সাবিহা শুয়ে আছে। আগামীকাল সকালে তার ইউনিভার্সিটিতে
ক্লাস আছে। ভোরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। এখন তার ঘুমানো উচিত। কিন্তু সে
ঘুমাচ্ছে না। অন্য সময় ঘুম না হলে বিছানার পাশে থাকা বুক সেলফ থেকে বই নিয়ে
পড়ে। আজ সেখান থেকেও কোন বই নিচ্ছে না।
পাশের রুম থেকে গানের শব্দ আসছে। ওই রুমটি সাবিহার ভাই পলকের। ও গান শুনছে। ইদানিং পলক প্রেমে পড়েছে। ওর আচরণেই বোঝা যায়। যদিও স্বীকার করছে না। গত সপ্তাহে দেখে আয়না সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আছে। মুখে ব্রণ উঠেছে দুইটা। সেগুলোতে ধরে ধরে দেখছে।
: পলক, এত সেজেগুজে কই যাও?
: আপু, এটা কি ধরণের কথা! আমি মেয়ে নাকি যে সেজে গুজে যাবো? তোমরা মেয়েরা না সেজে গুজে যাও। সাজতে তোমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা লাগে। কাউকে আসতে বলে দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখো।
: কে তোমাকে দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখল? আহারে আমার ভাইটা!
প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত হয় পলক। এভাবে প্রশ্ন ছুটে আসবে সে বুঝতে পারে নাই।
নিজের মোবাইলটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, আরে আমাকে কে এতক্ষণ অপেক্ষায় রাখবে? তোমরা মেয়েরা কর আমি এটাই বললাম। তুমি একটু বেশি বোঝো। এটা মেয়েদের আরেকটা সমস্যা। একটা বললে আরেকটা বুঝে।
: ইদানিং মেয়েদের নিয়ে তাহলে খুব বেশি গবেষণা হচ্ছে? আম্মুকে বলবো নাকি ব্যাপারটা।
: এইতো দেখছো। তোমাকে বন্ধু মনে করে একটা বিষয় বললাম। এখন তুমি হুমকি দিচ্ছো আম্মুকে বলে দেবে। ঠিক আছে তোমাকে আর কিছু বলবো না।
: আরে আমার ভাইটা দেখি রাগ করেছে। ঠিক আছে আম্মুকে কিছু বলছি না। তবে যাই-করো আব্বু আম্মুর মান সম্মান কথাটা মনে রেখো। উল্টা পাল্টা অভিযোগ যেন বাসায় না আসে।
সাবিহার এখন বিরক্ত লাগছে। সে পলককে ডাক দেয়। পলক, ভলিউম কমাও। আমার সমস্যা হচ্ছে।
বিরক্তি ব্যাপারটা ভয়ানক! এটা একবার ধরলে সবকিছুকে বিরক্তিকর মনে হয়। ইংরেজি যে গানটা চলছিল সেটা প্রিয় গানগুলোর একটি। অথচ ওই গানটাকেই বড় বেশি বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো।
সে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। ব্যাপারটা নিজের কাছে পুরাই ছেলেমানুষী মনে হচ্ছে। আবীরকে গত রাতে বলেছে একটা গল্প লিখতে। বেশ অনুরোধ করে বলেছে। কিন্তু আবীর লিখে নি।
সাবিহা ওর নিজের জেদকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আবীর যতক্ষণ পর্যন্ত গল্প লিখবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ও ঘুমাতে যাবে না। আর লেখার জন্য আবীরকে নকও করবে না আর।
একটা সময় আবীর দারুণ সব গল্প লিখত। মধ্যখানে একটা মেয়ের সাথে ওর পরিচয় হয়। ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই কেমন জানি হয়ে যায় সে। আর লিখে না গল্প। ব্যাপারটা একদিন সাবিহার সাথে শেয়ার করে। এখন চ্যাট করেই তার দিন কাটে। লেখালেখিতে নেই। অথচ এক সময় কি সুন্দর সুন্দর সব লেখা বের হতো।
: আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আপনি আর লিখবেন না?
: এখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার কি আছে? এক সময় ভালো লাগত তাই লিখতাম। এখন ভালো লাগে না তাই লিখি না।
: এটা কোন যুক্তিপূর্ণ কথা না।
: তাতো জানি। আমি কোন যুক্তিপূর্ণ কারণে লিখতাম না।
: কিন্তু আপনার লেখার হাত তো অনেক ভালো।
: জ্বী। পৃথিবীতে একটা জিনিস সবচেয়ে সস্তা। আলকাতরার চেয়েও সস্তা। তা হচ্ছে প্রশংসা। সেকেন্ডে সেকেন্ডে করা যায়।
: আপনার কথার সাথে আমি পুরাটা একমত না। যারা খুব বেশি জায়গায় প্রশংসা করে, যেখানে সেখানে প্রশংসা করে তাদের প্রশংসা হয়ত খুব সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু আমি খুব কম ক্ষেত্রেই প্রশংসা করি।
: জ্বী! প্রশংসা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর কোন প্রশংসা করবেন? করলে বলেন। আবার ধন্যবাদ দিয়ে দেবো। ঠিক আছে?
প্রথম দিকে এভাবে কথা হতো। বাঁকা বাঁকা উত্তর দিতো আবীর। এ ছেলেটাকে স্বাভাবিক করতে হবে এমন একটা ইচ্ছে কেন জানি সাবিহার মাথায় ঢুকে। কিছুদিন কথা বলার পর এখন ঠিক ভাবেই কথা বলে।
গল্প লিখতে বললে লিখবে বলেও কথা দেয়। কিন্তু কখনও লিখে না। বার বার এ অবস্থা দেখে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে সাবিহা।
: আপনি কি সত্যিই গল্প লিখবেন না?
: লিখবো তো।
: আজই লিখবেন। আজ রাতের মধ্যে আপনার লেখা গল্প চাই।
: হুম। চেষ্টা করবো।
: সত্যিতো? এর আগেও কিন্তু বলেছিলেন লিখবেন। কিন্তু লিখেন নি। আজ লিখবেন তো?
উত্তরে হাসির ইমো পাঠায় আবীর।
: আমি কোন হাসির কথা বলিনি। আমি আপনার লেখা গল্প চাই।
: আচ্ছা।
: মনে থাকবে তো?
: থাকবে।
: মাথা ছুয়ে বলেন।
: আমার সামনে তো কিবোর্ড আর মনিটর। তোমার মাথা ছুবো কেমনে?
: কল্পনায় ছুয়ে বলেন।
: কল্পনার নাম হচ্ছে অবাস্তবতা। যেটা অবাস্তব সেটার সত্যটা নেই। তাই না? লেখালেখি তো আর কল্পনায় সম্ভব না। নাকি কল্পনায় লিখলেই হবে?
: আচ্ছা মাথা ছুতে হবে না। আপনি লিখলেই হবে। আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি।
অপেক্ষার প্রহর বাড়ে। পুরা রাত ঘুমায়নি সাবিহা। ভেবেছে গল্পটা পাবে। না গল্প আসেনি। হয়ত ঘুমিয়ে পড়ছিল তাই লিখতে পারি নি। সকাল অথবা দুপুরে লিখবে। তখনও লিখে নি।
এখন রাত একটা বাজছে। গল্প আসে নি। চোখ জ্বালাপোড়া করছে সাবিহার। আবীর যে সত্যি সত্যি গল্পই লিখছে না। হয়ত গল্প লেখার তার অনুরোধটাই ভুলে বসে আছে। ছেলেরা এমন হয় কেন? একটা মানুষ এত করে যখন চাচ্ছে তাহলে তা করতে সমস্যা কি? এমনতো না এটা অনেক কঠিন কিছু। দ্বিতীয় রাতটাও নির্ঘুম কাটে সাবিহার।
নিজেকে অত্যন্ত বোকা মনে হয় ওর। কি করা যায়? নিজের জেদ আগে কখনও ভাঙ্গেনি। এটাও ভাঙ্গার প্রশ্ন আসে না। যা হওয়ার তাই হবে। ঘুমাবে না।
তৃতীয় দিন সকালে আবীরকে ব্লক করে দেয়।
ব্লক করার দেড় ঘন্টা পর ফোন আসে আবীরের।
: তুমি কি একাউন্ট ডিএকটিভ করে দিয়েছো?
