ডায়েরীর পাতা প্রায় শেষ পর্যায়ে। নতুন আরেকটি ডায়েরী নিতে হবে। মিথি ডায়েরীর পাতাগুলো উল্টায়। প্রতিদিন সে বাবাকে চিঠি লিখে। এটাকে ঠিক চিঠি বলা যায় না। কেননা লেখাগুলো ডায়েরীতেই থেকে যায়। পোস্ট করা হয় না। তবে যেহেতু লেখাগুলো বাবার উদ্দেশ্যেই লেখা হয় তাই চিঠি হিসেবেই দেখে। লেখার ওপর শিরোনাম দেয়। চিঠিতে সাধারণত শিরোনাম দেয়া হয় না।
“চাঁদটা বড় ছিল আজ”
বাবা, আজ আকাশের চাঁদটা অন্যদিনের চেয়ে বড়। বিভিন্নজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। চাঁদের ছবি তুলছে। সেটা আপলোড দেয়া হচ্ছে। গত জন্মদিনের তোমার গিফট দেয়া ক্যামেরাটা আছে। কিন্তু এখন আর ছবি তুলতে ইচ্ছে হয় না। শেষবার যখন চাঁদটা বড় দেখা গেলো। তুমি সবাইকে নিয়ে ছাদে উঠে গেলে। চাঁদ বড় দেখা গেলে নাকি সবাইকে ছাদে এক সঙ্গে খেতে হয়। আমরা বোনরা তো লাফাতে লাফাতে ছাদে উঠে গেলাম। আম্মু একটা ধমক দিলো, কোথায় লেখা আছে চাঁদ বড় দেখা গেলে ছাদে খেতে হয়? এত কিছু ছাদের ওপর নেয়ার দরকার কি?
তুমি কাঁচুমাচু করছিলে। আম্মুকে তুমি ভালই ভয় পাও।
: আসলে মেয়ে চাচ্ছিলো ছাদে খেতে। তাই বললাম আরকি।
: মেয়েরা চাচ্ছে নাকি তুমি চাচ্ছো? তুমিই তো একথা মেয়েদের কানে ঢুকিয়ে দিলে।
আমরা সবাই মিলে ছাদে বসলাম। তুমি আমার কানে এসে ফিসফিস করে বললে, সামনের বার এমন চাঁদ উঠার আগেই দুরবীণ কিনবে। দূরবীণে চাঁদটাকে আরও ভালো দেখা যাবে।
আম্মু তা দেখে বলল, ওই বাপ মেয়ে ফিস ফিস করে কি কথা বলো? যা বলার বড় করে বলো।
আমি কথা ঘুরানোর জন্য বলি, আব্বু, দেশেই ঠিকমত ঘুরতে পারলাম না। আবার বিদেশ ভ্রমণ। মনে হয় না তোমাদের বাসায় থাকা অবস্থায় এটা আমার কপালে আছে। দেখা যাক শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে বিদেশ ঘোরার ভাগ্য হয় নাকি। আবার উল্টাও হতে পারে ঘর থেকেই বের হওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। দেখা গেলো শ্বশুর শাশুড়ি ঘর থেকেই সেভাবে বের হওয়া পছন্দ করছেন না।
আম্মু যেকোন কারণে হোক আমার প্রতি একটু দুর্বল।
: এই মিথি, এসব কথা রাখ। সব খাওয়া রেডি। চল শুরু করে দিই। আকাশটা আসলেই সুন্দর। আর একসাথে ছাদেও ভালো লাগছে। তোর বাবাকে বোকা ভাবি সবসময়। অল্প স্বল্প বুদ্ধি আছে দেখছি।
