনের প্রথম রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি করতে বাধ্য হন তাদের উদ্দেশ্যে লেখাটি উৎসর্গ করা হলো-------------

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম নিয়েছি। জমা দিতে হবে। তাই সংশ্লিষ্ট , ছবি সত্যায়িত করার প্রয়োজন পড়ল। মফস্বল থেকে ঢাকা শহরে পড়তে আসা ছেলে আমি। এখানে এমন পরিচিত কেউ নেই যে কিনা সত্যায়িত করে দেবে।


এক সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম কাগজ-পত্র সাথে নিয়ে। টিকেট কাটলাম। ইচ্ছা ডাক্তার দেখাবো আর সাথে সাথে সত্যায়িতও করে নেবো। নিজেকে পৃথিবীর সেরা বুদ্ধিমান মনে হলো। বুদ্ধি থাকলে কোন কাজ আটকে থাকে না বলে নিজেকে বাহবা দিতে দিতে রোগীদের সিরিয়ালে দাঁড়ালাম। চর্ম বিভাগ। কিছুক্ষণ পর ডাক পড়ল। ভিতরে দেখি তিনজন মহিলা ডাক্তার। তবে ভীষণ ধাক্কা খেলাম যখন বুঝতে পারলাম এরা তিনজনই ইন্টার্নীরত। এদের সত্যায়িত করার কোন অধিকার নেই। দেখাতে গিয়েছিলাম পায়ের সমস্যা। ক্ষোভে পা না দেখিয়ে হাত দেখালাম। একজন ডাক্তার সে অদৃশ্য রোগের প্রেসক্রিপশন দিল। ওনাকে বললাম কিছু কাগজ সত্যায়িত করতে হবে। জানা গেল , তাদের বিভাগের একজন আসেননি , অন্যজন ছুটিতে , আরেকজন ঐটাতে । অথ্যাৎ এখানে সম্ভব নয়।

অন্য আরেক বিভাগে গেলাম। ডাক্তার নেই। একজন বলল, ডাক্তার আসতে আসতে এগারোটা সাড়ে এগারোটা বেজে যাবে। এতো সকালে ডাক্তারের ঘুম ভাঙে না। অনেক রাত পর্যন্ত প্রাইভেট রোগী দেখতে হয় কিনা। এখানেও কাজ হচ্ছে না।

এবার নিচ তালায় চলে এলাম। ঢুকলাম শিশু বিভাগে। এ বিভাগে ডাক্তার একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে একজন দাড়িওয়ালা লোক রোগীর নাম ধরে ডাক আর ভিতরে যেতে বলছে। তার কাছে গিয়ে অতি নম্রস্বরে বললাম-“চাচা এগুলো একটু সত্যায়িত করতে হবে।”নিজের গলা শুনে নিজেই অবাক হলাম। আগে কখনো এতো নম্রস্বরে কারো সাথে কথা বলিনি। প্রতি উত্তরে লোকটি আমার চেয়ে আরো বেশি বিনয়ের স্বরে বলল-“বাবা ইনি শিশু ডাক্তার। যারা বড়দের দেখেন তাদের কাছে যান।” হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না। আমি হয়ত একটু অভিমানী টাইপের। মুখচোরা স্বভাবের। কারো কাছে নিজে যেচে গিয়ে বন্ধুত্ব করতে পারি না। অথচ কেউ যদি আপন করে নেয় তবে তার সাথে এমনভাবে লেগে থাকি যে সে পরিশেষে বিরক্ত হয়ে আমাকে এড়িয়ে চলা শুরু করে। ঢামেক এর প্রতি ভীষণ রাগ হলো। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম এখানে আর সত্যায়িত করবো না। অন্য রাস্তা দেখবো।

পরিচিত এক ভাইয়ের সাথে তিতুমির কলেজে গেলাম। ম্যানেজমেন্ট বিভাগে যেয়ে সত্যায়িত করার কথা বলতেই এক স্যার বললেন , এখন ব্যস্ত আছি। অথচ ব্যস্ততার নামমাত্র নমুনাও দৃষ্টিগোচর হলো না। আরেক বিভাগে যেয়ে দেখি একই অবস্থা। সেখানে অলস ভঙ্গিতে বসে থাকা এক স্যার যখন জানতে পারলেন সত্যায়িত হতে এসেছি তখন তিনি এমন ব্যস্ততা দেখানো শুরু করলেন যে, নিজেই বিব্রতবোধ করলাম।