দীর্ঘ সময় না ঘুমিয়ে বেশ ক্লান্ত সাবিহা। তারপরও গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে, নাতো।
: তাহলে আমি দেখছি না যে।
: এটা আমি কিভাবে বলবো?
: তাহলে নিশ্চয় ব্লক দিয়েছো।
সাবিহা মনে মনে খুশী হয়। আবীর বুঝতে পেরেছে ব্লক দেয়ার ব্যাপারটি। বর্তমানে ফেসবুকে সবার শত শত ফ্রেন্ড। একজনের সাথে চ্যাট না হলে আরেকজনের সাথে হচ্ছে। কেউ খালি নেই। এখানে নির্দিষ্ট কাউকে মিস করা ব্যাপারটা কঠিন।
সাবিহার চুপ থাকা দেখে আবীরই আবার বলে, তুমি আমাকে একটা অনুরোধ করেছিলে।
: তো?
: আমি অনুরোধটা না রাখায় তুমি রাগ করে আমাকে ব্লক দিয়েছো তাই না?
: না। ভুল বুঝছেন। একটা পরীক্ষা চালালাম। আসলে ব্লক অপশনটা কাজ করে নাকি তাই দেখছিলাম। দেখি কাজ করেছে। আপনার ফোন পেয়ে নিশ্চিত হলাম। নিশ্চিত করার জন্য ধন্যবাদ।
: এটা কেমন কথা। ব্লক অপশন কাজ করবে না কেন?
: আমার পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হলো। আমি পরীক্ষা করছি। গাড়ী চালানোর আগে দেখেন না ড্রাইভাররা ব্রেক ঠিক আছে জানার পরও ব্রেক কষে পরীক্ষা করে দেখে। আমিও ওই ধরণের পরীক্ষা করছি। আপনার কথা শেষ হয়েছে?
: রেখে দিবো?
: জ্বী। আমি এখন ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে বাহির হচ্ছি।
: একটা মিনিট।
: তাড়াতাড়ি বলেন।
: আমি চাই অনেক দিন পর লেখা আমার গল্পটি নিজে পড়ে শোনাতে। তোমার সময় হবে কখন?
: এখন তো সময় দিতে পারছি না। যখন ফ্রি হবো জানাবো।
: আচ্ছা।
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে অসম্ভব খারাপ লাগে সাবিহার। ও খেয়াল করে পলকের রুম থেকে গান ভেসে আসছে। তবে সাউন্ড কম।
কিরে পলক! এত আস্তে কেন গান শুনছিস? ভলিয়ম বাড়িয়ে দেয়। আমরাও শুনি।
পলক বোনের কথা শুনে আশ্চর্য হয়। সেদিন ভলিয়ম বেশি দেয়ায় বকা দিল। আর আজকে আবার বলছে ভলিয়ম বাড়িয়ে দিতে। হচ্ছেটা কি?
“আমি আসলে মিথ্যা বলেছি। এখন ফোন দিয়ে আমাকে গল্প শোনান। আর গল্পটা লিখেছেন এটা বললেই হতো। আমার ব্লক নিয়ে পরীক্ষা চালাতে হতো না। পরীক্ষাটা কত কষ্টের জানেন?
বি.দ্র : শেষের বাক্যটা কিন্তু পড়বেন না। ঠিক আছে?”
এটা লিখে আবীরের মোবাইলে মেসেজ পাঠায় সাবিহা।
০২.....
এর পর থেকে আবারও গল্প লেখা শুরু আবীর। প্রতি সপ্তাহে গল্প লিখে। সাবিহাকে নিজে পড়ে শোনায়। গল্প শেষ হলে ওরা নিজেরা গল্প করে।
: হুমায়ুন আহমেদ কি করতেন জানো?
: কি করতেন?
