।।প্রথম পর্ব।।
ফরিদের মাথা ব্যথা করছে। ভীষণ ব্যথা। একটু আগে নাপা ট্যাবলেট খেয়েছে দুইটা এক সাথে। তারপরও কাজ করছে না। অথচ আজ দিনটি জীবনে একবারই আসে। প্রাণ প্রণ চেষ্টা করছে মাথা ব্যথা ভুলতে কিন্তু পারছে না। বাসায় মেহমান ভর্তি। কেউ সোফায়, কেউ মেঝেতে থাকবে রাত্রে। তবে নতুন বউ জামাইয়ের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা। শত হোক বাসর রাত বলে কথা।
বউকে ঘিরে পাড়ার মহিলারা এখনও আছে। কেউ বলছে বউ এর মত, কেউ বলছে ওর মত। এসব দেখে ফরিদেরই বিরক্ত লাগছে। আচ্ছা বাবা এত দেখার কি আছে। ও তো একটা মানুষ। ওতো পালিয়ে যাচ্ছে না। এখানেই থাকবে। পরেও দেখা যাবে। এভাবে এত জনের মন্তব্য ওর কেমন লাগছে কে জানে?
কিছু বললে মানুষে বলবে বউ পাগল। এই ভয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তার উপর মাথা ব্যথাটা সহ্য করতে হচ্ছে। ফরিদ বাসার পিছন দিকে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে। বাসা থেকে পুকুরটি একটু দূরে। অনেক আগের পুকুর। সেখানে দুইটা সিমেন্টের চেয়ার বানানো আছে। ঘন অন্ধকার। মাঝে মাঝে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। ঝিকিমিতি বাতি জ্বলছে। পুরা ঘর আলোকিত। নিজের ঘরটাকে কেমন অচেনা অচেনা লাগছে।
ইচ্ছা হচ্ছে পুকুরে নেমে একটা গোসল দিতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। অন্যরা উল্টা পাল্টা কিছু ভেবে বসবে। শ্বশুর বাড়ি থেকে কয়েক জন এসেছে। ওরা যদি শুনে পাগল ভাববে। পরে শ্বশুর শ্বাশুড়িরা জানবে এক পাগলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।
একটা মূর্তি দেখা যায়। এদিকেই আসছে। কাছে আসতেই চিনতে পারে ফরিদ। সোহান। খালাতো ভাই।
-বউয়ের আশে পাশে না থেকে এখানে কি করস তুই?
-ভাই মাথা ব্যথা করছে।
এটা শুনে সোহান বিরক্ত হয়। মাথা ব্যথা করার আর সময় পেল না। যা যাহ। রাত অনেক হয়েছে।
-আরেকটু পরে যাই? এখনও তো পাড়ার অনেকে রয়ে গেছে।
- না বেশির ভাগই চলে গেছে। তোর বউ ভাত খেয়ে উঠল এই মাত্র।
ফরিদের লজ্জা লাগে। তোর বউ শুনে। আজই বিয়ে হলো। সাথে সাথে বউ হয়ে গেছে। নতুন এক পরিচয়।
-চল, চল এক প্রকার হাতে ধরে টানতে টানতে ফরিদকে নিয়ে আসা হয় ঘরে।
সোহান ঘোষণা দেয়, ফরিদ পালাইছিল। তাকে ধরে আনতে হয়েছে। এটা নিয়ে সবার কি রসিকতা। ফরিদ প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু ওকে সুযোগ দিলে তো। আর এত জনের সাথে কথায় কখনো পারা যায় না। তার চেয়ে চুপ থাকায় মঙ্গল। কয়েকবার বৃথা চেষ্টার পর চুপ হয়ে যায় ফরিদ।
এ দৃশ্য দেখে সবাই উত্তেজিত। অনেকে ছবি তুলে ফেলে।
বাসর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাত ১ টা বাজে। আগে কখনো এরকম ঘরে ঢুকে নাই তাই অন্যরকম লাগে ফরিদের। রাতে ঘুমানোর সময় প্রতিদিন দরজা বন্ধ করে শোয়। কিন্তু আজ দরজা বন্ধ করতে গিয়ে অনেক লজ্জা লাগে।
সারা জীবন একা ঘুমিয়ে এসেছে। আজ অন্য একজন সাথে থাকবে। মিশ্র এক অনুভূতি হয় ফরিদের। ওর বন্ধুদের অনেকে নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে। কিন্তু ও কখনো কাউকে গিয়ে বলার সাহস পায় নি। কলেজে থাকতে লীনা পছন্দ করত। কিন্তু ওর ভীরুতা দেখে আর এগোয় নি।
ফরিদ বিছনার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ওর বউ লতা। চোখ তুলে তাকায়।
কি হলো দাঁড়ায় আছেন কেন? আমি আপনার বিছনায় আছি এই কারণে কি উঠতেছেন না? ঠিক আছে আমি নেমে যাচ্ছি।
ফরিদ আমতা আমতা করে, আরে নাহ নাহ। উঠে বসে ও।
- আপনি পালিয়েছেন কেন? মানুষের এত কথা শুনতে ভাল লেগেছে তাই না? আমার কিন্তু অনেক খারাপ লাগছে। পালাবেন কেন?
- পালাই নি তো। সোহান ভাই বানায় বানায় বলছে। মাথা ব্যথা করছিল। সেজন্য পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম।
মাথা ব্যথার কথা শুনে লতার খারাপ লাগে। মাথা ব্যথার কষ্ট বুঝে ও। ওরও মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। যখন হয় তখন ইচ্ছা করে মাথাটা ফেলে দিতে।
-এখনো কি আপনার মাথা ব্যথা আছে?
ফরিদ মাথা নাড়ে। ওর নার্ভাসও লাগছে।
-মাথা নাড়েন কেন? কথা বলতে পারেন না?
এদিকে আসেন। কপাল টিপে দিচ্ছি।
কি নরম হাত। মোলায়েম। অনেক ভাল লাগে ফরিদের। মনে হয় ঘুম চলে আসবে। তুলতুলে নরম হাত টিয়ে চেপে দিচ্ছে কপাল। সে এক আনন্দের অনুভূতি।
- আচ্ছা আমিই তো বক বক করে যাচ্ছি। আপনি কি কথা বলতে পারেন না? আমি কখনো শুনি নাই বিয়েতে মেয়েরা শুধু কথা বলে। তবে আমার সম্পর্কে বদনাম আছে। বেশি কথা বলি। আপনি এখনো কম পরিচিত এজন্য বেশি কথা বলছি না। আমি খুব সহজে কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিতে পারি কিন্তু। এটা আমার একটি এক্সটা কোয়ালিটি। বলেই হাসে লতা।
- কথা শুনতে অনেক ভাল লাগছে তো। আরামে আবেশে ফরিদ চোখ বন্ধ করে।
- হুম ভাল লাগলে ভাল। আচ্ছা আমি কি আপনাকে আপনি করেই বলব? আপনি কি কিছুই জানেন না। টিভিতে নাটক দেখেন না?
-আসলে তেমন সময় পাই না। সফটওয়ার প্রোগ্রাম নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় তো। তবে মাঝে মাঝে দেখা হয়।
-তাতো বুঝতেই পারছি। একেবারে রসকসহীন মানুষ।
একটু থেমে লতা বলে, আচ্ছা বলেন তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম কি?
ফরিদ বলে, এটা কি ধরণের প্রশ্ন? বাসর রাতে কেউ এই ধরণের প্রশ্ন করে?
- করে না আবার? আরো কত্ত কিছু করে বলে ভেংচি কাটে লতা।
একটু পরই আরে আপনি দেখি কথা বলতে জানেন। কি সুন্দর প্রশ্ন রাখছেন বাসর রাতে কেউ এরকম প্রশ্ন করে।
এখন আমি একটা করি, বাসর রাতে কেউ কি এমন নির্জীব হয়ে চুপচাপ বসে থাকে?
কপাল থেকে হাত সরিয়ে লতা। মাথা ব্যথা ভাল হলো তো? আমার হাত ব্যথা করছে।
-হা এখন মাথা ব্যথা এতটা নেই।
তা শুরু হোক তাহলে। বলেন সরি এখন থেকে আর আপনি বলছি না। আপনি বললে কেমন মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। তুমিই বলি। তুমি বললে সমস্যা আছে?
