শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১৬

ভুল

০১..
সিরাজ সাহেবের মোবাইলে একটার পর একটা কল আসছে। তিনি বেশ বিরক্ত। মোবাইল বন্ধ রাখলেই ভালো হতো। কিন্তু সেটা করা সম্ভব না। যেকোন সময় খবর আসতে পারে। তাই মোবাইলটা সাথেই রাখতে হচ্ছে।
বেশির ভাগ নাম্বারই আননোন নাম্বার। পরিচয় দেয়ার পর চিনতে পারছেন।
: কে বলছেন?

: আমি হাবিব। হাবিব মন্ডল। আপনি যখন চকবাজারে ছিলেন তখন আমার দোকান থেকে আপনি মুদি বাজারি করতেন।
সিরাজ সাহেবের মনে পড়ে। এঘটনা তাহলে সেও জেনে গেছে। তারপর আবার তার নাম্বারও যোগাড় করেছে।
: আচ্ছা, আপনারা কি আগে টের পান নাই কিছু?

আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো বলে লাইন কেটে দেন সিরাজ সাহেব।
যারা এতদিন কোন যোগাযোগ রাখেনি তারাও ফোন দিচ্ছে। খবরটা জানতে চাচ্ছে। খারাপ খবরগুলোর জন্য মানুষের আগ্রহ বেশি। সবাই জানতে চায়। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে নিজের কাছেই।

আলমারি থেকে টুপিটা বের করেন সিরাজ সাহেব। অনেক দিন নামাজ পড়া হয় না তার। নামাজ পড়লে হয়ত মনে শান্তি আসবে।

টুপিটা মাথায় পড়তে গিয়ে আগের স্মৃতি মনে পড়লো। রুহির বয়স আড়াই কি তিন। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুইটি তার। ওই হাতে টুপি এনে তার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বলত, আব্বু, মসজিদে যাও। নামাজ পড়লে অনেক অনেক সওয়াব হবে। নাহলে কিন্তু তোমাকে আগুনে পুড়তে হবে।
: তোমাকে এগুলো কে বলেছে মা?
: নানু বলেছে।
ছোট্ট মেয়ের সব কথা রাখার চেষ্টা করতেন। সে যখন মসজিদে যেতে বলত, তিনি ইচ্ছা না থাকলেও যেতেন।
তার শাশুড়ি ছিলেন অত্যন্ত ধর্ম ভীরু। তিনিই নাতনীকে শিখিয়ে দিতেন।
সে ঘটনাগুলো কত সুন্দর ছিল!

০২.....
তিন দিন আগে দুর্ঘটনাটি ঘটে। তার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সকালেও একই টেবিলে নাস্তা করলেন। পড়ালেখার খবর নিলেন।
: তোমার পড়ালেখা ঠিকভাবে চলছে তো।
: হা ঠিকভাবেই চলছে।
: কোন সমস্যা আছে?
: না বাবা।

ফেসবুকে কার সাথে যেন পরিচয় হয়। ওই ছেলের সাথে বিকেলে পালিয়ে গেছে। ঘটনাটি থানায় জানানো হয়েছে। কিভাবে যেন সাংবাদিকরা জেনে গেছেন। তারা রিপোর্ট করে দিয়েছে। এর পর থেকে শুধু ফোন আর ফোন আসছে। নতুন ফোন আসলে তার মনে হয়, এই বুঝি কোন খবর আসলো তার মেয়ের।
না, প্রতিটি ফোনই হচ্ছে কৌতুহলীদের। আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শী, পরিচিতদের। তারা ঘটনা কেম্নে ঘটল জানতে চায়। যেন এটা একটা দারুণ কোন ঘটনা। কেউ কেউ সমবেদনা দেখানোর চেষ্টা করে। সেগুলো আরও বেশি বিরক্তিকর। যে ঘটনা ঘটিয়েছে তাকে ছাড়িয়েন না। নামটা যদি জানতে পারতাম আমিই হাড্ডিগুড্ডি ভেঙ্গে দিতাম। কেম্নে পারে!

তিনি কিছু বলেন না। নিজেকে অনেক বেশি দুর্ভাগা মনে হয়।


০৩....
একসময় সিরাজ সাহেবও ফেসবুক ব্যবহার করতেন। তখন দেখতেন কারো কারো স্ট্যাটাসে অনেক বেশি লাইক। তখন তিনি বেশি লাইক পড়া পোস্ট গুলো গবেষণা করতেন। কেন তারা লাইক বেশি পায়। তারও ইচ্ছে জাগে লাইক বেশি পাওয়ার। যারা লাইক বেশি পায় তারা সেলিব্রেটি। তিনি সেলিব্রেটি হবেন। পোস্ট দেবেন আর অনেক অনেক লাইক আসবে। বেশ কিছু টেকনিক বুঝে নেন।

তখন তিনি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। ইন্টারনেটে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়লো। ভিডিওতে এক স্কুল ড্রেস পড়া ছাত্রীকে একজন প্রপোজ করছে। আর তার পাশে থাকা বন্ধুরা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। ওই দুইজন তখন দুইজনকে জাপটে ধরে রেখেছে। আবেগীয় জাপটানো যাকে বলে। অনেকে ওই ছবি দেখে গালাগালি করতেছিল।

লাইক বেশি পাওয়ার সূত্র কিছুটা আবিষ্কার করে নিলেন আগেই সিরাজ সাহেব। তিনি বিষয়টা মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। ভালোবাসার পক্ষে ইনিয়ে বিনিয়ে একটা স্ট্যাটাস লিখলেন। ওই দুইটি ছেলে মেয়ে কোন অন্যায় করেনি। তারা তাদের ভালোবাসা মাত্র প্রকাশ করেছেন। এটা করতেই পারেন। ভালোবাসা প্রকাশ করা কোন অপরাধ না। কোন আইনেই এটা অপরাধ না। এটা কোন শাস্তিযোগ্য কাজ হতে পারে না। ওই স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়ের কোন দোষই নেই। ভালোবাসার বিষয়টাকে মহান করে উপস্থাপন করলেন।
লাইক পাওয়ার সূত্র যেহেতু আগেই বুঝে নিয়েছিলেন তাই সমস্যা হলো না। তার ওই স্ট্যাটাসে সর্বোচ্চ লাইক এসেছিল। পাঁচ হাজারের ওপর লাইক ছিল।

ওই স্ট্যাটাসের কথা মনে পড়তেই কেমন জানি বুক ব্যথা শুরু হলো সিরাজ সাহেবের। এত বছর আগে দেয়া স্ট্যাটাসটা ভুল ছিল মনে হচ্ছে। মেয়ে ফিরে আসবেতো!

ফেবুতে ভুল