: গল্প লিখছেন। ধরো তার লেখা শেষ হলো রাত তিনটায়। তার স্ত্রী আরামে ঘুমাচ্ছেন। তিনি গিয়ে স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে তার গল্প শোনাতেন। যতক্ষণ না শোনাতে পারতেন তার শান্তি লাগত না। স্ত্রী ঘুম ঘুম চোখে তা শুনতো।
: এটা বলে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন? আপনিও মধ্যরাতে আমাকে গল্প শোনাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবেন?
: দিলে কি খুব রাগ করবে?
: হা অবশ্যই করবো। অনেক অনেক রাগ। এত রাগ যে রাগের চোটে গরম পানি খাওয়াবো।
: আচ্ছা শোনাবো না। সকালে যখন ঘুম ভাঙবে তখন না হয় শোনাবো।
: আরে বোকা! গরম পানি কি এম্নে এম্নে খাওয়াবো? চা পাতা থাকবে। দুধ চিনি থাকবে। তুমি না অনেক চা পছন্দ করো।
: আগে বলবে তো। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
: ভীতু মানুষ ভয় পাবে এটাই তো স্বাভাবিক।
০৩.
দুই জন এক রুমে। আবীরদের বাসায়। অতিথিরা অনেকে চলে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে আত্মীয় যারা গ্রাম থেকে এসেছেন তারা আছেন।
এখন রুমে শুধু তারা দুইজন। রাত সোয়া একটা বাজছে।
: তোমার একটা চরম শাস্তি আছে।
সাবিহার কথায় কিছুটা অবাক হয় আবীর। আমতা আমতা করে বলে, আমি আবার কি করেছি?
: কি করো নাই মানে? পাক্কা আড়াই দিন আমাকে ঘুমাতে দাও নি।
: কখন! কিভাবে?
: সেটাতো বলবো না। তোমার শাস্তি তুমি দুইদিন ঘুমাতে পারবে না।
লাজুক স্বরে আবীর বলে, আমি রাজি।
এবার উল্টা অবাক হয় সাবিহা। : রাজি মানে?
: তুমিতো ঘুমাবে তাই না?
: শাস্তি তো আপনার। আমার না। আমি ঘুমাবোই।
: তাহলেই তো হয়ে গেলো।
: মানে?
: এমন একটা সুন্দর মুখ পাশে ঘুমাচ্ছে। তা দেখে রাত পার করিয়ে দেয়া কোন ব্যাপার হলো!
ফেসবুকে : গল্প- ঘুম
পাশের রুম থেকে গানের শব্দ আসছে। ওই রুমটি সাবিহার ভাই পলকের। ও গান শুনছে। ইদানিং পলক প্রেমে পড়েছে। ওর আচরণেই বোঝা যায়। যদিও স্বীকার করছে না। গত সপ্তাহে দেখে আয়না সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আছে। মুখে ব্রণ উঠেছে দুইটা। সেগুলোতে ধরে ধরে দেখছে।
: পলক, এত সেজেগুজে কই যাও?
: আপু, এটা কি ধরণের কথা! আমি মেয়ে নাকি যে সেজে গুজে যাবো? তোমরা মেয়েরা না সেজে গুজে যাও। সাজতে তোমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা লাগে। কাউকে আসতে বলে দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখো।
: কে তোমাকে দেড় ঘন্টা বসিয়ে রাখল? আহারে আমার ভাইটা!