ফরিদ হাসে। মেয়েটা অনেক মিস্টি স্বরে কথা বলে। প্রতিটি শব্দ কি সুন্দর করে উচ্চারণ করে। বার বার শুনতে ইচ্ছা হয়।
-নাহ নাহ, আমারোই বলা উচিত ছিল তুমি করে বলতে বলার জন্য।
আপনি তো উচিত কাজ করেন না। পালায় লুকায় থাকেন। মানুষ গিয়ে ধরে আনতে হয়। বলে হাসে লতা।
-সত্যি আমি পালাই নি। আমার মাথা ব্যথা করছিল। হাঁটতে হাঁটতে ঐদিকে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম। ওহ বলে রাখি, এটা বলছি দেখে ভাইবেন না সব কথা বিশ্বাস করবো, অনেক কথা কিন্তু বিশ্বাস করবো না।
অনেক চঞ্চল প্রকৃতির। কি স্নিগ্ধ মুখ। ফরিদ তাকিয়ে থাকে ঐই মুখের দিকে। এই মুখের দিকে তাকালে মন ভাল হয়ে যায়। লতা তা বুঝতে পারে। তবুও না বুঝার ভান করে বলে, আচ্ছা এবার বলো কয়টা প্রেম করলে এই জীবনে?
।।দ্বিতীয় পর্ব।।
প্রশ্নটা শুনে টাসকি খেয়ে যায় ফরিদ। বাসর রাতে বউ সরাসরি এইরকম প্রশ্ন করতে পারে এটা তার জানা ছিল না। থাকবেই বা কিভাবে? আগে তো বিয়ে করে নি। আর যেসব বন্ধুদের কাছে বাসর রাতের অভিজ্ঞতা শুনেছে সেখানে বিশেষ দিকের কথাই বেশি বলা হয়েছে। বউ এরকম প্রশ্ন করেছে তা শুনে নি কারো কাছ থেকে। লতা আসলেই অন্যরকম। পানির পিপাসা লাগে ফরিদের। উঠে বসে। টেবিলের উপর জগ গ্লাস আছে। নতুন জগ। এটা এই কক্ষে যুক্ত হয়েছে। আগে পানির বোতল রাখত। সে বোতল থেকে মুখ লাগিয়ে খেয়ে ফেলত।
আজ নতুন বউ এসেছে সেজন্য টেবিলের উপর কিছু ফল সাথে পানির জগ গ্লাস রাখা। কম্পিউটারটা ঢাকা হয়েছে কভার দিয়ে। এটাও নতুন কেনা হয়েছে। কভার ব্যবহার করতে বিরক্ত লাগে ফরিদের। অথচ এখন সেটাই করা হয়েছে। বউয়ের জন্য আরো কত কিছুর নিয়ম বদলাবে কে জানে?
ওকে উঠতে দেখে লতা জিজ্ঞেস করে, কই যাও?
-একটু পানি খাবো। পিপাসা লেগেছে।
- তোমার উঠতে হবে না। আমি এনে দিচ্ছি।
লতা উঠে গিয়ে গ্লাসে পানি নেয়। তারপর তা এনে ফরিদের হাতে দেয়, এই প্রথম তোমার একটা কাজ করে দিলাম, শুরু হলো কাজ। এই জীবনে যে আরো কত কাজ করতে হবে কে জানে?
লতার হতাশ কথা শুনে খারাপ লাগে ফরিদের। আমি বলছি নাকি এনে দিতে। এভাবে বলছ কেন?
-আরে তুমি দেখি সিরিয়াস ভাবে নিয়েছো। আমি তো তোমার সাথে ডায়েরী টাইপের কথা বলেছি।
-ডায়েরী টাইপের কথা বলতে?
-আরে তাও বুঝো না। ডায়েরীতে একটা ব্যাপার কি সুন্দর করে লেখা যায়, মনের মাধুরী মিশিয়ে। যা ইচ্ছা তা। ছোট্ট একটা বিষয়কেও ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক সুন্দর অনেক আবেগী করে ফেলা যায়। যদিও ব্যাপারটা এত বিশাল কিছু না। কিন্তু ডায়েরী পড়তে গেলে মনে হয় বিশাল কিছু। আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে। নিয়মিত ডায়েরী লিখি। মজার ব্যাপার কি জানো? আমি অনেক গুলো ডায়েরী শেষ করেছি। একটা ডায়েরী ৪ মাসও যায় না আমার। প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখি। কখনো কখনো পুরা রাত জেগে লিখি।
ফরিদ জিজ্ঞেস করে, আজ লিখবে না?
এই প্রশ্ন শুনে শব্দ করে হেসে উঠে লতা। বলে কি? বাসর রাতে আমি ডায়েরী লিখি আর তুমি আমারে পাগল ভাবো না? কি আজব! তোমার মাথায় কিভাবে আসল এই রাতে আমি ডায়েরী লিখবো? তুমি ডায়েরী লিখো?
-নাহ, ডায়েরীতে কি লিখবো তাই খুঁজে পাই না। তাছাড়া আমার হাতের লেখা এত অষ্পষ্ট যে মাঝে মাঝে নিজেই বুঝি না কি লিখলাম। ডায়েরী লিখে কি লাভ? পরে নিজেই কি লিখেছি তা পড়তে পারবো না।
-মজা করে বললাতো। তুমি তো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারো। ভাল লাগছে। আমি ভেবেছিলাম বলে থেমে যায় লতা।
-কি ভেবেছিলা?
- ভেবেছিলাম একটা আধা বোবা লোকের সাথে বুঝি আমার বিয়ে হলো। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম।
ফরিদ এ কথা শুনে হেসে উঠে। লতাকে অনেক সরল মনে হয়। নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে। আজকের রাতটা সত্যিই অনেক আনন্দের।
-আচ্ছা একটা কাজ করলে তুমি মাইন্ড করবা নাতো?
-কি কাজ?
-আমি আগে কখনো শাড়ি পড়ি নাই। শাড়িতে অস্বস্তি লাগছে। থ্রিপিস পড়তে পারলে ভাল হতো। তোমার সমস্যা নাই তো?
-নাহ, নাহ। তোমার যেটা ভাল লাগে সেটাই পড়ো।
-আমি জানতাম তুমি একথা বলবা। বুদ্ধু তোমার সমস্যা না থাকলেও অন্যদের সমস্যা আছে। নানা কথা বলবে। আমি এখন থ্রিপিস পড়লেও সকালে দরজা খোলার আগেই শাড়ি পড়ে নেবো। নতুন বউকে শাড়ি ছাড়া দেখলে অনেকে মন্দ কথা বলবে।
-অন্যরা কি বলবে তা ভাববে কেন? থ্রিপিস পড়া তো অন্যায় কিছু না।
-ভাবতে হয়, সমাজে বাস করতে গেলে ভাবতে হয়। আচ্ছা এই বিষয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। আমি বাথরুমে যাচ্ছি। কাপড় পরিবর্তন করে আসছি। সাবধান ঘুমিয়ে পড়ো না কিন্তু। আমি উঠাতে পারবো না। ক্লান্ত ব্যক্তিকে ঘুম থেকে তুলতে মায়া লাগবে। শেষে দেখা যাবে আমি একা একা জেগে আছি। ঘুম গেলে কিন্তু খবর আছে।
পাতলা গড়ন লতার। লাফ দেওয়ার মত করে বিছনা থেকে নামে। দেখতে ভাল লাগে ফরিদের। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। মেজেন্ডা রঙের একটা সুতির থ্রিপিস পড়েছে। এখন অন্যরকম সুন্দর লাগছে। কি সাধারণ। অথচ কি অসাধারণ সুন্দর লাগছে।
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? এতক্ষন পর বুঝি লজ্জা ভাঙল?
এই কথা শুনে লজ্জা পায় ফরিদ। অনিচ্ছা সত্বেও চোখ নামিয়ে নেয়।
তা দেখে লতা মজা পায়। আরে কি ছেলেমানুষী। তুমি দেখি সত্যি সত্যিই লজ্জা পেয়ে গেলে। আমি তো দুষ্টামি করলাম। ফর্সা দুই হাত দিয়ে মুখ ধরে ফরিদের। ওর দিকে তাক করে বলে, নিজের বউকে দেখবা না তবে কাকে দেখবা?
বলে নিজেই হেসে ফেলে। ওর হাসি দেখে ফরিদও হাসে।
হঠাৎ মনে পড়েছে ভঙ্গিতে লতা বলে, ওহ একটা কথা তো বলো নাই?
-কি কথা?
- তুমি জীবনে কয়টা প্রেমকরলে তা তো বললা না?
