শনিবার, ২২ মার্চ, ২০১৪

নীরা ও অনিক (গল্প)

: আজকে বাজার করতে যেতে পারবো না।
: এটা তো নতুন কিছু না। বাজারে যেতে বললেই নতুন নতুন অজুহাত দেখাও। তোমাকে তো জোর করে বাজারে পাঠাতে হয়। তো আজকের অজুহাত কি?
: আজকের অজুহাতটা অনেক শক্তিশালী। আজকে কোন মতেই আমাকে বাজারে পাঠাতে পারবে না। ফরিদকে পাঠায় দাও।
: আরে, অজুহাতটা কি শুনি।
: বিকেলে বাংলাদেশের খেলা আছে।
: তো?
: তাই আমি বাজার করতে যেতে পারবো না।



নীরা শাড়ির আচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে। গরম পড়া শুরু করেছে। রান্নাঘরে কিছুক্ষণ থাকলেই ঘেমে একেকার হয়ে যেতে হয়। ঘরে কাজের মেয়ে আছে। ভালই রান্না করতে পারে। তারপরও নীরা নিজের হাতে রান্না করতে পছন্দ করে। নিজের হাতে রান্না করে প্রিয় মানুষকে খাওয়ানোর মাঝে একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দটা উপভোগ করে নীরা। অনিক খায় আর নীরা মুগ্ধ হয়ে তাকায়। অনিক নিজ হাতে বাজার করে এনেছে আর তা রান্না করছে এমন ব্যাপারটা নীরার অনেক পছন্দের একটা ব্যাপার। মধ্যবিত্ত সমাজে এ ব্যাপারটা খুব চালু আছে। নীরার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে মধ্যবিত্ত সমাজের সে গৃহবধূটি হয়ে যেতে! যাকে প্রতিদিন মুঠো চাল আলাদা করে রাখতে হয়, যেন মাসের শেষ দিকে টানাটানিতে বাজার করার টাকা না থাকলে ও মুঠো চালের রিজার্ভ থেকে রান্না করা হবে। কিছু টাকা আলাদা করে মাটির ব্যাংকে জমা রাখতে। প্রয়োজন লাগলে মন খারাপ করে ওই ব্যাংকটি ভাঙ্গা হবে।

অনিক বাজার করে আনছে। একি মাছ এনেছো, মাছের অর্ধেকটা পঁচা। একটা সুস্থ মাছ পর্যন্ত চিনো না। তোমাকে দিয়ে না কিছু হবে না। এসব বলতে চায় নীরা। কিন্তু হয় না। অনিককে জোর করে বাজারে পাঠানো যায় বটে। তবে মাছসহ সবকিছু বাছাই করে ফরিদ।

নীরার ইচ্ছা অনিক একা বাজার করুক। স্বামী বাজার করে আনছে আর তাকে ক্ষেপানোর জন্য ভুল ধরছে ব্যাপারটা অনেক আনন্দের মনে হয় নীরার কাছে।

: বাংলাদেশের খেলা বিকেলে। এখনতো দুপুরও হয় নাই। প্লিজ বাজার করে আনো।
: খেলা নিয়ে একটু কাজ করছি।
: মানে কি?
: ক্রিক ইনফো সহ কয়েকটা সাইট দেখছি। প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে রিসার্চ করছি। দলটির বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই নতুন। ওদের দুর্বলতা ধরতে ঝামেলা হচ্ছে। দুই ব্যাটার সমস্যা পেয়ে গিয়েছি। ওপেনার যে নামবে সে বলতে গেলে স্পিন বলতে খেলতে পারেই না। সবচেয়ে ভাল হয় প্রথম ওভারটা স্পিনার দিয়ে করালে।
: আচ্ছা তুমি কি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচার নাকি ম্যানেজার? ওদের নিয়ে এভাবে রিসার্চ করে তুমি করবেটা কি?

অনিকের মুখ কাচুমাচু হয়ে যায়। "এম্নে এম্নে করছি।"

অসহায় মুখটা দেখে খারাপ লাগে নীরার। কি ছেলেমানুষি খেলা নিয়ে। যেভাবে সিরিয়াস পারলে মনে হয় নিজেই মাঠে নেমে যায়।

: কফি এনে দিই?

