আবীর ঘর থেকে বের হয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সন্দেহ জনক কিছু চোখে পড়ল না। ওর হাত
দুটি পাঞ্জাবীর পকেটে রাখা। কিছুদিন
হচ্ছে পাঞ্জাবী পরা শুরু করেছে। এতে লাভ। আর্মিরা সহজে ঘাটায় না। ধরে নেয় এ মুসলমান। তবে কিছু ক্রিটিকাল আর্মি
পথ আগলে দাঁড়ায়। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। অদ্ভূত সব প্রশ্ন। যেমন, তোমার নাম কে রেখেছে? তোমার বাবা না মা?
: আমিতো ঠিক বলতে পারবো না। জিঞ্জেস করতে হবে।
: কোথায় যাচ্ছো এখন?
: নির্দিষ্ট কোথাও যাচ্ছি না। এই একটু হাটবো।
: আমি একটু ঘোরাঘুরি করব এটার ট্রান্সলেট করো ইংরেজীতে।
আবীরের হাসি পায়। যদিও তা চেপে রাখে। এই উর্দু আর্মীগুলো উর্দুতে অনুবাদ করতে না দিয়ে ইংরেজীতে কেন অনুবাদ করতে দিয়েছে কে জানে? তবে উর্দু আর্মির বাংলা উচ্চারণ দেখে আবীর অবাক হয়ে যায়। মাতৃভাষা নয় তারপরও কি সুন্দর বাংলায় কথায় বলছে। প্রশ্নকর্তা আর্মিটি এত সুন্দর বাংলা কিভাবে শিখেছে তা জানতে ইচ্ছে করে আবীরের। কিন্তু কেন যেন প্রশ্নটা করা হয় না।
তবে আজ রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা। অন্য সময় হলে রিকসা নিত। কিন্তু রাস্তাঘাট ফাঁকা দেখে হাঁটা শুরু করল। ও যাবে একটা হাসপাতালে। রোগ দেখাতে কিংবা রোগী দেখতে নয়। সেখানে আরো কয়েকজন আসবে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবে। সামনের কাজটা কিভাবে হবে সে ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।
রাস্তায় গাড়ী চলাচল একেবারেই কম। তবে মাঝে দুই একটা সেনাবাহিনীর বড় বড় গাড়ী টহল দিচ্ছে। গাড়ীগুলোর গতি খুব মন্থর। গাড়ী গুলো যখন পাশ দিয়ে যায় তখন কেমন যেন ভয় ভয় করে। এই বুঝি গাড়ী থামানো হলো। কয়েকজন আর্মি কিছু বুঝার আগেই গাড়ীতে উঠিয়ে নিলো। এরকম এখন প্রায় সময়ই হচ্ছে। কোন কারণ ছাড়াই মানুষ ধরা হচ্ছে। বিশেষ করে যুবক বয়সী ছেলেদের। ফুয়াদ ভাইকে একবার এরকম ধরা হলো। উনি শাহবাগ মোড় ক্রস করছিলেন। যাবেন খালার বাসায়। হঠাৎ করে কথা নেই বার্তা নেই তাকে ধরে আর্মির গাড়ীতে উঠানো হলো। সাথে আরো পাঁচজন ছিল। ফুয়াদ ভাইয়ের ভাগ্য ভালো। তাকে যে মেজরের কাছে নেওয়া হলো সে একটু দয়া দেখাল। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ব্যাপারটা দেখা যায় না। দুই দিন পর ফুয়াদ ভাইকে ছেড়ে দেয়া হলো। যদিও এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। যাদেরকে ধরা হয় তাদের বেশির ভাগকেই মেরে ফেলা হয়। সে মেরে ফেলাও যেনতেন ভাবে নয়। লাইন করে দাঁড় করানো হয়। অত:পর সামনে থেকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে এক একজনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কেউ যদি লাইন ভাঙে তাহলে তার খবর হয়ে যায়। মরার সময় তাকে সীমাহীন কষ্ট দেওয়া হয়। ফুয়াদ ভাইয়ের চোখের সামনে নাকি এরকম ভাবে দুই লাইনে ত্রিশজন করে মোট ষাট জনকে মারা হয়। ফুয়াদ ভাই ফিরে আসার পর তাকে দেখতে গিয়েছিল আবীররা। ফুয়াদ ভাইকে চিনা যায় না। এই দুদিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
: ফুয়াদ ভাই খুব কষ্ট দিয়েছে বুঝি?