।।তৃতীয় পর্ব।।
এই কি বিপদ। ওর এখনো এটা মনে আছে। এই প্রসঙ্গ কেটে গেছে ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিল ফরিদ। কিন্তু এখন দেখে লতা এটা ভুলে নাই। ফরিদ ভাবতে থাকে কি উত্তর দেওয়া যায়। যদি বলে দেয়, কারো সাথে প্রেম করে নাই, তাহলে কোন মতেই এই মেয়ে বিশ্বাস করবে না। কি বলা যায়? বানিয়ে কিছু বলবে নাকি চিন্তা করে।
লতা তাড়া দেয়। চুপ কেন? তাড়াতাড়ি উত্তর দাও। খবরদার মিথ্যা বলা কিন্তু চলবে না। আমি সহজে মিথ্যা ধরতে পারি।
-তাই নাকি? তুমি মিথ্যা ধরো কিভাবে?
-কিছু টেকনিক আছে, সমস্যা নেই। তোমাকেও শিখিয়ে দেব। দেখবা তুমিও ধরতে পারছো?
- এখুনি শিখিয়ে দাও।
এখন শিখে কি করবা? জানতে চায় লতা।
- আজ স্মরণীয় দিন। এরকম স্মরণীয় দিনে এটা শিখলে ভাল লাগত। একটা স্মরণীয় বিষয় শেখা।
- হুম আমি এত বোকা না। আমি শিখিয়ে দিই। আর তুমি বুঝে যাও আমি কি কি মিথ্যা বলছি। কি বুদ্ধিরে বাপ। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি শুধু আধা বোবা না, বুদ্ধিহীন প্রাণীও বটে। এখন তো মনে হচ্ছে তোমার মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। সো আমি বুঝলাম আমাকে যথেষ্ট সতর্ক হয়ে চলতে হবে। কথাটা বলে হেসে ফেলে লতা। হাসির তোড়ে ওর শরীর কেপে উঠে। শরীরে বয়ে যায় অন্যরকম এক ছন্দ।
এটা দেখে ফরিদের মনে হয় সত্যিই কি লতা তার পাশে আছে। এরকম একটা পরীর মত মেয়ে তার সাথে? স্বপ্ন নাতো! এমন হবে নাতো, ঘুম ভেঙে যাবে। চারদিকে তাকাবে। কাউকে দেখবে না। আগের মত বিছানায় ওই শুধু একা শুয়ে আছে।
এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছো কেন? আমি চিড়িয়াখানার কোন প্রাণী না। মানুষ। মানে মেয়ে মানুষ। এর আগে অনেক মেয়ে দেখেছো। আমিও সেরকম। ওদের মতই।
ফরিদের অন্য একটা কিছু বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মুখে এসে আটকে যায়। এটা শুনে লতা যদি খারাপ মনে করে। তাই যা বলতে চেয়েছিল তা চেপে যায়। জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আমাকে দেখার পর আর কি কি ভেবেছো আমার সম্পর্কে?
- অনেক কিছু। বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক রাত চলে যাবে। আর একজন মানুষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এরকম সুন্দর একটা রাত নষ্ট করার মানে হয় না।
ফরিদ একটু ধাক্কা খায়। “ একজন মানুষ বলতে? ” কিভাবে বলে ফেলল একজন মানুষ।
লতা হাসে। হুম আমি বুঝছি কথাটা তুমি নেগেটিভ ভাবে নিয়েছো। সহজ ভাবে নিলেই তো হয়। একজন মানুষ মানে একটা মানুষ। নাকি তুমি মানুষ না, প্রাণী? তুমি তো মানুষই।
ফরিদ একটু প্রতিবাদ করে, কথাটা সেটা না। তুমি বললে ঐ মানুষ সম্পর্কে বললে রাতটা নষ্ট হবে। আর........
কথা কেড়ে নেয় লতা, বারে নষ্ট হবে না? যে মানুষটা আমার সাথেই আছে তার সাথে অনুভূতি শেয়ার না করে আগে কি ভেবেছি তা বলে আমি এই সুন্দর সময় নষ্ট করি কিভাবে? আগে যা ভেবেছি তা আনুমানিক এবং সবটাই কল্পনা ভিত্তিক। সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। এখন যা ভাবব তোমার সম্পর্কে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বহীন একটা বিষয়ে কথা বলতে চাইনিতো এজন্যই বললাম রাত নষ্ট করার মানে হয় না। আর তুমি বুঝছো উল্টা।
মাথা ঘুরে ফরিদের। কিভাবে এদিক ঐদিক কথা ঘুরিয়ে মিলিয়ে ফেলছে। ফরিদ বলে ফেলে, তাহলে কার সাথে প্রেম হয়েছে এটা তো পূর্বের ব্যাপার। এটাও গুরুত্বহীন। এটা নিয়েও আজ এই সুন্দর দিনে কথা বলার কোন মানে হয় না।
লতা চুলের বাঁধন খুলে রেখেছে। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পুরা বিছনা জুড়ে। লতা নড়ার সময় কিছু চুল ফরিদের চোখে মুখে স্পর্শ করে। সে চুল থেকে আসে এক সুন্দর ঘ্রাণ। মন ভরে ঘ্রাণ নেয় ফরিদ।
লতা ফরিদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে, কার সাথে প্রেম হয়েছে অবশ্যই গুরুত্ব পূর্ণ। প্রথম থেকেই জেনে গেলে পরে আর মেনে নিতে কষ্ট হয় না। দরকার হয় না অভিনয় করার। অনেকে অভিনয় করতে গিয়ে নিজের জীবনটাই নষ্ট করে ফেলে। কি দরকার সুন্দর জীবন নষ্ট করা? ওহ সরি কথা গুলো দার্শনিক টাইপের হয়ে যাচ্ছ।
এগুলো বাদ। শুনো, আমি তোমার কপাল টিপে দিয়েছি। তুমি আমার কপাল টিপে দাও না কেন?
ফরিদ বলে, তোমার কি মাথা ব্যথা করছে?
-ওমা, কপাল টিপে দিতে কি মাথা ব্যথা হতেই হবে। এটা কি কোথাও লেখা আছে?
ফরিদ বলে নাহ না। এম্নেই বললাম। হাত দিয়ে কপাল স্পর্শ করে লতার। লতা কেঁপে উঠে। ফরিদও। কপালে কিছু চুল ছড়িয়ে আছে। সেগুলো সরিয়ে দেয় ফরিদ। চুলগুলো অনেক সিলকী। ধরতে অন্য রকম এক আবেশ।
আমার প্রেমের কাহিনী শুনবা? জিজ্ঞেস করে লতা।
-নাহ, নাহ। শুনার দরকার নেই। আমার খারাপ লাগবে।
-ঠিক আছে তোমার যেহেতু খারাপ লাগবে তাই এখন বলব না।
-শুধু এখন না। কখনোই বলবা না।
-তুমি বললেই হলো। আর তুমি কেমনে ভেবে বসেছো আমি প্রেম করে বসে আছি। আর যার সাথে প্রেম করছি তাকে বিয়ে না করে তোমার সাথে ঝুলে পড়েছি।
একথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে লতা। কপাল থেকে ফরিদের হাত সরিয়ে দেয়।
ফরিদ শান্ত করার চেষ্টা করে। আমি তো সেরকম কিছু বলি নি। প্লিজ তুমি রাগ করো না।
লতা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কি হলো কথা বলছো না কেন? বোবা হয়ে গেলে নাকি?
-বোবা হলেই তো তোমার লাভ। আমার প্রেম কাহিনী তোমার শুনতে হবে না।
-আরে তুমি দেখি আমার উপর এখনো রাগ করে আছো। বুঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে রাগানোর জন্য কিছু বলেনি। এই তুমি মুখ গোমড়া করে আছো কেন? আমার অনেক খারাপ লাগছে। প্লিজ হাসো।
আমার হাসি না আসলে আমি কিভাবে হাসবো বলে ফরিদের হাতটা নিজের হাতে নেয় লতা।
।। চতুর্থ পর্ব..।।
মোলায়েম হাত। সে মোলায়েম হাতে লতা ফরিদের হাত ধরে থাকে। ফরিদের ভাল লাগে। এই হাত যদি সারাজীবন এভাবে ধরে রাখত।
ফরিদের হাতের পাতা সামনের দিকে নিয়ে লতা বলে, দেখি তো তোমার হাতের রেখা।
ফরিদ হাত শক্ত করে। যাতে হাতের রেখা স্পষ্ট হয়। বুঝতে সমস্যা না হয়। “ আচ্ছা তুমি কি হাতের রেখা বুঝো?”
