বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

বিধ্বস্ত স্বপ্ন

রাতগুলো এখন অনেক বেশি বড় মনে হয় তোহার। অথচ দুই মাস আগেও মনে হত রাতগুলো কি তাড়াতাড়িই না কেটে যায়। তোহা বরাবরই নিশিজাগা মানুষ। অর্ণার সাথে রাতে কথা বলতে বলতে রাতগুলো কেটে যেত। কি সুন্দর সুন্দর স্বপ্নের কথা।......



ওদের বাসার সামনে আম গাছ থাকবে। কাঁঠাল গাছ থাকবে। তালগাছও থাকতে হবে। তাল অর্ণার এক্কেবারে অপছন্দ। তারপরও চড়–ই পাখির বাসা দেখার জন্য তাল গাছের ব্যবস্থা। ঘরের সিঁড়িগুলোর দুপাশে শুধু ছোট ছোট গাছের টব লাগাবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় মনে হবে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
: আচ্ছা অর্ণা, সিঁড়িতে যে এত টব থাকবে হিবিজিবি লাগবে না?
: লাগুক হিবিজিবি। সমস্যা নেই। বন কি সাজানো গোছানো থাকে নাকি? তারপরও মানুষ এত বনে যেতে চায় কেন? প্রাকৃতিক টানে। গাছগুলোর পাশে গিয়ে আমি বিশুদ্ধ অক্সিজেন নেব।
অর্ণার স্বপ্নগুলো অন্য রকম। স্বপ্নগুলো শুনে তোহার ভাল লাগে। সেসময় ভাবে কি সুন্দর জীবনটাই না হবে ওদের।
হঠাৎ অর্ণা মোবাইলে বলে, তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন কেউ হলে ধরে বসত সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তোহা জানে অর্ণার গুরুত্বপূর্ণ কথা ঠিক সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ না। সে প্রায় সময়ই গুরুত্বপূর্ণ শব্দটা ব্যবহার করে। হয়ত কথা বলছে। মাঝখানে বলল, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। কিছুক্ষণ লাইনে থাকো।
তোহা কানে মোবাইল লাগিয়ে বসে থাকে। হঠাৎ থাপ্পরের শব্দ শোনা যায়। এরপর আর কোন শব্দ নেই। তোহা ভয় পেয়ে যায়। কাউকে মেরে বসল নাকি?
কিছুক্ষণ পর অর্ণার কথা শুনা যায়, কি ঘুমিয়ে পড়লা?
: না, না আছি। মারলা কাকে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে তোহা।
ভীষণ বিরক্ত করছিল। তাই মারলাম। পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে।
: আচ্ছা আমি যদি তোমাকে বিরক্ত করি তাহলে আমাকেও মারবা?
: মারবো মানে, একশো বার মারব। ওকেতো একহাতে মেরেছি। তোমাকে তো দুহাতে মারব।
তোহা কথাটা শুনে ঢোক গিলে। চুপ হয়ে যায়।
: আরে চুপ হয়ে গেলা যে। ভয় পেলে নাকি? আমার প্রিয় মানুষকে আমি মারবো এটা তুমি বিশ্বাস করলা? আর আমি আমার জীবনে এ পর্যন্ত কাউকে মারি নি। আর মারবোও না।
: তাহলে ঐযে থাপ্পর দিলা। বিরক্ত করছে দেখে মেরে বসেছো।
: আরে বোকা মশা মারতে গিয়ে আওয়াজ হয়েছে। পায়ে মশা বসেছিল। ঐটাকে মারলাম। মারার পর দেখি হাতে রক্ত ভরে গেছে। মশাটা অনেক রক্ত খেয়েছে। একটা জিনিষ আমার কাছে অদ্ভূত লাগে। এই যে মশারা রক্ত খায় ওরা তো বিভিন্নজনের শরীরে বসে। এখন মনে করো কোন মশা একটা ছেলের রক্ত খেলো। কিছুক্ষণ পর ঐ মশাটাই একটা মেয়ের রক্ত চুষল। দেখো ঐ ছেলে মেয়ের অজান্তেই তাদের রক্তের মিলন ঘটল এ ক্ষুদ্র প্রাণীতে। অথচ ওরা জানলই না।
: কি অদ্ভূত কথা বলছ!
