রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০১০

জ্বলা ও নেভা ( গল্প )

আমরা অবাক হতাম। এত তাড়াতাড়ি মেজবাহ অঙ্ক করে কিভাবে? স্যার করতে দিলে সবার আগে ও করে দিয়ে দেয়। অঙ্কগুলো যে সহজ তা না। তারপরও কি তাড়াতাড়ি করে ফেলে। দেখা যায় ও তাড়াতাড়ি করছে সে অবাক হজম করতে করতে আমাদের আর অঙ্ক করা হয় না।

আমাদের ব্যাচে বারো জন পড়ে। অন্য ব্যাচ গুলোতে আরো বেশি। এই ব্যাচটা যেহেতু দুপুরে তাই এখানে কম। আর আমাদের পাঁচজনের বন্ধ গ্রুপটা আছে বিধায় আমরা অনেক মজা করে পড়ি।


আটজন জন ছেলে। চারজন মেয়ে। সামনের বেঞ্চে বসে মেয়েরা। আমরা পিছনের ব্যাঞ্চে। একটা সমস্যা হয় সামনে শারমিন বসলে। অনেক লম্বা চুল। কেমন চিক চিক করে। সে সুন্দর চুলের দিকে তাকাবো না হোয়াইট বোর্ডে স্যারের করে দেওয়া অঙ্ক করবো সেটা ঠিক করতে সমস্যা হয়ে যায়। ইচ্ছা হয় চুলগুলোতে হাত ছুঁইয়ে দিই। তবে কখনো সাহস হয় না।

কিন্তু রবিন একটু সাহসী বেশি। সে মেয়েটার অজান্তে বেশ কয়েকবার চুল ধরেছে। পিছন থেকে দেখেছি আমরা। ধরা খাইলে যে কি অবস্থা হতো। যদিও তার ভাগ্য ভাল। নখের মত চুলেরও অনুভব শক্তি নাই।

প্রাইভেট শেষে আমরা পাঁচজন মাঠের এক কোণায় বসি। ভ্রাম্যমাণ হকা চা বিক্রী করে। সে চা উপভোগ্য করে খাই। কিছু না ভেবে। একদিন আমাদের স্বাস্থ্য সচেতন বন্ধু ইফতি ঘোষণা করে, এই চায়ের কাপ অনেক প্রকারের মানুষ মুখে লাগায়।
আমি প্রশ্ন করি, অনেক প্রকারের মানুষ বলতে?
আরে এই চা তো পরিবারের সদস্যরা খায় না। এগুলো তো খায় রিকসা অলা, ঠেলাগাড়ি অলা আরো কত ধরণের মানুষ। তাদের লালা লাগে। কাপগুলো কি জীবাণুমুক্ত ভাবে খাওয়া হয়। ওরা যেদিক দিয়ে ঠোট লাগিয়ে চা খায় আমরাও ঠিক সেদিক দিয়ে ঠোট লাগাই। কত রোগ হতে পারে।

ওর কথা শুনে আমাদের ঘৃণা লাগে চা গুলোর প্রতি। সর্বনাশ। এত দিন কি কাপে চা খেয়েছি? চা অলাকে ডাকছিলাম। তাকে ফেরত পাঠাই। হতাশ হয়ে মুখটা করুণ করে লোকটা চলে যায়।

রবিন বলে, তাহলে তুইও তো এতদিন আমাদের সাথে এই কাপেই চা খেয়েছিস। আগে কিছু বললি না যে?

ইফতি বলে, আগে এগুলো নিয়ে আগে ভাবি নাই। আজ ভাবলাম। তাই বলে দিলাম।

শামীম টিটকারী মারে, ওহ আজ তো কলেজে তানিয়া আসে নি। সেজন্য তাকে ভাবা বাদ দিয়ে রঙ চা নিয়ে ভাবছিস। কি স্বার্থপররে বাপ, না আসলে কি তার কথা ভাবা বাদ দিয়ে দিতে হবে?