হুম একটু একটু। যদিও দেখা যায় আমি যা বলি তার উল্টা হয়। বলে হেসে উঠে লতা।
খুঁটিয়ে হাতের রেখাগুলো দেখতে থাকে।
ফরিদের তর সয় না। কি হলো? বলছ না কেন আমার হাতের রেখা কি বলছে?
-আরে অধৈর্য্য হচ্ছো কেন? দাঁড়াও বলছি। এখানে তো সুলক্ষণ ও আছে কুলক্ষণ ও আছে। কোনটা বলব?
ফরিদ বলে, কুলক্ষণটাই আগে বলো।
লতা প্রতিবাদ করে, নাহ। সুলক্ষণ টাই আগে বলবো। ভালটাই আগে গ্রহণ করা উচিত। পরে থাকবো কি থাকবো না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আগে ভালটা নিয়ে নেওয়াই ভাল।
ফরিদ বলে, ঠিক আছে।
-তোমার যথেষ্ট উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
-কিভাবে বুঝলে? স্পষ্ট ভাবে বলো।
-ওমা বলে কি? স্পষ্ট ভাবে বললে তো জ্যোতিষীগিরি হয় না। ভবিষ্যতবাণী করার সময় চাল রেখে দিতে হয়। এমন ভাবে সেগুলো বলতে হয় যাতে এদিক থেকে না মিললেও ঐ দিক থেকে যেন মিলে। আমি যখন বিভিন্ন ম্যাগাজিন রাশিমালা পড়ি তখন কি মনে হয় জানো?
-কি?
-যারা রাশি লিখে ওরা অনেক বড় সাহিত্যিক। অল্প কথায় সব বিষয় নিয়ে আসে রাশি গুলোতে। এমন ভাবে আনে যাতে একটা না একটাতে মিলে যাবেই। আচ্ছা তুমি রাশি বিশ্বাস করো?
-নাহ, বোগাস মনে হয়।
-আমিও বিশ্বাস করি না। তবে রাশি দেখে মজা পাই।
লতা কাত হয়ে শুয়ে আছে। ওর দিকে মুখ করে শোয়া ফরিদ। দুইজনের মধ্যে অল্প দূরত্ব। ফরিদের ইচ্ছা হয় সে দূরত্ব কমাতে। কিন্তু কেমন জানি একটা আড়ষ্টতা ভর করে আছে। ঘরে এনার্জি লাইট জ্বলছে। চারদিক আলোকিত। ঘুমের সময় লাইট জ্বলা না নেভা তা নিয়ে ভাবে না ফরিদ। অনেক সময় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়। লাইট বন্ধ করতে খেয়াল হয় না।
ফরিদ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা লাইট জ্বলা থাকলে তোমার ঘুমের অসুবিধা হয় ?
লতা কি বুঝে কে জানে। জিজ্ঞেস করে, তুমি কি এখুনি ঘুমিয়ে যাবে? আমার মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত। ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়ো। বলার মধ্যে হতাশা।
-আরে আমি বলছি নাকি ঘুমিয়ে পড়বো? লাইটের দিকে হঠাৎ নজর পড়ল সেজন্য বললাম। আচ্ছা তুমি আমার হাত দেখে কুলক্ষণ পেয়েছো বললা, সেটা কি?
-বলব? চোখে দুষ্টামি লতার।
এই জিনিষটা অদ্ভূত সুন্দর। হাসির মধ্যে চোখের দুষ্টামি। কি যে সুন্দর লাগছে। ফরিদ কিছু বলে না। তাকিয়েই থাকে লতার দিকে।
-কি হলো? বলব না?
লতার কথায় হুশ আসে ফরিদের। হা বলো।
-তোমার হাত দেখে বুঝছি তোমার কপালে বউয়ের অনেক পিটুনি আছে। বলে হাসতে থাকে লতা।
এটা শুনেই হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠে ফরিদ। লতার হাতটা টেনে নেয়। তারপর ওর হাতের রেখাটা দেখে গম্ভীর ভাবে বলে, তোমার কপালে জামাইয়ের অনেক আদর আছে।
শুনে একটু লজ্জা পায় লতা। বলে, হুম কাঁটার বিনিময়ে করিব ফুল দান তাই না?
ঘড়ির ঢং আওয়াজ শুনা যায়। তিনবার ঢং ঢং ঢং করে। এই দেয়াল ঘড়িটা যতটা বাজে ততবার ঢং শব্দ হয়। বুঝা যায় রাত তিনটা বাজছে।
লতা বলে, রাতটা কি তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে তাই না?
ফরিদ মাথা নাড়ে। আসলে রাতটা যদি দিনের মত বড় হতো তাহলে অনেক ভাল হত।
এর মধ্য মোবাইল বেজে উঠে। মোবাইল কোথায় রেখেছে মনে পড়ে না ফরিদের। এই রাতে আবার কে করল। কোন মেয়ে নাতো? মেয়ে হলে সর্বনাশ হবে। একটা মেয়ে একসময় ফোনে জ্বালাত। ফরিদ পাত্তা দিত না। তারপরও কল দিত। তবে অনেক দিন ঐ মেয়ে কল করে নি। আজ আবার করলো নাতো? ধূর ফোন বন্ধ করে রাখা উচিত ছিল। বাসর রাতে ফোন চালু রাখা মোটেই উচিত হয় নি। নিজের উপর বিরক্ত লাগে ফোন বন্ধ না করায়।
লতা বলে, কি হলো রিং হচ্ছে, ফোন ধরছো না কেন? ফোন ধরো। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা এনে ফরিদের হাতে দেয় লতা। দিতে দিতে বলে, লাউড স্পিকার দাও। দেখি তুমি কার সাথে কথা বলো।
বিপদে পড়ে যায় ফরিদ। এই মেয়ে তো অনেক জ্বালাবে মনে হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য ওর কথা অবাধ্য হতে ইচ্ছা করছে না ফরিদের। অনিচ্ছাসত্বেও ফোনটা রিসিভ করে, কিছু বলার আগে ঐপাশ শোনা যায়, দোস্ত আমি রকিব।
ফরিদ চিনতে পারে। একসাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে।
-এত রাতে ফোন দিলি যে!
-রাত কোথায় এখানে তো সূর্য মধ্যগগণে। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। সবাই ব্যস্ত।
রকিব বিদেশে স্কলারশীপ নিয়ে গেছে। সেদেশের একটা মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই সেটেল হয়ে গেছে।
-হুম বুঝলাম। কিন্তু এখানে এখন রাত তিনটা।
-বাসর রাত কেমন চলছে? কিছু হয়ছে?
এই প্রশ্নটা শুনে লতা মিটি মিটি হাসে।
ফরিদ জিজ্ঞাসা করে, তোর ভাবীর সাথে কথা বলবি?
রকিব স্পষ্টভাবে উত্তর দেয়, নাহ।
ফরিদ লতার দিকে তাকায়। নাহ বলায় ওর লেগেছে মনে হয়। মুখের হাসি থেমে গেছে। যথেষ্ট অপমানজনক এটা। কথা কাটাতে গিয়ে একথা বলতে গিয়ে বিপদ হলো। না বলাই উচিত ছিল।
ঐপাশ থেকে ভেসে আসে, কি চুপ হয়ে গেলি যে!! আমার অনেক ইচ্ছা করছে ভাবীর মিস্টি গলা শুনতে তারপরও কথা বলব না কেন বলছি তার কারণ জানতে চাইবি না?
না পারতে বলার মত ফরিদ জিজ্ঞেস করে, কেন?
বাসর রাতে স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সাথে নতুন বউ কথা বললে অমঙ্গল হয়। কাল কথা বলব। আজ প্রবল ইচ্ছা দমিয়ে রাখছি। আচ্ছা তোদের এই সুন্দর সময় অনেক বিরক্ত করলাম। রাখি। আর ভাগ্যও ভাল তোর ফোন খোলা পেয়েছি। বাসর রাতে কেউ ফোন খোলা রাখে না।
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রেখে দেয় রকিব।
কারণটা জেনে ভাল লাগে লতার। প্রথমে যখন না বলল তখন অনেক খারাপ লেগেছিল। আসলে এরকম কথা আছে নাকি? থাকতেও পারে। বলা যায় না।
ফোন রাখার পর ভয় দূর হয়। এক টিপে লাল বাটনটা ধরে ফোন বন্ধ করে দেয় ফরিদ।
লতা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আমরা কি শুধু গল্পই করবো?
...................................