অনিক হাসে। তার কফি খেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু কফি খুঁজলেই বাজারে যাওয়ার জন্য আবার তাড়া দিয়ে বলতে পারে, কফি খেয়ে তাহলে বাজারটা নিয়ে এসো।

সে ভয় থেকে খুঁজে নাই।

অনিকের হাতে কফির কাপ, নীরার হাতেও। নীরা খেলা বুঝে কম। কিন্তু অনিকের সাথে খেলা দেখে। প্রতিপক্ষের কেউ আউট হলে অনিক যে লাফ দেয় নীরার মনে হয় এ বুঝি খাট ভেঙ্গে গেলো! তবে তার কাছে এ দৃশ্যটা ভাল লাগে।

ছেলে মানুষিগুলো আছে বলেই তো জীবনটা এত সুন্দর!

০২.
নীরা ও অনিক ব্যালকনিতে বসে আছে। ওদের ব্যালকনিটা বড়। সবুজ লাইট জ্বলছে। অন্য রঙ্গের আলো মুখে পড়লে চেনা মানুষটিকেও অচেনা মনে হয়। নীরার কাছে অনিককে অচেনা মনে হচ্ছে।

অনিকের মুখ গম্ভীর। কান্না আটকানোর চেষ্টা যেন। এত কম রান করার পরও বলতেছিল জিতবে। কিন্তু পরে যখন হারলো তখন আর কিছু বলল না।

নীরা কি বলবে ভেবে পায় না। বাংলাদেশ হারায় তারও খারাপ লাগছে। কিন্তু হার জিত তো বাস্তবতা। হারলে এভাবে মুষড়ে পড়তে হবে! কিছু বলতে ইচ্ছা করে।

: শুনো।
অনিক কিছু বলে না।
: এই শুনো। এত মন খারাপ করার কি আছে। প্রতি ম্যাচে জিতবে বলে তো কথা নেই। এর আগের দুইটা ম্যাচে জিতেছে।

অনিক কিছু বলে না।
: তুমি কথা না বললে আমি চলে যাচ্ছি। তুমি একা একা বসে থাকো।

অনিক নীরার মুখের দিকে তাকায়। হুম বলো। দুইটা মাত্র শব্দ। অথচ আটকে যাচ্ছে। আর কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে গেলেই কান্না আর লুকাতে পারবে না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, এখন আর কিছুক্ষণ চুপ থাকি?

: নাহ। তুমি এত বেশি মন খারাপ করে আছো তা দেখতে আমার ভাল লাগছে না। হারলে এমন বোবা হয়ে যেতে হবে এমন কথা তো কোথাও নেই। একটা কথা বলি?
: কি?
: আমাদের ছেলে হলে আমরা তাকে ক্রিকেটার বানানো। ছোট বয়েস থেকে তাকে ক্রিকেট শেখাবো। লনে তিনজনে ক্রিকেট খেলবো। আচ্ছা ছোট ব্যাট পাওয়া যায় না?
: হা যায় তো।
: ছোট ব্যাট আনা হবে। আমাদের ছেলে ব্যাট ধরবে। বল করবে তুমি। আর ব্যাটের পেছনে থাকবো আমি। আচ্ছা উইকেটের পেছনে যে লোকটা থাকে ও একটা ঝুড়ি না কি যেন পড়ে থাকে। হেলমেটের মত।
: হুম ওইটাকে হেলমেট বলে।
: তাহলে ওই হেলমেটও পড়বো আমি। তুমি বল করছো, পিচ্চিটা ব্যাট করছে। আর আমি পেছনে। তবে মাশরাফির মত এভাবে শুয়ে গিয়ে, লাফ দিয়ে আমি কিন্তু ক্যাচ ধরতে পারবো না। তখন ক্যাচ মিস হলে আবার আমাকে দোষ দিতে পারবে না।

অনাগত সন্তানের কথা শুনে অনিকের লজ্জা লাগে। তার চোখ এখন নিচের লনটার দিকে। সেখানে ওরা খেলছে। দৃশ্যটা ভাবতেই কেমন জানি একটা ভাল লাগা অনুভব করে অনিক।

অনিক লজ্জা পাচ্ছে এটা বুঝতে পারে নীরা।
শুনো এত লজ্জার কিছু নেই। ছোট দুই পা, দুই হাত। হাতে ছোট ব্যাট। বাবু ব্যাট করছে দৃশ্যটা অনেক সুন্দর তাই না? ইশ কখন যে এ দৃশ্য সত্য হবে?