শামীমের কথা শুনে সবাই হেসে উঠি। অদূরেই একটা ছেলে একটা মেয়ে গভীর আলাপ করছিলো। কি বলছিলো কে জানে। তবে খেয়াল করলাম আমাদের বিকট হাসি শুনে বিরক্ত চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। দেখি উঠে গেছে। আমাদের হাসির শব্দ বোধ হয় ঠিক মানাচ্ছে না তাদের রোমান্টিক পরিবেশে।

একটু পর রবিন চা অলাকে ডাকে। আমরা মানা করি। কিন্তু আমাদের মানা শুনে না রবিন। তোরা না খেলে না খা আমি খামু। এতদিন যখন খাইছি। আজও খামু।

এককাপ নিয়ে যেদিকে কাপের তোড়া ধরে সেদিকে ঠোট লাগায় রবিন। বলে, তোড়ার দিক দিয়ে ঠোট লাগিয়ে কেউ খায় না। তাই এদিকে খাইলে কোন সমস্যা নেই।

আমরাও খাই। মেজবাহ একটু কল্পনায় থাকতে পছন্দ করে। ওর মনে সব সময় কল্পনা ভর করে। এত কল্পনা নিয়েও কিভাবে যে অঙ্ক এত তাড়াতাড়ি করে কে জানে?

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অঙ্কে সবচেয়ে গাধা আমি। ওরা যখন চার নম্বর অঙ্ক করছে তখনও দেখা যায় আমি এক নম্বর অঙ্কটাই মিলাতে পারি নাই। মেজবাহকে জিজ্ঞেস করি, দোস্ত তুই এত তাড়াতাড়ি অঙ্ক করিস কিভাবে? আমাকে কিছু টিপস দেয় তো কিভাবে অঙ্কে ভাল করবো।

মেজবাহ গম্ভীর ভাবে হাসে। বলে, দেখানোর জন্য।
-মানে বুঝি না। আমরা সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাই।
মেজবাহ আবার বলা শুরু করে, আমাদের সাথে নমিতাকে আছে না?
হুম সব সময় একেবারে প্রথম বেঞ্চে বসে।
-ঐই মেয়েকে দেখানোর জন্যই আমি অঙ্ক আগে জমা দিই। যাতে আমার দিকে তাকায়। আমি কিন্তু অংকে এত ভাল না। প্রাইভেটে স্যারের অঙ্ক তাড়াতাড়ি করার জন্য রাত জেগে অঙ্ক করি। গতকালও রাত তিনটায় ঘুমিয়েছি।

-ওহ এই ব্যাপার।
আমি বলি, সুন্দর টিপসতো। নমিতাকে দেখানোর জন্য আমাকেও আগে আগে অঙ্ক করতে হবে। দাঁড়া আজ থেকে আমিও অঙ্কে সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছি।

আমার কথা শুনে মেজবাহ আঁতকে উঠে। -দোস্ত তুই অন্য মেয়েকে দেখা। প্লিজ আমার নমিতার দিকে চোখ দিস না।
রবিন বলে, নমিতা আবার তোর হলো কেমনে? আমি তো একদিন নিউমার্কেট দেখলাম ঐ মেয়ে একটা পোলার লগে হাঁটছে।

মেজবাহ উত্তেজিত হয়ে যায়, রবিন তুই উল্টাপাল্টা কিছু বলবি না। তোর স্বভাবই হচ্ছে বানায় বানায় কথা বলা। ভাল কে তুই কখনো ভাল বলিস না। তুই নিজে খারাপতো তাই সবাইকে খারাপ মনে করিস।