আমার অর্থনীতিতে অনার্স করার ইচ্ছে। কলেজে থাকাকালীন অর্থনীতির টিচাররা আমাকে খুব স্নেহ করত। যেকোন সমস্যার কথা বললে সাহায্য করত। তাই অর্থনীতি বিভাগের প্রতি আমার ভীষণ দূর্বলতা। মনে হলো এ কলেজের অন্য বিভাগ হোক অর্থনীতি বিভাগের স্যারগুলো অন্তত নিষ্ঠুর হবেন না। সর্বশেষ আশা নিয়ে গেলাম সেখানে। সত্যায়িত হওয়ার জন্য এসেছি শুনেই বুড়োমতো এক প্রফেসর আমাকে টেবিলে রাখা নোটিশের দিকে তাকাতে বললেন। খেয়াল করলাম সেখানে ইংরেজী বড় বড় হরফে লেখা - নো এটাস্টেড।
সত্যায়িত হয়ে পরে ফরম যথা সময়ে জমা দিয়েছি। কেমনে দিয়েছি তা বলব না। তবে কখনো যদি আমি ফাষ্টক্লাস অফিসার হই তবে বাসার সামনে লিখে দেব এখানে সত্যায়িত করা হয়। যাতে এ ধরণে কষ্ট কারো না হয়। সত্যায়িত হতে গিয়ে আমার ১২৪ টাকা খরচ হয়েছে।

তিন বছর পর আবার প্রয়োজন পড়ল সত্যায়িত হওয়ার। নির্বাচন কমিশনে আবেদন করার জন্য। মনে ভরসা যেহেতু ব্যাপারটা বান্দরবানে তাই তেমন ঝামেলা হবে না। ঢাকার মত বাজে অভিজ্ঞতার শিকার হতে হবে না বলে মনে স্বস্তি খুঁজছিলাম। বন্ধু একজন সহ গেলাম এক ডাক্তারের কাছে। বন্ধুটির সাথে ডাক্তারের ভাল সম্পর্ক। ডাক্তার অরজিনাল কপি গুলো দেখলেন। সত্যায়িত করতে লাগলেন প্রয়োজনীয় কাগজগুলো। চারিত্রিক সনদ পত্র দেখে বললেন এটা তার দ্বারা সত্যায়িত করা সম্ভব নয়। একটু বুঝিয়ে বলতে গেলাম। উনি বললেন- আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমাকে এ বিষয়ে চাপ দিয়ো না। এটা শুনে আর কিছু বলা যায়? নিজের চরিত্র নিয়ে মনে প্রশ্ন উঠল। একজন প্রথম শ্রেণী কর্মকর্তা আমাকে চরিত্র সার্টিফিকেট দিলেই আমি চরিত্রবান হয়ে যাব? অন্যথায় চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যাবে?

মধ্যম পাড়া ডাক্তারের চেম্বার থেকে গেলাম কলেজে। সত্যায়িত করার জন্য স্যার খুঁজতে লাগলাম। এ যেন বনের মধ্যে পশু শিকারের মত ব্যাপার। কলেজের বন্ধু এক স্যারকে ধরল। স্যার অন্য দুজন স্যারের নাম বললেন। বললেন সেখানে যেতে। এক কথায় তিনি করতে চান না।

স্যারের নাম বলে দেওয়া এক জাহাংগীর স্যার এলেন। তার সম্পর্কে সুনাম আছে। সত্যায়িত করার ব্যাপারে তিনি খুব সহযোগিতা করেন। অফিস রুমে ঢুকলাম। তার যাতে সন্দেহ না হয় এজন্য আবার সব গুলো ফটোকপি করে এনেছিলাম। কিন্তু চালাকি গুড়েবালি। স্যার অন্য সবগুলো সত্যায়িত করলেন। কিন্তু চারিত্রিক ঐইটা করার সাহস পেলেন না। যুক্তি আমাকে উনি চিনেন না। আমি উনার ছাত্র না। চারিত্রিক সনদ পত্র দিয়ে কয়েকজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা জেলে গেছেন একথা বললেন। তা শুনার পর আর সাহস হল না। কে চাই তার শিক্ষককে জেলে পাঠাতে?

পরে আরেক শিক্ষকের কাছে গেলাম। নাম তাহের স্যার। তিনি মেয়েদের উপবৃত্তির লিস্ট তৈরি করতেছিলেন। উনি চারিত্রিক সনদ পত্র স্বাক্ষর করে দিলেন। তার স্বাক্ষরের সাথে সাথে আমি একজন চরিত্রবান ছেলেতে পরিণত হলাম (সরকারের চোখে)।

আমার একটা বিষয় জানতে খুব ইচ্ছে করে যে, প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা সত্যায়িত করতে গড়িমসি করেন, তারা কি জানেন না যদি কারও কাছে মূল কপি না থাকে তা হলে তাঁদের হাজারও সাইনে সে কাগজ মূল্যহীন। সরকারি ঐতিহাসিক নিয়ম আছে বিধায়ই তাঁদের কাছে আমাদের যেতে হয়। অন্য কোন কারণে নয়।

(আমার এই লেখাটি রহস্য পত্রিকা ডিসে০৯ সংখ্যা ছাপানো হয়েছে)

কাঁচা হাতের গল্পে : সত্যায়িত হতে গিয়ে