বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৫

অনুরোধ (গল্প)*

তমার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। কাগজপত্র অনেকটাই রেডি। দুই জনে স্বাক্ষরের পর তার কাজ শেষ। দেড় বছরের সম্পর্ক কাগজে কলমে শেষ হচ্ছে। আমার কেমন লাগছে, তা দেখাচ্ছি না। উপর দিয়ে একটা ফূর্তির ভাব ধরে রেখেছি। তমা আগে থেকে কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির। খুব কাছের কারো সাথে সে অনেক চঞ্চল। আবার দূরের কারো সাথে সে পুরাই অন্যরকম। একটা গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে। কিছু বললে হাসি মুখে উত্তর দেয়। তাও মাপা হাসি। অতটুকু। নিজে আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না।

তমার কাছে এখন আমি অনেকটা অপরিচিত কেউ যেন। ঠিক এড়িয়ে যাচ্ছে না। কিছু বললে উত্তর দেয়। নাহলে চুপ থাকে।

মাথা ব্যথা করছে। অন্য সময় তমা মাথা ব্যথা বললে মাথার চুল টেনে দিতো। ওর কোলে মাথা থাকতো। ও আস্তে আস্তে মাথার চুল টানতো, আঙ্গুল দিয়ে কপাল চেপে দিতো। আমি কখনোবা ওইরকম অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়তাম।

মাথা ব্যথায় মনে হচ্ছে রগগুলো ছিড়ে যাবে। আচ্ছা তমাকে এখন যদি মাথা ব্যথার কথা বলি ও কি করবে? ওষুধ খেতে বলবে। ওষুধটা কোথায় সেটাও বলবে না হয়ত। এতটাই দূরত্ব এখন আমাদের মাঝে।

আমরা এখন দুই রুমে শুই। যেখানে আগে দুইজনই থাকতাম সেখানে তমা থাকে। আমার আলাদা এক রুম আছে। লাইব্রেরী রুম, চারটা সেলফ। সব বই আর বই। দুইটা টেবিল। একটা টেবিলে ডেস্কটপ, অন্য আরেক টেবিলে লেখালেখি করার সামগ্রী।

সেখানে একটা সিঙ্গেল বেডও আছে। পড়তে গিয়ে বিরক্ত লাগলে সেখানে শুয়ে পড়তাম। এখন রাতেও ওই খাটেই ঘুমাই। যদিও তমা বলেছিল, সে অন্য রুমে থাকবে। আমি সে আগের বেডরুমেই থাকতে পারবো। তখনও ডিভোর্সের চিন্তা ভাবনা আসে নি কারো মাথায়। দুইজনই দুইজন থেকে একটু আলাদা থাকতে চাচ্ছিলাম।

: তুমি বেড রুমেই থাকো।
: না, লাইব্রেরী রুমে আমার আগে থেকে ঘুমানোর অভ্যাস আছে। সেখানে আমার সমস্যা হবে না। আর তাছাড়া খাট পরিবর্তন করলে তোমার ঘুম হয় না। তাই তুমি এখানেই থাকো।
: আচ্ছা, ঠিক আছে।

সেদিন রাতে বেডে শুয়ে পড়েছি। এসময় ভাবছিলাম। একসময় কত কথা হতো দুই জনের। চাঁদ আকাশে থাকলে ছাদে চলে যেতাম। আমি চাদের বর্ণনা অনেক সুন্দর দিতে পারলেও চাঁদ সেভাবে কখনো উপভোগ করতে পারতাম না। চাঁদ উপভোগের ব্যাপারটা তমাই আমাকে শিখিয়েছে। তমা ছাদে নিয়ে যেতো। কিছু পড়ছিলাম। উঠো উঠো।

: একটা ব্ই পড়ছি তো।
: আরে বই পড়ার অনেক সময় পাবে। চাঁদ চলে গেলে আর পাবে না। উঠোতো।

ছাদে তমা চাদর পেতে দিতো। সে চাদরে আমরা বসতাম। তমা ক্লাস স্কুল জীবনের গল্প বলত। তার এক বান্ধবীর গল্প বলতো যার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। সে এসে এমন এমন কিছু ঘটনা শেয়ার করতো ওদের কান গরম হয়ে উঠতো। একদিকে চলে যেতে ইচ্ছে হতো, অন্যদিকে শুনতেও চাইতো। আর ওদের এক বান্ধবী ছিল খুব দুষ্টু টাইপের। সে খুটিয়ে খুটিয়ে কথা বের করতো।

আমি হাসতাম।

: আচ্ছা তোমরা ছেলেরা তো আগে থেকে পাজি হয়ে যাও। তোমার কিছু শেয়ার করো না।

আমার লজ্জা লাগতো। আমার দিকে তাকিয়ে তমা বলত, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। তোমার চেহারা লজ্জায় যেভাবে লাল হয়ে গেছে চাদেঁর আলোতেও তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

এরপর তমা বলত, আচ্ছা পাহাড় থেকে চাঁদ দেখা আরও বেশি ভালো লাগার হবে তাই না?
: হা। প্রথমত পাহাড় অনেক ওপরে। তাই চাঁদটাও কাছে মনে হবে, দ্বিতীয় সেখানে খোলা আকাশটা আরো বেশি খোলা। চারদিকে গাছপালা। অন্যরকম ভালো লাগবে।
: চলো না আমরা একবার বান্দরবান যাই।
: হা, যাবো।

পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু সময় মিলছিল না। তাই যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয়নি। তাছাড়া তমা আর জোরও করেনি। প্রথমদিকে যেভাবে আব্দার করতো। একটা সময় আর সেটা ছিল না।

এখন খারাপ লাগছে। বান্দরবানে যাওয়া উচিত ছিল। সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে কিছু স্মৃতি রেখে যায়। বান্দরবানে পাহাড় থেকে চাঁদ দেখার স্মৃতিটাও থাকতো। আর সেটা হবে না।

আমি একটু বেশিই নিজ কেন্দ্রিক। এ ব্যাপারটাই হয়ত তমার অপছন্দ। কিন্তু অপছন্দতা এত দূর চলে আসবে চিন্তাও করি নাই। ত্যাড়া একটা স্বভাব কিভাবে যেন গড়ে উঠেছে। সেটাও একটা কারণ ছিল। কিছু ব্যাপার ও আমাকে এড়িয়ে যেতে সহ্য করে। আমি সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না। আবার বলতেও পারছিলাম না।

একবার মনে হয়, সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচবো। আগের মত পুরাই স্বাধীন হয়ে যাবো। আবার ভাবি, জীবনে কিছু সুন্দর ব্যাপারের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেগুলো তো আর থাকবে না। তমাকে থেকে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু ওই তো একসাথে না থাকার ব্যাপারটা তুলেছে। অনুরোধ করে কি হবে?

অন্তত কথা তো বলা যায়।

সকাল হতেই ওর দরজার সামনে নক দিলাম। ভেতরে আসবো?
তমা শুয়ে ছিল। কাপড় কিছুটা এলেমেলো। আমি বাহিরে অপেক্ষা করি। বিষয়টা কেমন যেন লাগছিল। সম্পর্ক ব্যাপারগুলিই বোধ হয় এমন।

: হা আসো।

গলাটা কেমন অপরিচিত যেন।

আমি ভেতরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসি।তমা কিছু বলে না।
: এরপর কি করবে?
: বিদেশ চলে যাবো। রুবি খালার সাথে কালও কথা হলো। বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্রও অনেকটা রেডি। সামনের মাসে এম্বেসি ফেস করতে হবে।
: আমেরিকাতেই।
: হুম।তোমার কথা শেষ হয়েছে?

অপ্রস্তুত হই আমি। অপমান লাগে নিজের। কিছু না বলেই রুম থেকে বের হয়ে আসি। তমা ডাকেও না।

+++++++++++++++++++++
তমা বিদেশ চলে যাচ্ছে। আজ রাতেই ফ্লাইট। ডিভোর্স লেটারে সই এখনও হয় নাই। একটু জটিলতার কারণে আরেকটু সময় লাগবে জানানো হয় অফিসিয়ালভাবে। তমার কাছে পাঠানো হলে সে করে দেবে এমনই কথা বলা হয়।

আমি সকাল থেকে ঘরের বাহিরে। বিদায়ের সময় দেখা করতে চাচ্ছি না। রাত বারোটার দিকে ঘরে ফিরি।

তমা চলে গেছে।
ঘরটা কেমন খালি খালি লাগছে। বেড রুম সাজিয়ে গেছে। আমার লাইব্রেরী রুমে আমার যেসব কাপড় চোপড় ছিল সবই বেড রুমে এনে রেখে গেছে।

লেখার টেবিলটার ওপর একটা কাগজ টেবিলম্যাট দিয়ে চাপা দেয়া। লেক্সাস বিস্কুট প্যাকেট ছেড়া কাগজ। খালি দিকটায় লেখা, “একবারও কি থেকে যাওয়ার অনুরোধ করা যেতো না?”

তমার হাতের লেখা সুন্দর। এ লেখাটা আরও বেশি সুন্দর। হয়ত অনেকক্ষণ সময় নিয়ে লিখেছে। কিন্তু এমন একটা কাগজের প্যাকেটে লিখলো কেন? লেখার জন্য একটা সাদা কাগজ খুজে পেলো না?

মেয়েরা যতটা প্রশ্ন করে এর চেয়ে বেশি প্রশ্ন রেখে যায়। আজব!

রাতে ঘুমাতে যখন যাই তিনটা বাজে। মাথার বালিশ যখন সরালাম তখন আরেকটি কাগজ। তমার লেখা।

" আশা করি এতক্ষণে টেবিলের ওপর রাখা লেক্সাসের প্যাকেটের অপর পিঠের লেখা পড়ে ফেলেছো। জানি ওই লেখাটা তোমার কাছে কোন গুরুত্ব বহন করছে না। কারণ তুমি চিন্তা করবে সাদা কাগজে না লিখে লেক্সাস কাগজে কেন লিখলাম! ওই চিন্তাটাই তোমার কাছে বড় হবে। ওই লেখাটায় যে একটা আকুতি আছে সেটার চেয়ে বড় হয়ে যাবে লেক্সাস কাগজে কেন। ঠিক এটাই। তুমি মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। কিন্তু কোনটা ঠিক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা তুমি ধরতে পারো না। এটাই বড় সমস্যা। সেদিন যখন রুমে ঢুকলে ভাবলাম, তুমি আমাকে আরেকবার চিন্তা করতে বলবে। তা না করে উল্টা বললে, এরপর কি করবে। ব্যাপারটাকে কি স্বাভাবিক হিসেবে নিয়ে নিলে। অনেক অনেক লেখা লিখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লিখছি না। কি হবে লিখে?
ভালো থেকো... অনেক বেশি ভালো থেকো।"

ফেসবুকে : অনুরোধ