: দেখতে হবে না কার বাবা! আমার বাবা পৃথিবীর সেরা বাবা।
আমার কথা শুনে তুমি গলা থেকে অদ্ভূত একটা শব্দ তুললে। চাঁদের আলোতে দেখলাম তুমি তোমার টিশার্টের কলার নাড়াচ্ছো।
আম্মু তা লক্ষ করে বলে, হয়েছে হয়েছে। এভাবে বলা বন্ধ কর। যেভাবে নিজের গেঞ্জি ধরে টানছে। কিছুক্ষণ পর দেখবি গেঞ্জি ছিড়ে বসে আছে।
বাবা, মায়ের কথায় তুমি একটু লজ্জা পাও। তোমার ছেলেমানুষিগুলো আমার অনেক বেশি ভালো লাগে।
পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে মিথি।
“জন্মদিনটা কেটেছে কান্নায়”
বাবা, আজ আমার জন্মদিন ছিল। জীবনের ২১ তম জন্মদিন। কেক আনা হয়েছিল। কয়েক বান্ধবী আসলো। আচ্ছা, জন্মদিনের কেক কাটার সময় কাউকে কাঁদতে শুনেছো? আমি কেঁদেছি। চোখের পানি কেকে পড়বে বলে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে তবেই কেক কাটতে হয়েছে। কান্না সামলাতে পারিনি। কেমনে পারবো? আমার জন্মদিনে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাটাতো থাকতো তোমার।
বিকেল থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিতে। কেক এখনও আসেনি কেন? এত ভালো জায়গায় অর্ডার দিলাম। এত নামডাক। বিকেলের আগে পৌঁছে দেবে বলেছে। অথচ এখনও আসার নাম নেই। এরা পেয়েছেটা কি?
কেক আসলে টেবিলে সামনে কেক নিয়ে বসে পড়লে।
আম্মু জিজ্ঞেস করল, এখন কয়টা বাজে?
: মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললে সন্ধ্যা সাতটা। যা করার তাড়াতাড়ি করো। বিরিয়ানিটা রান্না শেষ হয়েছে? বেশি সময় নাই কিন্তু।
হাতের থেকে গ্লাসগুলো নামিয়ে আম্মু বলল, কেক কাটা হবে কয়টায়?
: রাত বারটা এক মিনিটে।
: এখন বাজছে সাতটা। কেক কাটা হবে বারটায়। এখন থেকে বসে পড়েছো যে?
তুমি একটু লজ্জা পেয়ে উঠে গেলে। কিছুটা অপ্রস্তুতও হয়ে পড়লে। তোমাকে দেখে মায়াই হচ্ছিলো।
আমি বললাম, আরে বাবা উঠে পড়লে কেন?
: কেক কাটার তো আরও অনেক দেরি আছে।
: তাতে সমস্যা কি? আমার এক বন্ধু বলেছে। তার দাদী নাকি তাকে বলেছে, জন্মদিনের কেকের সামনে যত বেশি সময় বসে থাকা হয় তত আয়ু বাড়ে।
অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললে, সত্যি নাকি?