: আরে কষ্ট না। চোখের সামনে এভাবে মানুষ মারলে আর সুস্থ থাকা যায়। আর্মিগুলো মানুষ মারার মধ্যে আনন্দ খুঁজতো। কারো গলায় গুলি করত, কারো বুকে। কারো বা মাথায় গুলি করে এবড়েথেবড়ে করে দেয়া হতো। মগজগুলি ছিটকে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অন্য মানুষগুলোর গায়ে যেয়ে পড়ত। তা দেখে পাকিস্তানী আর্মিদের উল্লাস দেখে কে? যাদেরকে পরে মারা হবে এই চিন্তায় আলাদা রাখা হতো তাদেরকেও নিষ্ঠুর দৃশ্য গুলো দেখতে বাধ্য করা হতো। এগুলো দেখে গা গুলিয়ে যেত। চোখে অন্ধকার দেখতাম। হড় হড় করে বমি হতো। অথচ পানি পেতাম না বমির পর মুখ পরিষ্কার করার। আমাদের এই আতঙ্ক আর্মি গুলো খুব উপভোগ করত। লাইনে দাঁড় করিয়ে মানুষ মারার সময় আর্মি গুলো হলিডে মুডে থাকত। মানুষ মারার মত কুৎসিত দৃশ্য যে এতো আনন্দদায়ক হতে পারে তা ঐ অসভ্য পাক আর্মিদের না দেখলে কখনো জানা হতো না।
কথা গুলো শুনে আবীরের পেশী শক্ত হয়ে উঠে। রক্ত গরম হয়ে যায়। দাঁত কিড়মিড় করে। এদেশের মধ্যেই দেশের ছেলেদের এভাবে মারা হচ্ছে। আর ও কিনা কিছুই করতে পারছে না।
: তুমি বাঁচলে কিভাবে?
: সে এক অলৌকিক ব্যাপারের মতো। সেদিন লাইনে দাঁড় করানোর কথা। এমন সময় এক মেজর আসেন। বিভিন্ন জনকে দেখছিলেন। হঠাৎ আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কি? বললাম ফুয়াদ।
: তোমাকে কি বিদ্রোহীদের অবস্থান থেকে ধরে আনা হয়েছে?
: না আমি আমার খালার বাড়ি যাচ্ছিলাম।
মেজর সামনে গিয়ে আর্মিটির সাথে কি কথা যেন বলল। তারপর একজন আর্মিকে ডাক দিয়ে বললেন- এর বাঁধন খুলে দিয়ে আমার রুমে নিয়ে এস।
মেজরের রুমে ঢুকতেই কলিংবেল টিপলেন। একজনকে নির্দেশ দিলেন বিভিন্ন খাবার আনতে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- তোমার মত আমার এক ভাই ছিল। ঠিক তোমার চেহারার। বিমান বাহিনীতে ঢুকেছিল। আমার ভাইটি খুব মেধাবী ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে ও দুইটা কোর্স শেষ করে ফেলে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। এক বিমান দূর্ঘটনায় মারা যায়। তোমায় দেখে আমার ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। ওর নাম ছিল ইফতি। আমার মা এখনও ইফতি আসার প্রতিক্ষায় আছেন। ওর কাপড় গুলো নিয়মিত ধুন। পরিষ্কার কাপড়গুলোই বার বার নিজ হাতে ধুয়ে দেন। ইফতি আসলে কাপড়গুলো পড়বে বলে তার ধারণা। তুমি এক্ষুণি চলে যাও। এসময় ঘর থেকে কম বের হবে। কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবা। এই নাও আমার ঠিকানা। একটা কাগজে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ঠিকানাটা পকেটে ভরে নেয় ফুয়াদ।