প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত হয় পলক। এভাবে প্রশ্ন ছুটে আসবে সে বুঝতে পারে নাই।
নিজের মোবাইলটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, আরে আমাকে কে এতক্ষণ অপেক্ষায় রাখবে? তোমরা মেয়েরা কর আমি এটাই বললাম। তুমি একটু বেশি বোঝো। এটা মেয়েদের আরেকটা সমস্যা। একটা বললে আরেকটা বুঝে।
: ইদানিং মেয়েদের নিয়ে তাহলে খুব বেশি গবেষণা হচ্ছে? আম্মুকে বলবো নাকি ব্যাপারটা।
: এইতো দেখছো। তোমাকে বন্ধু মনে করে একটা বিষয় বললাম। এখন তুমি হুমকি দিচ্ছো আম্মুকে বলে দেবে। ঠিক আছে তোমাকে আর কিছু বলবো না।
: আরে আমার ভাইটা দেখি রাগ করেছে। ঠিক আছে আম্মুকে কিছু বলছি না। তবে যাই-করো আব্বু আম্মুর মান সম্মান কথাটা মনে রেখো। উল্টা পাল্টা অভিযোগ যেন বাসায় না আসে।
সাবিহার এখন বিরক্ত লাগছে। সে পলককে ডাক দেয়। পলক, ভলিউম কমাও। আমার সমস্যা হচ্ছে।
বিরক্তি ব্যাপারটা ভয়ানক! এটা একবার ধরলে সবকিছুকে বিরক্তিকর মনে হয়। ইংরেজি যে গানটা চলছিল সেটা প্রিয় গানগুলোর একটি। অথচ ওই গানটাকেই বড় বেশি বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো।
সে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। ব্যাপারটা নিজের কাছে পুরাই ছেলেমানুষী মনে হচ্ছে। আবীরকে গত রাতে বলেছে একটা গল্প লিখতে। বেশ অনুরোধ করে বলেছে। কিন্তু আবীর লিখে নি।
সাবিহা ওর নিজের জেদকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আবীর যতক্ষণ পর্যন্ত গল্প লিখবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ও ঘুমাতে যাবে না। আর লেখার জন্য আবীরকে নকও করবে না আর।
একটা সময় আবীর দারুণ সব গল্প লিখত। মধ্যখানে একটা মেয়ের সাথে ওর পরিচয় হয়। ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই কেমন জানি হয়ে যায় সে। আর লিখে না গল্প। ব্যাপারটা একদিন সাবিহার সাথে শেয়ার করে। এখন চ্যাট করেই তার দিন কাটে। লেখালেখিতে নেই। অথচ এক সময় কি সুন্দর সুন্দর সব লেখা বের হতো।
: আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আপনি আর লিখবেন না?
: এখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার কি আছে? এক সময় ভালো লাগত তাই লিখতাম। এখন ভালো লাগে না তাই লিখি না।
: এটা কোন যুক্তিপূর্ণ কথা না।
: তাতো জানি। আমি কোন যুক্তিপূর্ণ কারণে লিখতাম না।
: কিন্তু আপনার লেখার হাত তো অনেক ভালো।
: জ্বী। পৃথিবীতে একটা জিনিস সবচেয়ে সস্তা। আলকাতরার চেয়েও সস্তা। তা হচ্ছে প্রশংসা। সেকেন্ডে সেকেন্ডে করা যায়।
: আপনার কথার সাথে আমি পুরাটা একমত না। যারা খুব বেশি জায়গায় প্রশংসা করে, যেখানে সেখানে প্রশংসা করে তাদের প্রশংসা হয়ত খুব সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু আমি খুব কম ক্ষেত্রেই প্রশংসা করি।
: জ্বী! প্রশংসা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর কোন প্রশংসা করবেন? করলে বলেন। আবার ধন্যবাদ দিয়ে দেবো। ঠিক আছে?
প্রথম দিকে এভাবে কথা হতো। বাঁকা বাঁকা উত্তর দিতো আবীর। এ ছেলেটাকে স্বাভাবিক করতে হবে এমন একটা ইচ্ছে কেন জানি সাবিহার মাথায় ঢুকে। কিছুদিন কথা বলার পর এখন ঠিক ভাবেই কথা বলে।
গল্প লিখতে বললে লিখবে বলেও কথা দেয়। কিন্তু কখনও লিখে না। বার বার এ অবস্থা দেখে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে সাবিহা।
: আপনি কি সত্যিই গল্প লিখবেন না?
: লিখবো তো।
: আজই লিখবেন। আজ রাতের মধ্যে আপনার লেখা গল্প চাই।
: হুম। চেষ্টা করবো।
: সত্যিতো? এর আগেও কিন্তু বলেছিলেন লিখবেন। কিন্তু লিখেন নি। আজ লিখবেন তো?
উত্তরে হাসির ইমো পাঠায় আবীর।
: আমি কোন হাসির কথা বলিনি। আমি আপনার লেখা গল্প চাই।
: আচ্ছা।
: মনে থাকবে তো?