: অদ্ভূতের দেখেছো কি? আগে একসাথে থাকা শুরু হোক তারপরে দেখবা অদ্ভূত জীবন কাকে বলে। এটা বলে হা ‍হা করে হাসে অর্ণা।
চোখের থেকে চশমাটা নামিয়ে রাখে তোহা। ও মাইনাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করে। মোবাইলে কথা বলার সময় যার সাথে কথা বলা হচ্ছে তাকে সামনাসামনি দেখা যায় না। মনের কল্পনায় ওর ধারণ ছবি থাকে। মনের কল্পনা দেখতে চশমা লাগে না।
চশমাটা ডেস্কের ভেতর রাখতে রাখতে তোহা বলে, তোমার পাগলামী আমার অনেক ভাল লাগে।
: ভাল লাগে মানে। লাগতেই হবে। তোমাকে অনেক পাগলামীর কথা বলি নি। জমা রাখছি। সেন্সর করে কিছু বলি আর কি। আমাদের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন ‍আমরা ছাদে কাটাবো। গল্প করবো। গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমরা পুকুরে একসাথে সাতার কাটবো। শীতের সময় বিয়ে হলেযে কি অবস্থা হবে।

তোহা হাসে। শব্দ করে হাসে। ওর এটা বড় সমস্যা। শব্দ করা ছাড়া হাসতে পারে না।
: হাসছো যে। আমি কি হাসির কথা বলেছি নাকি। এত সুন্দর রোমান্টিক কল্পনা করে বসে আছি আর তুমি মজা করছো। না? ঠিক আছে তোমার সাথে আর কোন কথা নেই।
লাইন কেটে দেয় অর্ণা।
তোহা মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখে। এখন অর্ণাকে কল করলেও লাভ নেই। ও ধরবে না। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মেসেজ দেবে। মেসেজে একটা বাক্য লেখা থাকবে। তোমার সাথে রাগ ভাঙলাম। মেসেজের শব্দ তিনটি পড়তে না পড়তেই কল আসবে। মোবাইল মনিটর দেখাবে অর্ণা কলিং।
অর্ণা রাগ করে থাকতে পারে না। অন্য মেয়েদের রাগ করলে তা ভাঙাতেই অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তোহার বন্ধু নিলয়ের সাথে ওর গার্ল ফ্রেন্ড কি কারণে যেন রাগ করেছো। নিলয় ঐ গার্লফ্রেন্ডের বাসার সামনে গিয়ে বসে থাকে। রাত ১২ বাজে ফোন দিয়ে বলে, দোস্ত ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিছু শুকনা খানা নিয়ে আয়তো। মোড়ের দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে।
তুই কোথায়?
রুবিদের বাসার সামনে।
রুবির রাগ এখনো ভাঙেনি?
আরে রাগ ভাঙবে কি! আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছি না। এই তিন দিন ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ‍ওর দেখা নেই। আল্লাহ মেয়েদের কে এত নিষ্ঠুর কেন বানালেন বলতে পারিস। মেয়ে জাতটাই চরম কঠিন জিনিষ।
তোহার ইচ্ছে করে অর্ণার কথা বলতে। যে রাগ করে থাকতে পারে না। কিন্তু বলে না। যদি মুখ পড়ে যায়। তাছাড়া শুনলে নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। অন্যের দীর্ঘশ্বাস শুনতে ভালো লাগে না।
তোহা গিয়ে দেখে নিলয় দাঁড়িয়ে আছে। রুবিদের বাসার বিপরীতে ব্রিজের উপর। যেখান থেকে ব্যালকনিটা দেখা যায়।
: আচ্ছা, নিলয় রুবি কি একবারও বের হয় নি।
: আরে বের হবে কি? ব্যালকনিতে পর্যন্ত আসছে না।
: আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে।
: অন্য কিছুটা কি?
ব্যগ্রভাবে জানতে চায় নিলয়। এ তিনদিনে ওর মুখ বেশ বদলে গেছে। চোখগুলো ভেতরে ঢুকে গেছে। চোখের মণি হয়েছে ঘন লাল বর্ণের।
: আমার মনে হয় কি ও ঘরের মধ্যেই নাই। যদি ঘরের মধ্যে থাকতো তাহলে একবার না একবার বের হতো।
: তুই কি বলস। আমারতো একথা একবারও মনে হয়নি। মোবাইল করেছি। প্রতিবার বন্ধ বলছে।
তোহা আর নিলয় দারোয়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দারোয়ান ব্যাটা টুলের উপর বসে ঘুমাচ্ছে। তোহা একটা একশো টাকার নোট দারোয়ানকে দিয়ে বলে, তোমার আপামনি আছে?
: হ্যা আছে। কিন্তু এতো রাতে তাঁর খোঁজ নেন ক্যান?
