শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬

হেলিকপ্টার (গল্প)

আখির মন খারাপ। এতদিন যে রুমে থাকতো সে রুম ছাড়তে হবে, যে টেবিলে পড়তো তা ছেড়ে যেতে হবে। শুধু রুম, টেবিল না। শহরটাই ছাড়তে হবে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে। সেখানেই চলে যেতে হবে। সামনে এক জানুয়ারি থেকে ক্লাস শুরু। দিন যত ঘনিয়ে আসছে তত মন খারাপ বাড়ছে।
ওরা দুই ভাই বোন। ভাইটা ওর ছোট। ক্লাস ফোরে পড়ে। ভাইকে, মা-বাবা ছেড়ে থাকতে হবে। ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হলে আর মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারবেন না। রাত জেগে পড়তে দেখলে নুডলস, চা বানিয়ে দেবেন না।


ব্যালকনিতে কয়েকটা টব আছে। দুই ভাই বোনের আলাদা করে ভাগ করা টবগুলো। সেখানে দুই জনের দুইটা মরিচ গাছ আছে।
এক সকালে ছোট ভাইটার চিল্লানি। আম্মু দেখো দেখো আমার গাছে মরিচ ধরেছে। আমি ফাস্ট। আপুর গাছে মরিচ ধরে নাই। আমার গাছে মরিচ। আমি ফাস্ট, আমি ফাস্ট!
মা ছুটে আসে, আখি ছুটে আসে। ঘটনা কি দেখার জন্য।
ফুল পর্যন্ত যে গাছে দেখা যায়নি, সেখানে হুট করে মরিচ হয় কিভাবে?
আখি টবের কাছাকাছি যায়। মরিচ ধরতে হাত বাড়ায়।
ভাইটা চিৎকার দেয়। খবরদার আমার মরিচ ধরবে না। এটা ছেড়ার কোন দরকার নেই। গাছেই থাকুক।

যা ভাবছিল তাই। গতকাল বাসায় মরিচ আনা হয়েছে। সেখান থেকে একটা মরিচ নিয়ে কস্টেপ দিয়ে গাছে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘটনা এটাই।
: আম্মু, দেখছো। তোমার ছেলের চালাকি!
মা, হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। ব্যাপারটা ধরে ফেলায় কিছুটা লজ্জা পায় ভাই। সে পালিয়ে যায়।
মাঝে মাঝে সে এমন অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটায়!
একদিনতো মায়ের কাছে গিয়ে বলে, আম্মু আপু না প্রেমে পড়ছে।
: বলস কি? তুই জানলি কিভাবে?
: দুই তলার সবুজ ভাই আছে না? লম্বা করে, ফর্সামত চেহারা। চোখে চশমা পড়ে। তার সাথে আপুকে দেখেছি।
মা একটু টেনশনে পড়ে যান। আখি তো এমন না। তাও বলা যায় না। বয়সটা খারাপ। কি কখন হয় বলতে পারা যায় না। মেয়ের থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
তার আগে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন, তুই কোথায় দেখেছিস।
এবার গম্ভীর গলায় উত্তর দেয়, গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি।
এত্ত দুষ্ট যে হয়েছে ছেলেটা!!

আখি ওর চশমাটা মুছে। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। নিচে কয়েকটা ছেলে থাকে। টং দোকানে বসে আড্ডা দেয়। এরমধ্যে একটা ছেলে খুব চুপচাপ। চা খেতে খেতে অন্য বন্ধুদের গল্প শুনে। নিজে তেমন কিছু বলে না। কেমন নিরীহ টাইপের একটা ছেলে। মাঝে মাঝে ওর একটা ইচ্ছা হয়, ছেলেটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, আচ্ছা আপনি কথা বলেন না কেন? বোবা আপনি? কথা বলেন।

ইচ্ছাটা জাগতেই কিছুটা বিরক্ত হয়। এসব কি ভাবছে। এমন ইচ্ছে কেন হবে! কিন্তু ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েই প্রথমে ওই ছেলেটাকে খোঁজে। ছেলেটাকে না দেখলে মন খারাপ হয়। অথচ কখনই ছেলেটার সাথে কথাই হয়নি। কি করে এটাই জানে না। ঢো্লা প্যান্ট পড়ে আর টিশার্ট। কেমন মানিয়ে যায় বোকা বোকা চেহারার ছেলেটির সাথে। চেহারায় কেমন একটা মায়া মায়া ভাব আছে!

ময়মনসিংহে গেলে এ ছেলের সাথে আর দেখা হবে না। ব্যাপারটা ভেবে বুকের একটা দিকে কেমন যেন ব্যথা হচ্ছে ওর। কিন্তু এমন হবে কেন! বুঝতে পারে না ও।
একদিনের কথা। সেদিনও ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ছিল আখি। ভাইটা আসে।
: আপু ব্যালকনিতে বেশিক্ষণ দাঁড়াইয়ো না।
: কেন ব্যালকনিতে দাঁড়ালে কি হয়?
: ওই দেখো নিচে ছেলেগুলো দাড়িয়ে আছে। ওরা তোমাকে ফলো করবে। তাই না দাঁড়ানোই ভালো। তোমার চেহারা তো টিভির নায়িকাদের মত। ওরা সবাই পছন্দ করলে তুমি বিপদে পড়ে যাবে।
এতটুকু ছেলে কত কথা বলে যে!

যা ভাগ বলে ওর দিকে তেড়ে যায় আখি। তার আগেই সেখান থেকে পালায় ও।
ভাইয়ের সাথে এমন দুষ্টামিগুলো আর করা হবে না সহজে।
শেষ পর্যন্ত সেদিনটি চলেই এলো। বাবা নিয়ে যাবে।

যে ভাইটি সব সময় ঝগড়া করতে ব্যস্ত থাকতো তার কথা কমে গেছে। সে তার খেলনাও পারলে বোনের ব্যাগে ভরে দেয়। বাথরুম থেকে টুথপেস্ট নিয়ে আসে ব্যাগে ভরে দেয়। দাঁত ব্রাশের সময় যে লাগবে। তার মুখ কেমন যেন করুণ হয়ে আছে।

সে বলল, আপু আমার একটা হেলিকপ্টার থাকলে ভালো হতো।
: হেলিকপ্টার দিয়ে কি হবে?
: হেলিকপ্টার দিয়ে তোমাকে তোমার ক্যাম্পাসে দিয়ে আসতাম। এরপর আমি ক্লাসে যেতাম। ক্লাস শেষে আবার তোমাকে নিয়ে আসতাম। তাহলে আর তোমাকে ওতদূর গিয়ে থাকতে হতো না। তাই না আপু।
ভাইকে জড়ায় ধরে আখি। ভাইটা আমার ছাড়া কিছু বলতে পারে না।

ফেসবুকে : হেলিকপ্টার