Sponsored By :
ফরিদের মাথা ব্যথা করছে। ভীষণ ব্যথা। একটু আগে নাপা ট্যাবলেট খেয়েছে দুইটা এক সাথে। তারপরও কাজ করছে না। অথচ আজ দিনটি জীবনে একবারই আসে। প্রাণ প্রণ চেষ্টা করছে মাথা ব্যথা ভুলতে কিন্তু পারছে না। বাসায় মেহমান ভর্তি। কেউ সোফায়, কেউ মেঝেতে থাকবে রাত্রে। তবে নতুন বউ জামাইয়ের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা। শত হোক বাসর রাত বলে কথা।
বউকে ঘিরে পাড়ার মহিলারা এখনও আছে। কেউ বলছে বউ এর মত, কেউ বলছে ওর মত। এসব দেখে ফরিদেরই বিরক্ত লাগছে। আচ্ছা বাবা এত দেখার কি আছে। ও তো একটা মানুষ। ওতো পালিয়ে যাচ্ছে না। এখানেই থাকবে। পরেও দেখা যাবে। এভাবে এত জনের মন্তব্য ওর কেমন লাগছে কে জানে?
কিছু বললে মানুষে বলবে বউ পাগল। এই ভয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তার উপর মাথা ব্যথাটা সহ্য করতে হচ্ছে। ফরিদ বাসার পিছন দিকে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে। বাসা থেকে পুকুরটি একটু দূরে। অনেক আগের পুকুর। সেখানে দুইটা সিমেন্টের চেয়ার বানানো আছে। ঘন অন্ধকার। মাঝে মাঝে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। ঝিকিমিতি বাতি জ্বলছে। পুরা ঘর আলোকিত। নিজের ঘরটাকে কেমন অচেনা অচেনা লাগছে।
ইচ্ছা হচ্ছে পুকুরে নেমে একটা গোসল দিতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। অন্যরা উল্টা পাল্টা কিছু ভেবে বসবে। শ্বশুর বাড়ি থেকে কয়েক জন এসেছে। ওরা যদি শুনে পাগল ভাববে। পরে শ্বশুর শ্বাশুড়িরা জানবে এক পাগলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।
একটা মূর্তি দেখা যায়। এদিকেই আসছে। কাছে আসতেই চিনতে পারে ফরিদ। সোহান। খালাতো ভাই।
-বউয়ের আশে পাশে না থেকে এখানে কি করস তুই?
-ভাই মাথা ব্যথা করছে।
এটা শুনে সোহান বিরক্ত হয়। মাথা ব্যথা করার আর সময় পেল না। যা যাহ। রাত অনেক হয়েছে।
-আরেকটু পরে যাই? এখনও তো পাড়ার অনেকে রয়ে গেছে।
- না বেশির ভাগই চলে গেছে। তোর বউ ভাত খেয়ে উঠল এই মাত্র।
ফরিদের লজ্জা লাগে। তোর বউ শুনে। আজই বিয়ে হলো। সাথে সাথে বউ হয়ে গেছে। নতুন এক পরিচয়।
-চল, চল এক প্রকার হাতে ধরে টানতে টানতে ফরিদকে নিয়ে আসা হয় ঘরে।
সোহান ঘোষণা দেয়, ফরিদ পালাইছিল। তাকে ধরে আনতে হয়েছে। এটা নিয়ে সবার কি রসিকতা। ফরিদ প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু ওকে সুযোগ দিলে তো। আর এত জনের সাথে কথায় কখনো পারা যায় না। তার চেয়ে চুপ থাকায় মঙ্গল। কয়েকবার বৃথা চেষ্টার পর চুপ হয়ে যায় ফরিদ।
এ দৃশ্য দেখে সবাই উত্তেজিত। অনেকে ছবি তুলে ফেলে।
বাসর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাত ১ টা বাজে। আগে কখনো এরকম ঘরে ঢুকে নাই তাই অন্যরকম লাগে ফরিদের। রাতে ঘুমানোর সময় প্রতিদিন দরজা বন্ধ করে শোয়। কিন্তু আজ দরজা বন্ধ করতে গিয়ে অনেক লজ্জা লাগে।
সারা জীবন একা ঘুমিয়ে এসেছে। আজ অন্য একজন সাথে থাকবে। মিশ্র এক অনুভূতি হয় ফরিদের। ওর বন্ধুদের অনেকে নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে। কিন্তু ও কখনো কাউকে গিয়ে বলার সাহস পায় নি। কলেজে থাকতে লীনা পছন্দ করত। কিন্তু ওর ভীরুতা দেখে আর এগোয় নি।
ফরিদ বিছনার কাছে এসে দাঁড়ায়।
ওর বউ লতা। চোখ তুলে তাকায়।
কি হলো দাঁড়ায় আছেন কেন? আমি আপনার বিছনায় আছি এই কারণে কি উঠতেছেন না? ঠিক আছে আমি নেমে যাচ্ছি।
ফরিদ আমতা আমতা করে, আরে নাহ নাহ। উঠে বসে ও।
- আপনি পালিয়েছেন কেন? মানুষের এত কথা শুনতে ভাল লেগেছে তাই না? আমার কিন্তু অনেক খারাপ লাগছে। পালাবেন কেন?
- পালাই নি তো। সোহান ভাই বানায় বানায় বলছে। মাথা ব্যথা করছিল। সেজন্য পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম।
মাথা ব্যথার কথা শুনে লতার খারাপ লাগে। মাথা ব্যথার কষ্ট বুঝে ও। ওরও মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। যখন হয় তখন ইচ্ছা করে মাথাটা ফেলে দিতে।
-এখনো কি আপনার মাথা ব্যথা আছে?
ফরিদ মাথা নাড়ে। ওর নার্ভাসও লাগছে।
-মাথা নাড়েন কেন? কথা বলতে পারেন না?
এদিকে আসেন। কপাল টিপে দিচ্ছি।
কি নরম হাত। মোলায়েম। অনেক ভাল লাগে ফরিদের। মনে হয় ঘুম চলে আসবে। তুলতুলে নরম হাত টিয়ে চেপে দিচ্ছে কপাল। সে এক আনন্দের অনুভূতি।
- আচ্ছা আমিই তো বক বক করে যাচ্ছি। আপনি কি কথা বলতে পারেন না? আমি কখনো শুনি নাই বিয়েতে মেয়েরা শুধু কথা বলে। তবে আমার সম্পর্কে বদনাম আছে। বেশি কথা বলি। আপনি এখনো কম পরিচিত এজন্য বেশি কথা বলছি না। আমি খুব সহজে কথা বলে মাথা ধরিয়ে দিতে পারি কিন্তু। এটা আমার একটি এক্সটা কোয়ালিটি। বলেই হাসে লতা।
- কথা শুনতে অনেক ভাল লাগছে তো। আরামে আবেশে ফরিদ চোখ বন্ধ করে।
- হুম ভাল লাগলে ভাল। আচ্ছা আমি কি আপনাকে আপনি করেই বলব? আপনি কি কিছুই জানেন না। টিভিতে নাটক দেখেন না?
-আসলে তেমন সময় পাই না। সফটওয়ার প্রোগ্রাম নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় তো। তবে মাঝে মাঝে দেখা হয়।
-তাতো বুঝতেই পারছি। একেবারে রসকসহীন মানুষ।
একটু থেমে লতা বলে, আচ্ছা বলেন তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম কি?
ফরিদ বলে, এটা কি ধরণের প্রশ্ন? বাসর রাতে কেউ এই ধরণের প্রশ্ন করে?
- করে না আবার? আরো কত্ত কিছু করে বলে ভেংচি কাটে লতা।
একটু পরই আরে আপনি দেখি কথা বলতে জানেন। কি সুন্দর প্রশ্ন রাখছেন বাসর রাতে কেউ এরকম প্রশ্ন করে।
এখন আমি একটা করি, বাসর রাতে কেউ কি এমন নির্জীব হয়ে চুপচাপ বসে থাকে?
কপাল থেকে হাত সরিয়ে লতা। মাথা ব্যথা ভাল হলো তো? আমার হাত ব্যথা করছে।
-হা এখন মাথা ব্যথা এতটা নেই।
তা শুরু হোক তাহলে। বলেন সরি এখন থেকে আর আপনি বলছি না। আপনি বললে কেমন মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। তুমিই বলি। তুমি বললে সমস্যা আছে?