তোহা একটু হতাশ হয়। একটা মেয়ে এভাবে চুপচাপ ঘরে বন্দী থাকবে পুরা সপ্তাহ। ওর মাথায় ঢুকে না।
নিলয় নিজের মাথার চুল টানতে থাকে। কেন যে ঐ কথাটা রুবিকে বলতে গেল। কথাটা শুনার পর থেকেই ও রাগ করেছে।
: আচ্ছা তোমার আপামণি কয়জন?
: এতো তথ্য দিয়ে আপনে করবেন কি? আমি পারুম না।
তোহা আরেকটি একশো টাকার নোট দেয়।
এবার দারোয়ানের মুখ খুলে যায়। টাকাগুলো যেন চাবি। আপামণি দুজন। বড় আপুমণি ফেণী দেশের বাড়ী গেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে নিলয়ের নাম্বারে আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। কন্ঠ শুনে নিলয় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। রুবির গলা।

: তুমি আমাকে ঐ কথা বললা কেন? এজন্য রাগ করে দেশের বাড়ী চলে এসেছি। তবে কিছু ভাল লাগছে না। একটু আগে দারোয়ান জানালো দুজন লোক আমার খবর নিচ্ছে।
: দারোয়ান জানিয়ে দিল?
: হুম। আমি আসার সময় বলে আসছিলাম। আমার খোজে কেউ এলে আমাকে যেন জানিয়ে দেয়।
: কিন্তু তোমার মোবাইলতো বন্ধ।
: ঐ মোবাইলটা পুকুরে ফেলে দিয়েছি। এখানে আসার পর তোমার সাথে বার বার কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু কথা বললেতো রাগ কমে যাবে। তোমার নম্বারটা পর্যন্ত কোথাও টুকে রাখি নি। এখন সায়মাকে ফোন করে তোমার নাম্বার নিলাম। আমি সকালেই আসছি। যাও বাসায় গিয়ে ভালো করে ঘুমাও।
: তুমি জানো, এই কয়দিন আমি ঘুমায়নি? অভিমানের স্বরে বলে নিলয়।
: আমি ঘুমিয়েছি? উল্টা প্রশ্ন করে রুবি। আমাকে দেখলে তুমি চিনতেই পারবা না। যাও এখুনি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।
তোহাকে জড়িয়ে ধরে নিলয়। ইচ্ছে হয় তোহাকে নিয়ে নাচতে। কিন্তু শরীরে এনার্জি নেই।
: দোস্ত তুই অনেক লাকি। তুই আসছিস আর আমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।

তোহা বাসায় আসে। মোবাইল নিতে মনে ছিল না। সেখানে দেখে অর্ণার মিসকল ২০টি। তাড়াতাড়ি কলব্যাক করে।
: অর্ণা আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম।
: বুঝতে পারছি।
: আমার একটা..
: আমি কারণ জানতে চায়নি। তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ফোন করেছি। তুমি কি গাছে উঠতে পারো?
: কি গাছে?
: এই ধরো আমগাছ, কাঁঠাল গাছ।
: না পারি না। কেন?
: তাহলে তুমি বিয়ের আগেই তা শিখে নিবে। তোমার থেকে পরে আমি শিখব। আমরা দুজনে গাছের উঁচু ডালে বসে নিজ হাতে পেড়ে ফল খাবো।
: যদি পড়ে যাই?
: অলুক্ষণে কথা বলবা নাতো। এখন রাখি।
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্ণা রেখে দেয়।
তোহা টেনশনে পড়ে যায়। ড্রাইভিং শেখার, সাঁতার শেখার কোর্স আছে। কিন্তু গাছে চড়ার কোর্সের বিজ্ঞাপনতো চোখে পড়ে না। গাছে উঠার শিক্ষা কোথায় পাবে? এই মেয়েটার মাথায় এত অদ্ভত অদ্ভত চিন্তা কোথা থেকে আসে কে জানে? তবে ভাবতে অন্যরকম লাগে। দুজনে মিলে গাছের ডালে বসে কাঁচা আম পেড়ে খাচ্ছে। ব্যাপারটা সেরকম হবে। তবে গাছে উঠার পর একটা জিনিষ নিশ্চিত করতে হবে। গাছের সাথে নরম কিছু দিয়ে নিজেকে বেঁধে নিতে হবে। বলা যায় না পড়ে গেলে। এতে অর্ণা আপত্তি করতে পারে। ওর যে স্বভাব বলে বসবে, গাছ কি জেল খানা নাকি? এখানে নিজেকে বেঁধে রাখবো কেন?
তোহার ইচ্ছে করে এখনই গাছে উঠা শিখতে। কোথায় শিখা যায় এটাই মাথায় ঢুকছে না। সকাল বেলায় ওদের দারোয়ান আলতাফ মিয়াকে ডাক দেয়।
: আলতাফ মিয়া, তুমি কি গাছে উঠতে পারো?