: থাকবে।
: মাথা ছুয়ে বলেন।
: আমার সামনে তো কিবোর্ড আর মনিটর। তোমার মাথা ছুবো কেমনে?
: কল্পনায় ছুয়ে বলেন।
: কল্পনার নাম হচ্ছে অবাস্তবতা। যেটা অবাস্তব সেটার সত্যটা নেই। তাই না? লেখালেখি তো আর কল্পনায় সম্ভব না। নাকি কল্পনায় লিখলেই হবে?
: আচ্ছা মাথা ছুতে হবে না। আপনি লিখলেই হবে। আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি।
অপেক্ষার প্রহর বাড়ে। পুরা রাত ঘুমায়নি সাবিহা। ভেবেছে গল্পটা পাবে। না গল্প আসেনি। হয়ত ঘুমিয়ে পড়ছিল তাই লিখতে পারি নি। সকাল অথবা দুপুরে লিখবে। তখনও লিখে নি।
এখন রাত একটা বাজছে। গল্প আসে নি। চোখ জ্বালাপোড়া করছে সাবিহার। আবীর যে সত্যি সত্যি গল্পই লিখছে না। হয়ত গল্প লেখার তার অনুরোধটাই ভুলে বসে আছে। ছেলেরা এমন হয় কেন? একটা মানুষ এত করে যখন চাচ্ছে তাহলে তা করতে সমস্যা কি? এমনতো না এটা অনেক কঠিন কিছু। দ্বিতীয় রাতটাও নির্ঘুম কাটে সাবিহার।
নিজেকে অত্যন্ত বোকা মনে হয় ওর। কি করা যায়? নিজের জেদ আগে কখনও ভাঙ্গেনি। এটাও ভাঙ্গার প্রশ্ন আসে না। যা হওয়ার তাই হবে। ঘুমাবে না।
তৃতীয় দিন সকালে আবীরকে ব্লক করে দেয়।
ব্লক করার দেড় ঘন্টা পর ফোন আসে আবীরের।
: তুমি কি একাউন্ট ডিএকটিভ করে দিয়েছো?
দীর্ঘ সময় না ঘুমিয়ে বেশ ক্লান্ত সাবিহা। তারপরও গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে, নাতো।
: তাহলে আমি দেখছি না যে।
: এটা আমি কিভাবে বলবো?
: তাহলে নিশ্চয় ব্লক দিয়েছো।
সাবিহা মনে মনে খুশী হয়। আবীর বুঝতে পেরেছে ব্লক দেয়ার ব্যাপারটি। বর্তমানে ফেসবুকে সবার শত শত ফ্রেন্ড। একজনের সাথে চ্যাট না হলে আরেকজনের সাথে হচ্ছে। কেউ খালি নেই। এখানে নির্দিষ্ট কাউকে মিস করা ব্যাপারটা কঠিন।
সাবিহার চুপ থাকা দেখে আবীরই আবার বলে, তুমি আমাকে একটা অনুরোধ করেছিলে।
: তো?
: আমি অনুরোধটা না রাখায় তুমি রাগ করে আমাকে ব্লক দিয়েছো তাই না?
: না। ভুল বুঝছেন। একটা পরীক্ষা চালালাম। আসলে ব্লক অপশনটা কাজ করে নাকি তাই দেখছিলাম। দেখি কাজ করেছে। আপনার ফোন পেয়ে নিশ্চিত হলাম। নিশ্চিত করার জন্য ধন্যবাদ।
: এটা কেমন কথা। ব্লক অপশন কাজ করবে না কেন?
: আমার পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হলো। আমি পরীক্ষা করছি। গাড়ী চালানোর আগে দেখেন না ড্রাইভাররা ব্রেক ঠিক আছে জানার পরও ব্রেক কষে পরীক্ষা করে দেখে। আমিও ওই ধরণের পরীক্ষা করছি। আপনার কথা শেষ হয়েছে?
: রেখে দিবো?
: জ্বী। আমি এখন ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে বাহির হচ্ছি।
: একটা মিনিট।
: তাড়াতাড়ি বলেন।
: আমি চাই অনেক দিন পর লেখা আমার গল্পটি নিজে পড়ে শোনাতে। তোমার সময় হবে কখন?
