শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৫

ভ্রমণ : পাহাড়ে প্রথম পর্ব

সময়গুলো ছিল অসাধারণ। জীবনের শ্রেষ্ঠ্য সময়। অনেক দুর্গম এলাকায় গিয়েছি। দেখেছি অনেক ধরণের দুর্লভ জীবন ধারা, সংষ্কৃতি। প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ভাবে এত সুন্দর তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম শক্ত ভাবে। নিরাপত্তা, খাদ্য, আশ্রয়, অর্থ, যাতায়াত কোন কিছুর চিন্তা করতে হয় নাই। সব করা হয়েছে সামরিক, বেসামরিক প্রসাশন থেকে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে আর্মির গাড়ী, হেলিকপ্টার। সব সময় ছিল সামরিক প্রহরা। 


সে অন্যরকম সময়। বলছিলাম ভোটার লিস্টে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। ভোটার লিস্ট হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। এই ভোটার লিস্টের সুবাদে এত মজা যে পেয়েছি অন্য কোন প্রজন্ম তা পাবে কিনা সন্দেহ। রুমাতে গিয়ে প্রথম কাজ পড়ল বগালেকে। বগালেক হচ্ছে একটা বিশাল হ্রদ। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উপরে। চারদিকে কোন পানি আসার কোন পথ নেই। অথচ উঁচু উঁচু পাহাড়ের মধ্যে লেকটি দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর ভাবে। প্রায় সাড়ে তিনশন ফুট গভীর। কিংবা তারো বেশি। পানিতে বড় বড় পাথর। অতি স্বচ্ছ সে পানি। গলা সমান পানিতে দাঁড়ালেও উপর থেকে পায়ের পাতা স্পষ্ট দেখা যায়। গণনা যায় আঙুলগুলো। অনেক সুন্দর মায়াবী সে পানি। প্রচন্ড শীত ছিল আমরা যখন ছিলাম। তারপরও পানিগুলো কি উষ্ণ। আমরা পাঁচদিন ছিলাম সেখানে। রুমা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হেলি যোগে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। আর্মিরা হেলিকপ্টারকে হেলি বলে। কিছু কথাবার্তা তাদের মত বলতাম। :) হেলিতে অল্প কিছুক্ষণের পথ। হেলিকপ্টার থেকে লেকটি দেখে আমরা অভিভূত। হেলিকপ্টারের জানালা থেকে নিচে লেকটি দেখতেই মন ভাল হয়ে গেল। কেমন কালো পানি। অতি গভীরতার কারণেই তা মনে হয়েছে। সেখানে পাহাড়ীরা এক ধরণের কফি চাষ করে। সে কফি খেতাম আমরা। অনেক মজার। অন্যরকম স্বাদ। অথচ একেবারে প্রাকৃতিক। একে ৪৭ দিয়ে পাহারা দেওয়া হতো। নিরাপত্তায় ব্যবহার করা হতো এল এমজি। আমরা ভারী ভারী অস্ত্র গুলো নেড়ে চেড়ে দেখতাম। বেয়নটের ক্ষমতা শুনে অবাক হতাম। শুনতাম আর্মিদের অপারেশনের রোহমর্ষক বাস্তব গল্প। অনেক সুন্দর সে সব সময়। আমরা এসেছি বগালেক থেকে। আর যে আর্মি অফিসারকে আমাদের কমান্ডিংয়ে পাঠানো হয়েছে তিনি এসেছেন রুমা ক্যান্টনমেন্ট থেকে। নামার পর আমাদের সবাইকে ডাকলেন আর্মি প্রচলিত নিয়মে। এই এদিকে আসো। একটু খারাপ লাগছিল আমাদের। 