আসার সময় ফুয়াদ আবীরকে বলে আমার ভাগ্য ভালো। না হলে ঐদিন মেজরটি যদি না আসত তবে নির্ঘাত মরতে হতো। যেনতেন মরা নয়। পশুর মত মরা।
সেদিন ফুয়াদের কাছ থেকে নির্যাতনের কথা গুলো শুনে আবীরের প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে উঠে। বাসায় এসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ওর বন্ধু রফিক যে কিনা ওর সাথে একই ক্লাসে পড়ত সে ট্রেনিংয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আবীরকেও ডেকেছিলো। আবীর রাজি হয় নি মা-বাবার ভয়ে। কিন্তু ফুয়াদের কথা গুলো শুনে আর কোন বাধা ও মানতে চায় না। সেদিনই রফিকের সন্ধানে বের হয়। ওকে নিজের আগ্রহের কথা জানায়। ওর সাথে গিয়ে চুপি চুপি পনের দিনের একটা ট্রেনিংও নিয়ে ফেলে।
আবীর যখন হাসপাতালে পৌছে তখন সূর্যটা আকাশের ঠিক মধ্যখানে। খুব গরম পড়ছে। হাসপাতালটা পুরানো। সামেনে বেশ কয়েকটি গাড়ি দাঁড়ানো। হাসপাতালকে নিরাপদ জায়গা মনে করে অনেকে হাসপাতালের সামনেই গাড়ি পার্কিং করে রেখে গেছে। আবীরদের মিলিত হওয়ার স্থান হাসপাতাল নির্ধারণ করার কারণ নিরাপত্তা। কেউ যাতে সন্দেহ না করে এজন্য।
হাসপাতালের সামনে একটা ছেলে পিয়াজু বিক্রী করছিলো। আবীরের খেতে ইচ্ছে করছে। পিয়াজু অলাকে ডাক দিলো।
: চারটা পিয়াজু দেয়তো।
একটা কাগজের প্যাকেটে চারটা পিয়াজু ভরে আবীরের হাতে দিল। আবীর তা নিয়ে টাকার জন্য পকেটে হাত দিতেই ভীমরি খেল। ম্যানিব্যাগটা আনা হয়নি। প্যান্টের পিছনের পকেটটাতে ও মানিব্যাগ রাখে। আনতে মনে নি। ভাগ্য ভাল রিকসা করে আসেনি। তাহলে ভাড়া দিতে গিয়ে ফ্যাসাদে পরে যেত। আবীরের ভুলো মন। এই ধরণের ভুল ওর মাঝে মাঝেই হয়। ট্রেনিং নেওয়ার সময় রিয়াজ ভাই ব্যাপারটা জানতে পেরে তা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতেন। বলতেন, আবীর তোমার যে ভুলো মন, তাতে হয়ত দেখা যাবে তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে। শত্রুর সামনে। অথচ তোমার অস্ত্র তোমাদের ঘর পাহাড়া দিচ্ছে। এ কথা শুনে সবাই হেসে ফেলতো। এতো হালকা গড়নের রিয়াজ ভাই। শরীরে এতটুকু মাংস। অথচ কি শক্তি। উনি যখন প্রথম আবীরকে জড়িয়ে ধরেন। তখন তার হাতের চাপে আবীরের শরীরের সব হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। পরে আবীর জেনেছিলো, যে কেউ ট্রেনিং নিতে আসলে শক্তি পরীক্ষা করার জন্য নাকি তিনি এতজোরে চাপ দেন।