: এখন তো সময় দিতে পারছি না। যখন ফ্রি হবো জানাবো।
: আচ্ছা।
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে অসম্ভব খারাপ লাগে সাবিহার। ও খেয়াল করে পলকের রুম থেকে গান ভেসে আসছে। তবে সাউন্ড কম।
কিরে পলক! এত আস্তে কেন গান শুনছিস? ভলিয়ম বাড়িয়ে দেয়। আমরাও শুনি।
পলক বোনের কথা শুনে আশ্চর্য হয়। সেদিন ভলিয়ম বেশি দেয়ায় বকা দিল। আর আজকে আবার বলছে ভলিয়ম বাড়িয়ে দিতে। হচ্ছেটা কি?
“আমি আসলে মিথ্যা বলেছি। এখন ফোন দিয়ে আমাকে গল্প শোনান। আর গল্পটা লিখেছেন এটা বললেই হতো। আমার ব্লক নিয়ে পরীক্ষা চালাতে হতো না। পরীক্ষাটা কত কষ্টের জানেন?
বি.দ্র : শেষের বাক্যটা কিন্তু পড়বেন না। ঠিক আছে?”
এটা লিখে আবীরের মোবাইলে মেসেজ পাঠায় সাবিহা।
০২.....
এর পর থেকে আবারও গল্প লেখা শুরু আবীর। প্রতি সপ্তাহে গল্প লিখে। সাবিহাকে নিজে পড়ে শোনায়। গল্প শেষ হলে ওরা নিজেরা গল্প করে।
: হুমায়ুন আহমেদ কি করতেন জানো?
: কি করতেন?
: গল্প লিখছেন। ধরো তার লেখা শেষ হলো রাত তিনটায়। তার স্ত্রী আরামে ঘুমাচ্ছেন। তিনি গিয়ে স্ত্রীর ঘুম ভেঙ্গে তার গল্প শোনাতেন। যতক্ষণ না শোনাতে পারতেন তার শান্তি লাগত না। স্ত্রী ঘুম ঘুম চোখে তা শুনতো।
: এটা বলে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন? আপনিও মধ্যরাতে আমাকে গল্প শোনাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবেন?
: দিলে কি খুব রাগ করবে?
: হা অবশ্যই করবো। অনেক অনেক রাগ। এত রাগ যে রাগের চোটে গরম পানি খাওয়াবো।
: আচ্ছা শোনাবো না। সকালে যখন ঘুম ভাঙবে তখন না হয় শোনাবো।
: আরে বোকা! গরম পানি কি এম্নে এম্নে খাওয়াবো? চা পাতা থাকবে। দুধ চিনি থাকবে। তুমি না অনেক চা পছন্দ করো।
: আগে বলবে তো। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
: ভীতু মানুষ ভয় পাবে এটাই তো স্বাভাবিক।
০৩.
দুই জন এক রুমে। আবীরদের বাসায়। অতিথিরা অনেকে চলে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে আত্মীয় যারা গ্রাম থেকে এসেছেন তারা আছেন।
এখন রুমে শুধু তারা দুইজন। রাত সোয়া একটা বাজছে।
: তোমার একটা চরম শাস্তি আছে।
সাবিহার কথায় কিছুটা অবাক হয় আবীর। আমতা আমতা করে বলে, আমি আবার কি করেছি?
: কি করো নাই মানে? পাক্কা আড়াই দিন আমাকে ঘুমাতে দাও নি।
: কখন! কিভাবে?
: সেটাতো বলবো না। তোমার শাস্তি তুমি দুইদিন ঘুমাতে পারবে না।
লাজুক স্বরে আবীর বলে, আমি রাজি।
এবার উল্টা অবাক হয় সাবিহা। : রাজি মানে?
: তুমিতো ঘুমাবে তাই না?
: শাস্তি তো আপনার। আমার না। আমি ঘুমাবোই।
: তাহলেই তো হয়ে গেলো।
: মানে?
: এমন একটা সুন্দর মুখ পাশে ঘুমাচ্ছে। তা দেখে রাত পার করিয়ে দেয়া কোন ব্যাপার হলো!
ফেসবুকে : গল্প- ঘুম