ফরিদ হাসে। মেয়েটা অনেক মিস্টি স্বরে কথা বলে। প্রতিটি শব্দ কি সুন্দর করে উচ্চারণ করে। বার বার শুনতে ইচ্ছা হয়।
-নাহ নাহ, আমারোই বলা উচিত ছিল তুমি করে বলতে বলার জন্য।
আপনি তো উচিত কাজ করেন না। পালায় লুকায় থাকেন। মানুষ গিয়ে ধরে আনতে হয়। বলে হাসে লতা।
-সত্যি আমি পালাই নি। আমার মাথা ব্যথা করছিল। হাঁটতে হাঁটতে ঐদিকে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম। ওহ বলে রাখি, এটা বলছি দেখে ভাইবেন না সব কথা বিশ্বাস করবো, অনেক কথা কিন্তু বিশ্বাস করবো না।
অনেক চঞ্চল প্রকৃতির। কি স্নিগ্ধ মুখ। ফরিদ তাকিয়ে থাকে ঐই মুখের দিকে। এই মুখের দিকে তাকালে মন ভাল হয়ে যায়। লতা তা বুঝতে পারে। তবুও না বুঝার ভান করে বলে, আচ্ছা এবার বলো কয়টা প্রেম করলে এই জীবনে?
।।দ্বিতীয় পর্ব।।
প্রশ্নটা শুনে টাসকি খেয়ে যায় ফরিদ। বাসর রাতে বউ সরাসরি এইরকম প্রশ্ন করতে পারে এটা তার জানা ছিল না। থাকবেই বা কিভাবে? আগে তো বিয়ে করে নি। আর যেসব বন্ধুদের কাছে বাসর রাতের অভিজ্ঞতা শুনেছে সেখানে বিশেষ দিকের কথাই বেশি বলা হয়েছে। বউ এরকম প্রশ্ন করেছে তা শুনে নি কারো কাছ থেকে। লতা আসলেই অন্যরকম। পানির পিপাসা লাগে ফরিদের। উঠে বসে। টেবিলের উপর জগ গ্লাস আছে। নতুন জগ। এটা এই কক্ষে যুক্ত হয়েছে। আগে পানির বোতল রাখত। সে বোতল থেকে মুখ লাগিয়ে খেয়ে ফেলত।
আজ নতুন বউ এসেছে সেজন্য টেবিলের উপর কিছু ফল সাথে পানির জগ গ্লাস রাখা। কম্পিউটারটা ঢাকা হয়েছে কভার দিয়ে। এটাও নতুন কেনা হয়েছে। কভার ব্যবহার করতে বিরক্ত লাগে ফরিদের। অথচ এখন সেটাই করা হয়েছে। বউয়ের জন্য আরো কত কিছুর নিয়ম বদলাবে কে জানে?
ওকে উঠতে দেখে লতা জিজ্ঞেস করে, কই যাও?
-একটু পানি খাবো। পিপাসা লেগেছে।
- তোমার উঠতে হবে না। আমি এনে দিচ্ছি।
লতা উঠে গিয়ে গ্লাসে পানি নেয়। তারপর তা এনে ফরিদের হাতে দেয়, এই প্রথম তোমার একটা কাজ করে দিলাম, শুরু হলো কাজ। এই জীবনে যে আরো কত কাজ করতে হবে কে জানে?
লতার হতাশ কথা শুনে খারাপ লাগে ফরিদের। আমি বলছি নাকি এনে দিতে। এভাবে বলছ কেন?
-আরে তুমি দেখি সিরিয়াস ভাবে নিয়েছো। আমি তো তোমার সাথে ডায়েরী টাইপের কথা বলেছি।
-ডায়েরী টাইপের কথা বলতে?
-আরে তাও বুঝো না। ডায়েরীতে একটা ব্যাপার কি সুন্দর করে লেখা যায়, মনের মাধুরী মিশিয়ে। যা ইচ্ছা তা। ছোট্ট একটা বিষয়কেও ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক সুন্দর অনেক আবেগী করে ফেলা যায়। যদিও ব্যাপারটা এত বিশাল কিছু না। কিন্তু ডায়েরী পড়তে গেলে মনে হয় বিশাল কিছু। আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে। নিয়মিত ডায়েরী লিখি। মজার ব্যাপার কি জানো? আমি অনেক গুলো ডায়েরী শেষ করেছি। একটা ডায়েরী ৪ মাসও যায় না আমার। প্রতিদিন কিছু না কিছু লিখি। কখনো কখনো পুরা রাত জেগে লিখি।
ফরিদ জিজ্ঞেস করে, আজ লিখবে না?
এই প্রশ্ন শুনে শব্দ করে হেসে উঠে লতা। বলে কি? বাসর রাতে আমি ডায়েরী লিখি আর তুমি আমারে পাগল ভাবো না? কি আজব! তোমার মাথায় কিভাবে আসল এই রাতে আমি ডায়েরী লিখবো? তুমি ডায়েরী লিখো?
-নাহ, ডায়েরীতে কি লিখবো তাই খুঁজে পাই না। তাছাড়া আমার হাতের লেখা এত অষ্পষ্ট যে মাঝে মাঝে নিজেই বুঝি না কি লিখলাম। ডায়েরী লিখে কি লাভ? পরে নিজেই কি লিখেছি তা পড়তে পারবো না।
-মজা করে বললাতো। তুমি তো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারো। ভাল লাগছে। আমি ভেবেছিলাম বলে থেমে যায় লতা।
-কি ভেবেছিলা?
- ভেবেছিলাম একটা আধা বোবা লোকের সাথে বুঝি আমার বিয়ে হলো। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম।
ফরিদ এ কথা শুনে হেসে উঠে। লতাকে অনেক সরল মনে হয়। নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে। আজকের রাতটা সত্যিই অনেক আনন্দের।
-আচ্ছা একটা কাজ করলে তুমি মাইন্ড করবা নাতো?
-কি কাজ?
-আমি আগে কখনো শাড়ি পড়ি নাই। শাড়িতে অস্বস্তি লাগছে। থ্রিপিস পড়তে পারলে ভাল হতো। তোমার সমস্যা নাই তো?
-নাহ, নাহ। তোমার যেটা ভাল লাগে সেটাই পড়ো।
-আমি জানতাম তুমি একথা বলবা। বুদ্ধু তোমার সমস্যা না থাকলেও অন্যদের সমস্যা আছে। নানা কথা বলবে। আমি এখন থ্রিপিস পড়লেও সকালে দরজা খোলার আগেই শাড়ি পড়ে নেবো। নতুন বউকে শাড়ি ছাড়া দেখলে অনেকে মন্দ কথা বলবে।
-অন্যরা কি বলবে তা ভাববে কেন? থ্রিপিস পড়া তো অন্যায় কিছু না।
-ভাবতে হয়, সমাজে বাস করতে গেলে ভাবতে হয়। আচ্ছা এই বিষয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। আমি বাথরুমে যাচ্ছি। কাপড় পরিবর্তন করে আসছি। সাবধান ঘুমিয়ে পড়ো না কিন্তু। আমি উঠাতে পারবো না। ক্লান্ত ব্যক্তিকে ঘুম থেকে তুলতে মায়া লাগবে। শেষে দেখা যাবে আমি একা একা জেগে আছি। ঘুম গেলে কিন্তু খবর আছে।
পাতলা গড়ন লতার। লাফ দেওয়ার মত করে বিছনা থেকে নামে। দেখতে ভাল লাগে ফরিদের। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। মেজেন্ডা রঙের একটা সুতির থ্রিপিস পড়েছে। এখন অন্যরকম সুন্দর লাগছে। কি সাধারণ। অথচ কি অসাধারণ সুন্দর লাগছে।
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? এতক্ষন পর বুঝি লজ্জা ভাঙল?
এই কথা শুনে লজ্জা পায় ফরিদ। অনিচ্ছা সত্বেও চোখ নামিয়ে নেয়।
তা দেখে লতা মজা পায়। আরে কি ছেলেমানুষী। তুমি দেখি সত্যি সত্যিই লজ্জা পেয়ে গেলে। আমি তো দুষ্টামি করলাম। ফর্সা দুই হাত দিয়ে মুখ ধরে ফরিদের। ওর দিকে তাক করে বলে, নিজের বউকে দেখবা না তবে কাকে দেখবা?
বলে নিজেই হেসে ফেলে। ওর হাসি দেখে ফরিদও হাসে।
হঠাৎ মনে পড়েছে ভঙ্গিতে লতা বলে, ওহ একটা কথা তো বলো নাই?
-কি কথা?
- তুমি জীবনে কয়টা প্রেমকরলে তা তো বললা না?