কমান্ড দিতে অভ্যস্ত হলে তো মুসিবত। সময় গুলো ভাল কাটবে না। দুশ্চিন্তার রেখা তখন কপাল জুড়ে। কার কি পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। সবাই বললাম। ঐটুকু কথাই। আমরা ধরে নিলাম ইনি যথেষ্ট কড়া টাইপের ব্যক্তি। আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। আমরা যারা সিভিল আছি তারা নিজেরা মিটিং করলাম। আমরা কিভাবে চলব তা নিয়ে। দেখি আমাদের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে স্কুল ঘর। টিনের স্কুল। এত দূর পর্যন্ত টিন আনা অনেক কষ্ট সাধ্য। সেখানে আবার বেঞ্চি আছে। সে বেঞ্চিগুলো একসাথে জোড়া লাগিয়ে খাটের মত করা হলো। সেখানের উপরে আমাদের বেড। থাকার ক্ষেত্রে ভালই। পাহাড়ী এলাকায় একটা সমস্যা মেঝেতে থাকলে। সাপের উৎপাত। কোন সময় যে এসে ঠোকর দিয়ে যাবে কেউ টেরও পাবে না। সাপের কামড় খাওয়ার ঘটনা এখানে নাকি খুব স্বাভাবিক। আমরা আমাদের মত ঘুরছি। অফিসার তার মত ঘুরছে। উনি উঠেছেন অন্য একটা ঘরে। উপজাতি এক বাসায় তিনি থাকছেন একা একা। আর একটা ঘরে সৈনিকরা থাকছে। আর্মি এবং বিডিআর। ঐ ঘর মাচাং ঘর। গাছের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। মাচাং ঘরের ঢুকার আগে বারান্দার মত খোল জায়গা আছে। সেখানে দুইজন বসে পাহারা দিচ্ছে। একটা এল এমজি টাক করা। এটা ভয়ানক অস্ত্র। ছোট টিফিন কেরিয়ারের মত একটা বক্স অস্ত্রের সাথেই লাগানো। ওজনও অনেক। একবার অনেক ফায়ার করা যায়। 
প্রতিবার যখন ঐ রাস্তা দিয়ে যাই তখন একটু ভয় ভয় করে। এত বিপদ জনক অস্ত্রের সামনে দিয়ে হাঁটছি বলে। যদি ভুলে ব্রাশ ফায়ার শুরু হয়ে যায়। কি অবস্থা হবে। এলাকায় বেশি ঘর নাই। কয়েকটি ঘর মাত্র। একটা ঘর থেকে শুনি আওয়াজ আসছে। সম্মিলিত আওয়াজ। হয়ত পড়ছে। আমরা উঁকি দিলাম সে ঘরে। দেখি ছোট ছোট বাচ্চারা কি যেন পাঠ করছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। আমরা মাঝে মাঝে অফিসারের দিকে তাকাই। তিনি একা একা ঘুরছেন। আমরা বিরক্ত হই। এরকম মুডি একজনকে আমাদের সাথে দেওয়া হলো। ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে অনেক বেশি কড়া। একটু পর পর তিনি শুকুর দেখলে গাছের টুকরা ছুড়ে মারছেন। এটা যেন তার নেশা হয়ে গেছে। হয়ত শুকুর ভয় পান। সেজন্য গাছ ছুড়ে মারেন। তবে সেগুলো অনেক বেশি চালাক। একটাও ঐগুলোর গায়ে পড়ে না। এসময় দেখি অফিসার ভদ্রলোক আমাদের পিছে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ান। সূর্যটা অনেক সুন্দর আজ। তাই না? আমরা গলা মিলাই, জ্বী। আফসোস ঝড়ে পড়ে তার গলায়, ইশ ভুলে ক্যামেরাটায় আনা হলো না। ক্যামেরা আনলে অনেক সুন্দর ছবি তোলা যেত। এ দৃশ্য গুলো বন্দী করে ফেলা যেত। এবার আশার আলো খুঁজে পাই। আকাশের সৌন্দর্যের রঙ তার মনেও প্রভাব ফেলেছে। কি সুন্দর বন্ধুর মত কথা বলছে। -ক্যামেরা আমাদের কাছে আছে। -তাই? মুখে খুশীর রেশ। তাই নাকি? তাহলে তো অনেক ভাল হয়েছে। সে থেকে শুরু এরপর শুধুই বন্ধুত্ব। শুধুই আলাপন। শুধুই খেলাধূলা। নো কমান্ডিং। বন্ধুর মত চলা। রাতে আর্মি মোস্তাফিজ ভাই পড়ছেন ডিউটিতে। তিনি আগেও বগালেকে আমাদের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ডিউটি দিচ্ছেন। তার হাতে একে ৪৭। বাহিরে অনেক বেশি শীত। চাঁদের আলোতে চারদিক আলোকিত। মোস্তাফিজ ভাইয়ের সাথে আরেক জন আছেন। সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কম্বল জড়িয়ে বাহিরে এলাম। আরো একজন এলো। বসলাম বাহিরে রাখা উঁচু বেঞ্চগুলোতে। চাঁদের আলোতে কেওকাডাডং, তাজিংডংকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিল। মুস্তাফিজ ভাই জানালেন, এখানে আরকান বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। আরকান বাহিনীর নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু ওরা আসলে কারা তা জানি না। জিজ্ঞেস করলাম, আরকান বাহিনী কারা। -মায়ানমারে যখন ক্ষমতা দখল হয় তখন একটা বিগ্রেড মেনে নেয় নি। তারা কেন্দ্রীয় কমান্ড মেনে নেয়নি। তারা বিদ্রোহ করে বসে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ঐ বিদ্রোহী কমান্ডের সদস্যরাই আরকান বাহিনী। -এখনো আসে নাকি? -হা আসে। তবে আগের মত এত শক্তিশালী না। তারপরও একেবারে দুর্বল না। এমন কি ওদের ছদ্ম বেশী গোয়েন্দাও এখন এ এলাকায় আছে। শুনে ভয় লাগে। কয় কি? ভয়ে বিদেশী কম্বল আরো জোরে শরীরে চাপিয়ে নিই। ভাবটা এমন যেন আরকান বাহিনী গুলি করলে এই কম্বল আমাকে বাঁচাবে। -ভাই আমার তো মারাত্মক ভয় করছে। আমার সাথে যে ছিল সেও গলা মিলাল। মোস্তাফিজ এবার পার্ট নেওয়ার চেষ্টা করেন। আরে ভাই এত ভীতু হলে চলে। তবে ভয়ের কিছু নেই। তাদের এত বড় বুকের পাটা হয় নাই যে সামনে এসে লড়াই করবে। ওরা মাঝে মাঝে পিছন থেকে আক্রমণ করে। তবে সামনে এসে আক্রমণ করার মত সাহস ওদের নেই। আমি বলি- যদি করে বসে? ওরা এত বোকা না। করে বসলে পালানোর পথ পাবে না। ওরা জানে এল এম জি তাক করা আছে। আসলেই খতম হয়ে যাবে। এল এম জি দিয়ে ১০ কি.মি এলাকার সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়া যায়। একসাথে অনেক ক্ষণ ফায়ার করা যায়। তাই ওরা ভয়েও আসবে না এখন। পরানে একটু পানি আসে । তারপরও ভয় থেকে যায়।

কাঁচা হাতের গল্প পেইজে : পাহাড়ের ভ্রমণ ১ম পর্ব