: ক্যান স্যার? কিছু পারতে হইবো। এহনই কন। লইয়া আসি।
: আরে কিছু পারতে হবে না। তুমি আমাকে গাছে চড়া শিখাতে পারবা।
: এই কি কন? গাছে চড়া আপনে শিখতে যাবেন ক্যান? পড়ে গেলে হাড্ডি-হুড্ডি সব ভাইঙবো। আমি পারুম না শেখাতে। খালাম্মা জানলে আমার চাকরিটাই যাইবো।
তোহা বুঝতে পারে আলতাফ মিয়ার কাছ থেকে গাছে উঠা শেখা হবে না। ওদের বাসার পিছন দিকে কিছু গাছ আছে। রাতে ওদিকে কেউ যায় না। ঐখানেই শিখতে হবে। আজ থেকে একা একা শিখবে।
রাতে গাছের পাশে দাঁড়ায়। প্যান্টকে হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নেয়। দুই হাত দিয়ে গাছকে জড়িয়ে ধরে। দুই পা গাছের দুপাশে ছড়িয়ে দেয়। পরে হাটু ভাঙে। বেশ কয়েক বার চেষ্টার পর ৪ ফুটের মত উপরে উঠে যেতে পারে। কয়েকবার নামে। আবার উঠে। মোবাইলটা সাথে থাকলে ভাল হতো। গাছে উঠা প্রায় শেখা হয়ে গেছে এ কথাটা অর্ণাকে বলা যেত। না থাক এখন কিছু বলবে না। বিয়ের পর গাছে উঠতে পারছে দেখলে অর্ণা অবাক হয়ে যাবে। তাই তোহা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে গাছে উঠতে পারার ব্যাপারটা গোপন রাখবে।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি পড়ছে। গাছ পিছলা হয়ে গেছে। তোহা গাছে উঠার প্রাকটিস করার চেষ্টা করতে যায়। কিন্তু সাহস হয় না। যেভাবে গাছের গাঁ বেয়ে পানি পড়ছে এখন উঠার চেষ্টা করলে নির্ঘাত পিছলিয়ে নিচে পড়ে যাবে। অনিচ্ছাস্বত্বেও ফিরে আসে।
অর্ণাকে কল দেয়।
: কি করো?
: বৃষ্টিতে ভিজি।
: তোমার না ঠান্ডা লাগছে।গলা বসে যা্ওয়ায় কাল কথাই বলতে পারোনি।আজকে আবার ভিজছো ঠান্ডা বেড়ে যাবে তো।
: বাড়বে না, বাড়বে না। সে ব্যবস্থা নিয়েইতো বৃষ্টিতে ভিজছি। তুমি আমাকে বোকা মনে করো কেন?
: কি ব্যবস্থা নিলে?
: রেইন কোট পড়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। নতুন থ্রি-পিস একটা রেইন কোট বানিয়েছি। সেটা পড়লে পায়ের পাতা ব্যতীত শরীরের কোন অংশে পানি পড়ে না।
: রেইন কোট পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কি মজা পাও?
: বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো রেইনকোটের উপর পড়ে। একটা মৃদু আওয়াজের সৃষ্টি করে। তখন তা শুনতে এত্ত ভাল লাগে। অতি ছন্দময় আওয়াজ। কবিরা টিনের চালে টুপ-টাপ বৃষ্টি নিয়ে অনেক লেখা লিখেছে। কিন্তু কোন কবি রেইনকোটের বৃষ্টি পড়ার শব্দ নিয়ে লিখেনি।
: তুমি লিখে ফেলো।
: আমার লিখার কোন ইচ্ছে নেই। তবে আমি ভাবতাম আমার বন্ধু এমন একজন হবে যাকে আমার অনুভূতিগুলো জানালেই সে ঐগুলো যতœ করে লিখে ফেলবে। কবিতা বানাবে। কিন্তু ভাগ্য মন্দ। পেলাম তোমার মত বোকা বন্ধু। যে কিছুই বানিয়ে লিখতে পারে না। আমি এত পাগলামি করি। অদ্ভূত অদ্ভূত স্বপ্ন দেখি। অথচ তার এই ধরণের কোন স্বপ্নই নেই।
তোহার খারাপ লাগে। আসলেইতো সে কিছুই লিখতে পারে না। কতজন ডায়েরী লিখে। সেতো ডায়েরী পর্যন্ত লিখে না। তোহা করুণ গলায় বলে, আসলে আমি তোমার মনের মত হতে পারিনি।