।।তৃতীয় পর্ব।।
এই কি বিপদ। ওর এখনো এটা মনে আছে। এই প্রসঙ্গ কেটে গেছে ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিল ফরিদ। কিন্তু এখন দেখে লতা এটা ভুলে নাই। ফরিদ ভাবতে থাকে কি উত্তর দেওয়া যায়। যদি বলে দেয়, কারো সাথে প্রেম করে নাই, তাহলে কোন মতেই এই মেয়ে বিশ্বাস করবে না। কি বলা যায়? বানিয়ে কিছু বলবে নাকি চিন্তা করে।
লতা তাড়া দেয়। চুপ কেন? তাড়াতাড়ি উত্তর দাও। খবরদার মিথ্যা বলা কিন্তু চলবে না। আমি সহজে মিথ্যা ধরতে পারি।
-তাই নাকি? তুমি মিথ্যা ধরো কিভাবে?
-কিছু টেকনিক আছে, সমস্যা নেই। তোমাকেও শিখিয়ে দেব। দেখবা তুমিও ধরতে পারছো?
- এখুনি শিখিয়ে দাও।
এখন শিখে কি করবা? জানতে চায় লতা।
- আজ স্মরণীয় দিন। এরকম স্মরণীয় দিনে এটা শিখলে ভাল লাগত। একটা স্মরণীয় বিষয় শেখা।
- হুম আমি এত বোকা না। আমি শিখিয়ে দিই। আর তুমি বুঝে যাও আমি কি কি মিথ্যা বলছি। কি বুদ্ধিরে বাপ। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি শুধু আধা বোবা না, বুদ্ধিহীন প্রাণীও বটে। এখন তো মনে হচ্ছে তোমার মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। সো আমি বুঝলাম আমাকে যথেষ্ট সতর্ক হয়ে চলতে হবে। কথাটা বলে হেসে ফেলে লতা। হাসির তোড়ে ওর শরীর কেপে উঠে। শরীরে বয়ে যায় অন্যরকম এক ছন্দ।
এটা দেখে ফরিদের মনে হয় সত্যিই কি লতা তার পাশে আছে। এরকম একটা পরীর মত মেয়ে তার সাথে? স্বপ্ন নাতো! এমন হবে নাতো, ঘুম ভেঙে যাবে। চারদিকে তাকাবে। কাউকে দেখবে না। আগের মত বিছানায় ওই শুধু একা শুয়ে আছে।
এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছো কেন? আমি চিড়িয়াখানার কোন প্রাণী না। মানুষ। মানে মেয়ে মানুষ। এর আগে অনেক মেয়ে দেখেছো। আমিও সেরকম। ওদের মতই।
ফরিদের অন্য একটা কিছু বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু মুখে এসে আটকে যায়। এটা শুনে লতা যদি খারাপ মনে করে। তাই যা বলতে চেয়েছিল তা চেপে যায়। জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আমাকে দেখার পর আর কি কি ভেবেছো আমার সম্পর্কে?
- অনেক কিছু। বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক রাত চলে যাবে। আর একজন মানুষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এরকম সুন্দর একটা রাত নষ্ট করার মানে হয় না।
ফরিদ একটু ধাক্কা খায়। “ একজন মানুষ বলতে? ” কিভাবে বলে ফেলল একজন মানুষ।
লতা হাসে। হুম আমি বুঝছি কথাটা তুমি নেগেটিভ ভাবে নিয়েছো। সহজ ভাবে নিলেই তো হয়। একজন মানুষ মানে একটা মানুষ। নাকি তুমি মানুষ না, প্রাণী? তুমি তো মানুষই।
ফরিদ একটু প্রতিবাদ করে, কথাটা সেটা না। তুমি বললে ঐ মানুষ সম্পর্কে বললে রাতটা নষ্ট হবে। আর........
কথা কেড়ে নেয় লতা, বারে নষ্ট হবে না? যে মানুষটা আমার সাথেই আছে তার সাথে অনুভূতি শেয়ার না করে আগে কি ভেবেছি তা বলে আমি এই সুন্দর সময় নষ্ট করি কিভাবে? আগে যা ভেবেছি তা আনুমানিক এবং সবটাই কল্পনা ভিত্তিক। সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। এখন যা ভাবব তোমার সম্পর্কে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বহীন একটা বিষয়ে কথা বলতে চাইনিতো এজন্যই বললাম রাত নষ্ট করার মানে হয় না। আর তুমি বুঝছো উল্টা।
মাথা ঘুরে ফরিদের। কিভাবে এদিক ঐদিক কথা ঘুরিয়ে মিলিয়ে ফেলছে। ফরিদ বলে ফেলে, তাহলে কার সাথে প্রেম হয়েছে এটা তো পূর্বের ব্যাপার। এটাও গুরুত্বহীন। এটা নিয়েও আজ এই সুন্দর দিনে কথা বলার কোন মানে হয় না।
লতা চুলের বাঁধন খুলে রেখেছে। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পুরা বিছনা জুড়ে। লতা নড়ার সময় কিছু চুল ফরিদের চোখে মুখে স্পর্শ করে। সে চুল থেকে আসে এক সুন্দর ঘ্রাণ। মন ভরে ঘ্রাণ নেয় ফরিদ।
লতা ফরিদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে, কার সাথে প্রেম হয়েছে অবশ্যই গুরুত্ব পূর্ণ। প্রথম থেকেই জেনে গেলে পরে আর মেনে নিতে কষ্ট হয় না। দরকার হয় না অভিনয় করার। অনেকে অভিনয় করতে গিয়ে নিজের জীবনটাই নষ্ট করে ফেলে। কি দরকার সুন্দর জীবন নষ্ট করা? ওহ সরি কথা গুলো দার্শনিক টাইপের হয়ে যাচ্ছ।
এগুলো বাদ। শুনো, আমি তোমার কপাল টিপে দিয়েছি। তুমি আমার কপাল টিপে দাও না কেন?
ফরিদ বলে, তোমার কি মাথা ব্যথা করছে?
-ওমা, কপাল টিপে দিতে কি মাথা ব্যথা হতেই হবে। এটা কি কোথাও লেখা আছে?
ফরিদ বলে নাহ না। এম্নেই বললাম। হাত দিয়ে কপাল স্পর্শ করে লতার। লতা কেঁপে উঠে। ফরিদও। কপালে কিছু চুল ছড়িয়ে আছে। সেগুলো সরিয়ে দেয় ফরিদ। চুলগুলো অনেক সিলকী। ধরতে অন্য রকম এক আবেশ।
আমার প্রেমের কাহিনী শুনবা? জিজ্ঞেস করে লতা।
-নাহ, নাহ। শুনার দরকার নেই। আমার খারাপ লাগবে।
-ঠিক আছে তোমার যেহেতু খারাপ লাগবে তাই এখন বলব না।
-শুধু এখন না। কখনোই বলবা না।
-তুমি বললেই হলো। আর তুমি কেমনে ভেবে বসেছো আমি প্রেম করে বসে আছি। আর যার সাথে প্রেম করছি তাকে বিয়ে না করে তোমার সাথে ঝুলে পড়েছি।
একথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে লতা। কপাল থেকে ফরিদের হাত সরিয়ে দেয়।
ফরিদ শান্ত করার চেষ্টা করে। আমি তো সেরকম কিছু বলি নি। প্লিজ তুমি রাগ করো না।
লতা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কি হলো কথা বলছো না কেন? বোবা হয়ে গেলে নাকি?
-বোবা হলেই তো তোমার লাভ। আমার প্রেম কাহিনী তোমার শুনতে হবে না।
-আরে তুমি দেখি আমার উপর এখনো রাগ করে আছো। বুঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে রাগানোর জন্য কিছু বলেনি। এই তুমি মুখ গোমড়া করে আছো কেন? আমার অনেক খারাপ লাগছে। প্লিজ হাসো।
আমার হাসি না আসলে আমি কিভাবে হাসবো বলে ফরিদের হাতটা নিজের হাতে নেয় লতা।
।। চতুর্থ পর্ব..।।
মোলায়েম হাত। সে মোলায়েম হাতে লতা ফরিদের হাত ধরে থাকে। ফরিদের ভাল লাগে। এই হাত যদি সারাজীবন এভাবে ধরে রাখত।
ফরিদের হাতের পাতা সামনের দিকে নিয়ে লতা বলে, দেখি তো তোমার হাতের রেখা।
ফরিদ হাত শক্ত করে। যাতে হাতের রেখা স্পষ্ট হয়। বুঝতে সমস্যা না হয়। “ আচ্ছা তুমি কি হাতের রেখা বুঝো?”