আবীর পিয়াজুর প্যাকেটটা ফেরত দিতে যাবে এসময় দেখা গেলে রফিক আসছে। ওকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। চোখে সানগ্লাস লাগানোর কারনেই হয়ত। ওকে দেখে আবীর বলল- দোস্ত ভাংতি টাকা হবে? পিয়াজু নিয়েছি। অথচ মানিব্যাগ রেখে এসেছি বাসায়।
রফিক হেসে উঠে। পিয়াজুর দাম মিটিয়ে দেয়।
ওরা দুজন পিয়াজু চিবোতে চিবোতে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ায়। কাউন্টারের সামনে সুমন আগেই দাঁড়ানো ছিল।
রফিক জিজ্ঞেস করে, তারেক আসেনি।
সুমন জানায়, তারেক ও আমি এক সাথেই এসেছি। তোদের আসতে দেরি হচ্ছে বিধায় ও একটু বাইরে গেছে সিগারেট আনতে।
টিকেট কাউন্টারের সামনে ভীড় নেই। দুপুর বেলা। ডাক্তাররা একটু পরেই লাঞ্চে যাবে। তাই এ মুহূর্তে কেউ টিকেট নিতে আগ্রহী নয়।
সুমনকে দেখতে শুকনা লাগছে।
আবীর ও রফিকের ঢাকা শহরেরই বাসিন্দা হলেও সুমন ও তারেক এসেছে বাইরে থেকে। সুমন ফেনীর পরশুরাম থেকে। আর তারেক কুমিল্লার ঠাকুরপাড়া থেকে। দুজন আলাদা দুই বাসায় উঠেছে।
আবীর সুমনকে জিজ্ঞেস করে, কিরে সুমন তোকে শুকনা লাগছে কেন? যে বাসায় উঠেছিস ঐখানে ঠিকভাবে খেতে টেতে দেয় না নাকি?
রফিক ও বলে: আমারও তাই মনে হচ্ছে। রিয়াজ ভাই থেকে শুনেছি সুমন যে বাসায় উঠেছে সেটার কর্তা নাকি সাংঘাতিক দেশ প্রেমিক। তার বাসায় থেকে সুমনের এই অবস্থা কেন হবে তা বুঝতে পারছি না।
সুমন বলে, বাড়ির কর্তা শুধু দেশপ্রেমিক নয়। মারাত্মক সন্দেহ প্রবণ ও বটে। একদিন রাত দুইটায় এসে হাজির। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- বাবা একটু উঠবা? কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে? তুমি কষ্ট করে পাকঘরের দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি দেখি কে এসেছে। সময় খারাপ। বলাতো যায় না। আর্মি কিনা কে জানে। আমি আর্মির কথা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। পাকঘরের দরজা দিয়ে বাহির হই। আফসোস হচ্ছিলো সুন্দর ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায়। যেখানে দাড়িয়েছি সেখানে শুধু মশা আর মশা। এত মশা দেখে ভয় লাগছিলো শরীরে রক্ত নিয়ে ফিরতে পারবো কিনা? মশার কামড় সহ্য করে গাছের আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছি। আওয়াজ হবে এই ভয়ে মশাও মারতে পারছি না। মশারাও স্বাধীনভাবে কামড়াচ্ছেতো কামড়াচ্ছে। সময় কাটানোর জন্য আমি পাকিস্তানী আর্মিদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলাম। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক হাসিমুখে এসে বলল- চলে আসো। দরজার বাইরে কাউকে দেখলাম না। বাতাসে নড়েছে হয়ত। এবার দেখুন অবস্থা। বাতাসের ভয়ে আমাকে কি কষ্টই না করতে হলো? তবে ভদ্রলোক ভীষণ ভালো। প্রায় সময় এসে আমার সঙ্গে গল্প করেন। তার গল্প শুনলে মনে হবে এই কয়েকদিনেই দেশ স্বাধীন হবে। যদিও এটা দুরাশা। তারপরও তার কথাগুলো শুনলে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস চলে আসে দেশ শীঘ্রই স্বাধীন হবে।
এরই মধ্যে তারেক চলে আসে। ওর হাতে সিগারেট। তারেক রঙচঙের একটা গেঞ্জি পড়েছে। ভীষণ ফূর্তিবাজ ছেলে ও। আমুদে প্রকৃতির। তারেক এমন ছেলে যে মরার আগ মুহূর্তেও হয়ত রসিকতা করতে ভুলবে না। আজরাইল আসলে হয়ত তাকে জিজ্ঞেস করবে আপনার হাত দুটো ধুয়ে এসেছেনতো? আমার পবিত্র আত্মা কেউ ময়লা হাতে ধরুক এটা আমি কোনমতেই চাই না।
ওরা চারজনে হাসপাতালের দুতলায় গিয়ে উঠলো। করিডোর দিয়ে হেঁটে একেবারে কোণায় চলে আসল। জায়গাটা নিরিবিলি। সেখানে দাঁড়ালো ওরা। কথা যা এখানে সেরে নিতে হবে। তাদের এমন ভাবে থাকতে হবে যাতে কেউ দেখলে মনে করে কোন রোগী দেখতে এসেছে ওরা।
তারেক হাতের সিগারেটটা ধরালো। সেটা থেকে লম্বা একটা টান দিল। ওদেরকে গম্ভীরভাবে বলল- একটা সমস্যা হয়ে গেছে। তা শুনে তিনজনই আঁতকে উঠলো। ক্যাম্প থেকে কয়েকটা প্যাকেট আনার দায়িত্ব ছিল তারেকের উপর। প্যাকেটগুলোতে বোম থাকবে। এখন তারেক যদি সমস্যায় পড়ে তাহলে হাতে নেওয়া মিশনটা চালানো যাবে না। অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করে বহু ভেবে চিন্তে একটা মিশন হাতে নেওয়া হয়। পরিকল্পনামত একটা মিশন না চালানো মানে অনেক বড় ক্ষতি হওয়া।
আবীর বলল- সমস্যাটা কি? ক্যাম্প থেকে প্যাকেট গুলো কি তুই ঠিকমত আনতে পারস নি?
: তা পেরেছি। এনে আমি যেখানে উঠেছি ঐই বাসায় রেখেছিও।
একথা শুনে সকলের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসল। ভয় পেয়ে গিয়েছিল ওরা। ভেবেছিল প্যাকেট গুলো ক্যাম্প থেকেই আনা যায়নি।
: তাহলে সমস্যার কথা বললি যে।
: ঘরেই সমস্যা। প্যাকেট গুলো একটা বাজারের ব্যাগে করে ঘরে এনেছি। এমন ভাবে এনেছি কেউ বিন্দু মাত্র সন্দেহ করতে পারেনি। তবে ঘরে আসার পরই বিপত্তিটা হয়। ব্যাগটি ঐ ঘরের বড় মেয়েটা দেখতে পায়। আমি বাথরুম থেকে এসে দেখি ব্যাগ নেই। তা দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই অস্বীকার করল। পরে বেশি চাপা চাপি করাতে বলল, ও নিয়ে অন্য জায়গায় রেখেছে। বলছে তা নাকি ফেরত দেবে না।
আবীর তা শুনে একটু বিরক্ত হল। বলল- এইতো দেখি মহা সমস্যা। মেয়েটা বোমগুলো নিয়ে করবেটা কি?