: সেরকমই তো বললে। আগের কালে কিছু সামাজিক এমন কথা প্রচলিত আছে না। এটা বোধ হয় আধুনিক কালের প্রচলিত কথা। এক সময় এটাও আগের কালের হয়ে যাবে। আর সত্য তো হতেও পারে।
ঠিক ঠিক বলে তুমি আবার কেকের সামনে বসে পড়লে। আম্মুর রাগত চোখের দিকে তাকালেও না। আচ্ছা বাবা, তুমি এত সহজ সরল কেন। সহজেই বিশ্বাস করে বসো।
তোমার কথাগুলো ভাবছিলাম আর কান্না করছিলাম। আমি একটা সময় ভাবতাম, আমার বিয়ে হলেও জন্মদিনটা শ্বশুরবাড়িতে করবো না। যেভাবে হোক বুঝিয়ে সুজিয়ে চলে আসবো। কিন্তু তোমাকে ছাড়া জন্মদিন করতে হবে এটা কোনদিন কল্পনাই করিনি। জীবনের সবচেয়ে বাজে জন্মদিন গেছে।
“রুনি স্কুলে যায় না”
রুনিটা এখন আর স্কুলে যায় না। তুমি সকালে ওকে স্কুলে দিয়ে আসতে। এরপর আমি দিয়ে আসতাম। কিন্তু স্কুলে ওর বান্ধবীরা বিভিন্ন কথা বলে ওকে। বলে, সন্ত্রাসীর কন্যা। সেজন্য জেলে আছে। ওদের অভিভাবকরা নাকি ওর সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছে। কেউ ওর সাথে কথা বলে না।
সেদিন রুনি আসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আপি, চুরি, ডাকাতি করলেই না জেলে নেয়া হয়। আব্বু কি চুরি ডাকাতি করেছে? আমি ওদের বলেছি, আমার আব্বু ভালো মানুষ। কোন অন্যায় কাজ করেনি। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করে না। উল্টা হাসে। চুপ করতে বলে। কথা বলতে মানা করে দেয়। আর স্মৃতি আছে না সে বলে, চোরের মেয়ের নাকি গলা বড়। আমার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না।
আমি রুনিকে কোন উত্তর দিতে পারি নাই। বললাম, ঠিক আছে। ভালো না লাগলে স্কুলে যেতে হবে না।…….
“আম্মু এখন আর বকা দেয় না”
আম্মু এখন আর আমাদের বকা দেয় না। রুনিটা সেদিন গ্লাস ভাঙলো, আম্মু একটা কথাও বলল না। কেমন জানি অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। আসলে আম্মুটা তোমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে। আম্মুর কিছু আলাদা টাকা ছিল। ওই জমানো টাকাগুলোর কথা কখনও বলেননি। অনেক আগে থেকে জমিয়ে আসছিলেন। সেটা ভেঙ্গে দিলেন সেদিন।
আইনজীবিকে সেখান থেকেই টাকা দেয়া হলো।
আর আম্মু এখন আর খাটে শোয় না। ফ্লোরে শোয়। কিছু দেয়ও না নিচে। তুমি ফ্লোরে থাকছো সেকথা ভেবে সেও ফ্লোরেই ঘুমায়।
ডায়েরীর আর দুই পৃষ্ঠা আছে। ড্রয়ারে নতুন অনেকগুলো ডায়েরী আছে। সেখান থেকে আরেকটা নিতে হবে।
ডায়েরীর শেষ পৃষ্ঠায় মিথি লেখা শুরু করে, আচ্ছা বাবা, এমন যদি হতো! নতুন আর ডায়েরী নিতে হচ্ছে না। এর আগেই তুমি আমাদের মধ্যে ফিরে আসলে। পৃথিবীতে কত কাকতলীয় ব্যাপারই তো ঘটে। এটা কি হতে পারে না? হয়েই গেলো। পৃথিবীর তো কোন সমস্যা হবে না। আমাদের পরিবারের মানুষগুলো অনেক খুশী হবে। আম্মু আবার খাটে ঘুমাবে। রুনি স্কুলে যাবে। আমি আর রাত জেগে কান্না করবো না। হতে পারে না?
কখনও কখনও কাকতলীয় ব্যাপার বাস্তবে ধরা দেয়। নতুন ডায়েরী আর নিতে হয়নি মিথির। তার আগেই তার বাবা মুক্তি পায়। তার বাবার বিভিন্ন রসায়নিক দ্রব্যের দোকান। ওই দোকান থেকে রসায়নিক পদার্থ কিনে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকজন। পরে পুলিশ জানতে পারে সেগুলো বোমা বানানোর জন্য ব্যবহার করতে নিয়েছে।
ওই ঘটনায় তার বাবাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিথি। খুব গরম পড়ছে। ফর্সা কপালটায় ঘাম জমেছে মিথির। সে মুছছে না। ওদিকে তার খেয়াল নেই। আজ সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তার বাবা মুক্তি পাচ্ছে।
ফেসবুকে : মিথি আজ খুশী