হুম একটু একটু। যদিও দেখা যায় আমি যা বলি তার উল্টা হয়। বলে হেসে উঠে লতা।
খুঁটিয়ে হাতের রেখাগুলো দেখতে থাকে।
ফরিদের তর সয় না। কি হলো? বলছ না কেন আমার হাতের রেখা কি বলছে?
-আরে অধৈর্য্য হচ্ছো কেন? দাঁড়াও বলছি। এখানে তো সুলক্ষণ ও আছে কুলক্ষণ ও আছে। কোনটা বলব?
ফরিদ বলে, কুলক্ষণটাই আগে বলো।
লতা প্রতিবাদ করে, নাহ। সুলক্ষণ টাই আগে বলবো। ভালটাই আগে গ্রহণ করা উচিত। পরে থাকবো কি থাকবো না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আগে ভালটা নিয়ে নেওয়াই ভাল।
ফরিদ বলে, ঠিক আছে।
-তোমার যথেষ্ট উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
-কিভাবে বুঝলে? স্পষ্ট ভাবে বলো।
-ওমা বলে কি? স্পষ্ট ভাবে বললে তো জ্যোতিষীগিরি হয় না। ভবিষ্যতবাণী করার সময় চাল রেখে দিতে হয়। এমন ভাবে সেগুলো বলতে হয় যাতে এদিক থেকে না মিললেও ঐ দিক থেকে যেন মিলে। আমি যখন বিভিন্ন ম্যাগাজিন রাশিমালা পড়ি তখন কি মনে হয় জানো?
-কি?
-যারা রাশি লিখে ওরা অনেক বড় সাহিত্যিক। অল্প কথায় সব বিষয় নিয়ে আসে রাশি গুলোতে। এমন ভাবে আনে যাতে একটা না একটাতে মিলে যাবেই। আচ্ছা তুমি রাশি বিশ্বাস করো?
-নাহ, বোগাস মনে হয়।
-আমিও বিশ্বাস করি না। তবে রাশি দেখে মজা পাই।
লতা কাত হয়ে শুয়ে আছে। ওর দিকে মুখ করে শোয়া ফরিদ। দুইজনের মধ্যে অল্প দূরত্ব। ফরিদের ইচ্ছা হয় সে দূরত্ব কমাতে। কিন্তু কেমন জানি একটা আড়ষ্টতা ভর করে আছে। ঘরে এনার্জি লাইট জ্বলছে। চারদিক আলোকিত। ঘুমের সময় লাইট জ্বলা না নেভা তা নিয়ে ভাবে না ফরিদ। অনেক সময় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়। লাইট বন্ধ করতে খেয়াল হয় না।
ফরিদ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা লাইট জ্বলা থাকলে তোমার ঘুমের অসুবিধা হয় ?
লতা কি বুঝে কে জানে। জিজ্ঞেস করে, তুমি কি এখুনি ঘুমিয়ে যাবে? আমার মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত। ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়ো। বলার মধ্যে হতাশা।
-আরে আমি বলছি নাকি ঘুমিয়ে পড়বো? লাইটের দিকে হঠাৎ নজর পড়ল সেজন্য বললাম। আচ্ছা তুমি আমার হাত দেখে কুলক্ষণ পেয়েছো বললা, সেটা কি?
-বলব? চোখে দুষ্টামি লতার।
এই জিনিষটা অদ্ভূত সুন্দর। হাসির মধ্যে চোখের দুষ্টামি। কি যে সুন্দর লাগছে। ফরিদ কিছু বলে না। তাকিয়েই থাকে লতার দিকে।
-কি হলো? বলব না?
লতার কথায় হুশ আসে ফরিদের। হা বলো।
-তোমার হাত দেখে বুঝছি তোমার কপালে বউয়ের অনেক পিটুনি আছে। বলে হাসতে থাকে লতা।
এটা শুনেই হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠে ফরিদ। লতার হাতটা টেনে নেয়। তারপর ওর হাতের রেখাটা দেখে গম্ভীর ভাবে বলে, তোমার কপালে জামাইয়ের অনেক আদর আছে।
শুনে একটু লজ্জা পায় লতা। বলে, হুম কাঁটার বিনিময়ে করিব ফুল দান তাই না?
ঘড়ির ঢং আওয়াজ শুনা যায়। তিনবার ঢং ঢং ঢং করে। এই দেয়াল ঘড়িটা যতটা বাজে ততবার ঢং শব্দ হয়। বুঝা যায় রাত তিনটা বাজছে।
লতা বলে, রাতটা কি তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে তাই না?
ফরিদ মাথা নাড়ে। আসলে রাতটা যদি দিনের মত বড় হতো তাহলে অনেক ভাল হত।
এর মধ্য মোবাইল বেজে উঠে। মোবাইল কোথায় রেখেছে মনে পড়ে না ফরিদের। এই রাতে আবার কে করল। কোন মেয়ে নাতো? মেয়ে হলে সর্বনাশ হবে। একটা মেয়ে একসময় ফোনে জ্বালাত। ফরিদ পাত্তা দিত না। তারপরও কল দিত। তবে অনেক দিন ঐ মেয়ে কল করে নি। আজ আবার করলো নাতো? ধূর ফোন বন্ধ করে রাখা উচিত ছিল। বাসর রাতে ফোন চালু রাখা মোটেই উচিত হয় নি। নিজের উপর বিরক্ত লাগে ফোন বন্ধ না করায়।
লতা বলে, কি হলো রিং হচ্ছে, ফোন ধরছো না কেন? ফোন ধরো। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা এনে ফরিদের হাতে দেয় লতা। দিতে দিতে বলে, লাউড স্পিকার দাও। দেখি তুমি কার সাথে কথা বলো।
বিপদে পড়ে যায় ফরিদ। এই মেয়ে তো অনেক জ্বালাবে মনে হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য ওর কথা অবাধ্য হতে ইচ্ছা করছে না ফরিদের। অনিচ্ছাসত্বেও ফোনটা রিসিভ করে, কিছু বলার আগে ঐপাশ শোনা যায়, দোস্ত আমি রকিব।
ফরিদ চিনতে পারে। একসাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে।
-এত রাতে ফোন দিলি যে!
-রাত কোথায় এখানে তো সূর্য মধ্যগগণে। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। সবাই ব্যস্ত।
রকিব বিদেশে স্কলারশীপ নিয়ে গেছে। সেদেশের একটা মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই সেটেল হয়ে গেছে।
-হুম বুঝলাম। কিন্তু এখানে এখন রাত তিনটা।
-বাসর রাত কেমন চলছে? কিছু হয়ছে?
এই প্রশ্নটা শুনে লতা মিটি মিটি হাসে।
ফরিদ জিজ্ঞাসা করে, তোর ভাবীর সাথে কথা বলবি?
রকিব স্পষ্টভাবে উত্তর দেয়, নাহ।
ফরিদ লতার দিকে তাকায়। নাহ বলায় ওর লেগেছে মনে হয়। মুখের হাসি থেমে গেছে। যথেষ্ট অপমানজনক এটা। কথা কাটাতে গিয়ে একথা বলতে গিয়ে বিপদ হলো। না বলাই উচিত ছিল।
ঐপাশ থেকে ভেসে আসে, কি চুপ হয়ে গেলি যে!! আমার অনেক ইচ্ছা করছে ভাবীর মিস্টি গলা শুনতে তারপরও কথা বলব না কেন বলছি তার কারণ জানতে চাইবি না?
না পারতে বলার মত ফরিদ জিজ্ঞেস করে, কেন?
বাসর রাতে স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সাথে নতুন বউ কথা বললে অমঙ্গল হয়। কাল কথা বলব। আজ প্রবল ইচ্ছা দমিয়ে রাখছি। আচ্ছা তোদের এই সুন্দর সময় অনেক বিরক্ত করলাম। রাখি। আর ভাগ্যও ভাল তোর ফোন খোলা পেয়েছি। বাসর রাতে কেউ ফোন খোলা রাখে না।
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রেখে দেয় রকিব।
কারণটা জেনে ভাল লাগে লতার। প্রথমে যখন না বলল তখন অনেক খারাপ লেগেছিল। আসলে এরকম কথা আছে নাকি? থাকতেও পারে। বলা যায় না।
ফোন রাখার পর ভয় দূর হয়। এক টিপে লাল বাটনটা ধরে ফোন বন্ধ করে দেয় ফরিদ।
লতা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আমরা কি শুধু গল্পই করবো?
...................................
Sponsored By :