: এই দেখো তুমি মন খারাপ করলে কেন? ঐ কবিরা কি তোমার মত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে পারে? তুমি সব জায়গায় প্রথম হও। ঐ কবিরা অন্য কিছু পারে না বিধায় কবিতা লিখে। আর আমরা যখন একসাথে থাকবো কি করবো জানো? মানুষতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে। আমরা শুয়ে থেকে বৃষ্টিতে ভিজব। আমার খুব ইচ্ছে করে শুইয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু ভিজি না। এটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম। তোমার সাথেই প্রথম শুইয়ে শুইয়ে বৃষ্টিতে ভিজব।

তৃতীয় দিন বৃষ্টি হয় নি। তোহা চুপে চুপে ঐ গাছটার নিচে দাঁড়ায়। আজ গাছটাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। পাতায় কোন ধূলাবালি নেই। বৃষ্টির পানিতে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। পাতাগুলো সবুজ থেকে সবুজতর হয়েছে। বেশ কয়েকবার গাছে উঠার সফল পরীক্ষা চালায়। এরই মধ্যে দুই ঘন্টা পার হয়। এবার শেষ বার মনে করে আগের চেয়ে আরো বেশি উঠতে চায়। হঠাৎ করে গাছের গায়ে থাকা একটা লাল পিপড়ে কামড় দেয়। যেখানে কামড় দেয় সেখানে জ্বলা শুরু করে। অসম্ভব জ্বলা। ঐখানে হাত রাখতে গিয়ে গাছ ফসকে পড়ে যায়। আওয়াজ হয় দুড়–ম করে। ৬৫ কেজির কিছু উপর থেকে মাটিতে পড়লে যেরকম আওয়াজ ঠিক সেরকম। দারোয়ান ছুটে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ছুটে আসে। তোহা সেন্স হারিয়েছে। ওর মা কান্না শুরু করে দেয়। আম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডাক্তার তোহার মা-কে স্বান্তনা দেন, প্লিজ কাঁদবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।
মুখে স্বান্তনা দিলেও ডাক্তারের মনে অন্য কথা। কেননা রোগীর যে অবস্থা বিশেষ করে কোমরের বাম পাশটা বেশি ক্ষতি হয়েছি। পা ভাঙছে। সেটা ঠিক হবে। কিন্তু কোমরের বাম পাশটা ঠিক হবে কিনা সন্দেহ। হয়ত আর কখনা একা একা হাঁটতে পারবে না।
এ ঘটনার পর থেকে অর্ণার সাথে কথা বলা কমে যায়। দুইদিন তো সেন্সই ছিল না। কিছুদিন পর শুনতে পায় অর্ণার বিয়ে হয়েছে আমেরিকা প্রবাসী একজনের সাথে। সে সেখানে চলে গিয়েছে।
তোহা এখন ঘরে এক প্রকার বন্দী। ভালো লাগে না বেরোতে। প্রতিদিন বন্ধুরা এসে ওকে সঙ্গ দেয়। নিলয় এসে সারাক্ষণ বসে থাকে। স্বান্তনা দেয়। ওর বান্ধবী রুবিও বেশ কয়েকবার এসেছে। ওর অবস্থা দেখে প্রথমদিনতো কেঁদেই দিয়েছে।
যে তোহার বেশির ভাগ সময়ই কাটত বাইরে হেঁটে হেঁটে। সে তোহা যে আর হাঁটতে পারবে না। বন্ধুরা সবাই হাঁটবে অথচ ও পাশে থাকবে না। নিরন্তর ভাবে ঘরে থাকতে হবে। অর্ণার দেখানো স্বপ্নগুলো কখনো পূরণ হবে না। কোন স্বপ্নবিলাসী মেয়ে চাইবে ওর মত ল্যাংড়ার সাথে থেকে স্বপ্ন পূরণ করতে?
ঘরের কেউ জানে না ও গাছের নিচে কেন গিয়েছিল। একটা স্বপ্ন পূরণের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে জীবনের সকল স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটল।
তোহা এখন আর মোবাইল ব্যবহার করে না। অর্ণার সাথে এ মোবাইলেই পরিচয়। হাজারো স্বপ্ন দেখা। জীবনকে আর বিধ্বস্ত করতে চায় না ও মোবাইল ব্যবহার করে।
তোহা ঘুমুচ্ছে। ওর মাঝে মাঝে মনে হয় এ ঘুমটা যদি আর না ভাঙত তাহলে অনেক ভাল হতো। ঘুম থেকে উঠে মা-বাবার করুণ মুখটা দেখতে ওর আর ভালো লাগে না।