তারেকের একটা সিগারেট টানা শেষ হয়েছে। আরেকটা ধরিয়েছে ও। বলল- মেয়েটা কিছু করবে না। ওর ধারণা হয়েছে বোমগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে আমার মৃত্যু হবে। যাতে আমি না মরি সেজন্যই নাকি সে এই ব্যবস্থা নিয়েছে।
: তুই ওকে বলিস নি এগুলো তুই ব্যবহার করবি। ব্যবহার করার দায়িত্ব অন্যজনের।
: বলি নি মানে। একশো বার বলেছি। এমনও বলেছি আমি বোমা ব্যবহার করতেই জানি না। আক্রমণ করাতো দূরের কথা। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই বিশ্বাস করে না। আমি নাকি ওকে মিথ্যা বলছি।
সুমন চুক চুক করে বলে, হায়রে প্রেম। ভাগ্য ভাল আমি যে ঘরে উঠেছি সেখানে কোন কন্যা সন্তান নেই। ঝামেলা মুক্ত। আমার মনে হচ্ছে তারেককে মেয়েটা বিয়ে না করে ছাড়বে না। তারেকের যুদ্ধ বোধ হয় এখানেই শেষ। তারেক মেয়েটা দেখতে কেমনরে। খুব সুন্দর নিশ্চয়। তুইও শালা ভালোই মজেজিস। মেয়েটার কথা বলতে গিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছিস।
রফিক ধমক দিয়ে উঠে। এগুলো এখন বাদ দেয়। অপ্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন দেখছি মহা সংকটে পড়ে গেলাম। অন্য কেউ হলে ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসা যেত। কিন্তু নিয়েছে মেয়ে মানুষে। আরো আবেগের বশে। ঐগুলো উদ্ধার করা যে অনেক কষ্ট হবে তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এম্নে ঝামেলায় বাঁচি না। তার উপর বাড়তি ঝামেলা। এই যুদ্ধের সময় মেয়েগুলোর আর খেয়ে দেয়ে যেন কাজ নেই।
সমস্ত মেয়ে জাতির উপর রফিকের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে।
আবীর এতক্ষণ ভাবছিলো। ও দলের অধিনায়ক। এটা ওর দ্বিতীয় মিশন। এর আগের মিশনটা চালিয়েছিল এক মফস্বল শহরে। ও বলল- এ ব্যাপারটা কালকে দেখলেও চলবে। আমাদের হাতে আরো কিছু সময় আছে। আমাদের উচিত বিচ্ছিন্ন ভাবে রিয়াজ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ রাখা। এক এক সময় এক একজন ওনার কাছে যাব। আমরা গেলে ওনারও সুবিধা। আমাদের যেহেতু প্রশিক্ষণ আছে তাই নতুনদের শেখাতে পারব। ফলে আমাদের এক প্রকার প্র্যাকটিসও হয়ে যাবে। রিয়াজ ভাইয়ের উপরও চাপ কম পড়বে।
হঠাৎ করে দরজা খোলার আওয়াজ হল। দরজার রঙ সাদা। দেয়ালের রঙের সাথে মিশে গেছে বিধায় তারা এখানে যে দরজা আছে তা খেয়াল করে নি। দরজা খুলে যে বের হল তা দেখতে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
সাদা শাড়ি পরা। মাথা টুপি দেওয়া হাসপাতালের নার্স। বয়স একেবারে কম। চেহারা এখনও বালিকা সুলভ। নতুন ঢুকেছে হয়ত। অসম্ভব সুন্দর। এই ধরণের নার্স দেখলে যে কারো-ই ইচ্ছে হবে রোগী হয়ে যেতে।
আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তবে আমি নিশ্চিত ভাবে বলছি আপনারা মুক্তিযোদ্ধা।
কথাটি মিষ্টি গলায় বলেই হাসলও। যেন তাদের দুষ্টামিটা ধরে ফেলেছে।
মেয়েটার কথা শুনে ওরা চারজনই চমকে উঠল।
: চমকাবেন না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমি আপনাদের কথা শুনছিলাম। না শুনেও উপায় ছিল না। আপনারা যে আওয়াজে বলছিলেন সবগুলো ভিতরে স্পষ্ট ভাবে শুনা যাচ্ছিলো। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার সাথে ভিতরের রুমে কেউ ছিল না। আর আমিও কাউকে যেয়ে বলছি না আপনারা যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন। তবে আপনাদের আরো সাবধান হওয়া উচিঠ। এভাবে চললেতো ধরা খেয়ে যাবেন। আমিও চাই এদেশ স্বাধীন হোক।
ফিনাইলের গন্ধ আসছে। গন্ধটা খুউব অস্বস্তিদায়ক। মাথা ধরে যাবে মত অবস্থা। দরজা বন্ধ থাকায় এতক্ষণ গন্ধটা তীব্রভাবে উপলব্ধি হয়নি। দরজাটা খোলা থাকায় তা তীব্র ভাবে আসছে।
আবীর বলল- দরজাটা কি একটু বন্ধ করে দেওয়া যায়। ফিনাইলের গন্ধটা ভালো লাগছে না। গন্ধে মাথা ঝিম হয়ে আ