রবিন বলে, আমি তো খারাপ জানি। নমিতা তাহলে পৃথিবীর সেরা ভাল মেয়ে।
মেজবাহ দাঁত কিড়মিড় করে বলে, হা খুব ভাল মেয়ে। প্রাইভেটে দেখিস না, কোন ছেলের সাথে কথা বলে না?
-বা-হ-রে, ছেলেদের সাথে কথা না বললেই বুঝি ভাল মেয়ে হয়ে যায়। দাঁড়া নমিতার সাথে যদি অন্য ছেলের সম্পর্ক আমি তোকে না দেখাতে পারি তবে আমার নাম রবিন না।

আমরা ওদের তর্ক উপভোগ করি।
নমিতাকে নিয়ে আমাদের এত কথা বলা হয় যদিও তা জানে না নমিতা। কত মেয়ের সম্পর্কেই এভাবে আড্ডায় কথা হয়। অথচ অনেক মেয়েই তা জানে না। নমিতাও কিছু জানে না।

...........................................

টেস্ট পরীক্ষা চলে আসে। স্যার আগে সপ্তাহে তিনদিন পড়াতেন। এখন পড়ান পাঁচদিন। মেজবাহ সবচেয়ে খুশী। পাঁচদিন দেখতে পাবে নমিতার মুখ।
কিন্তু ওকে হতাশ হতে হয়। কোন বলা নেই কওয়া নেই বেশ কিছুদিন ধরে নমিতা প্রাইভেটে আসে না। মেজবাহ প্রাইভেটে মন মরা হয়ে বসে থাকে। আগের মত তাড়াতাড়ি অঙ্ক করে না। অনেক সময় লাগে। আগে অঙ্কের মাঝে কথা বলত মজার মজার। এখন চুপচাপ থাকে।

পরীক্ষার ঠিক তিনদিন আগে আসে নমিতা। এতদিন না আসার কারণ জানা যায়। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে।

আর কিছু সহ্য করতে পারে না মেজবাহ। যেদিন এটা জানল সেদিন থেকে আর প্রাইভেটে আসে না। আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করি মেজবাহর সাথে কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ।

টেস্ট পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না মেজবাহ। ওর বাসায় দুই বার যাই আমরা চারজন। কিন্তু জানা যায় ও নেই। বুঝতে পারি আমাদের এভয়েড করে চলতে চাচ্ছে সে।

মাঝে মাঝে বন্ধ নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠায়।

মেজবাহ এভাবে হারিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমি। ওর রোল আর আমার রোল পর পর। পরীক্ষা হলে আমার পিছেই সে পড়ে। ওর থেকে অঙ্ক দেখি।

কিন্তু এবার পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমার বুক ধক করে উঠে। পিছনের বেঞ্চে তাকাই। কিন্তু সেটা খালি । কেউ নাই। শূন্য বেঞ্চের দিকে মন খারাপ করে তাকাতে তাকাতে পরীক্ষার সময় শেষ হয়।

...................................
নতুন বর্ষে উঠি। নমিতা আসে। কিন্তু মেজবাহ আসে না। নমিতা আগের চেয়ে শুকায় গেছে। চেহারায় কেমন বিমর্ষতা। বিয়ের পর মেয়েদের সাথে কথা বলার সমস্যা কমে যায়। আমরাও কথা বলি নমিতার সাথে। কেমন আছো?
মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে ভাল আছি।
যদিও দেখে মনে হয় না। আমরা অবাক হই। বিয়ের পর মেয়েরা মোটা হয়। আর এই এভাবে শুকায় যায় কেন?

সময় কেটে যায়।
হঠাৎ একদিন দেখি মেজবাহর নাম্বার থেকে কল আসে। একবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ করি। ভাত খেতে যাচ্ছিলাম। সেটা ভুলে যাই।

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও বলে, দোস্ত আমার মন অনেক খারাপ।
আমি বলি, কেন? অনেক দিন পর কিভাবে আমাদের কথা মনে পড়ল।
-আজ নমিতার গাঁয়ে ওর হাজবেন্ড হাত তুলেছে।
আমি হতবাক হয়ে যাই। তুই জানলি কিভাবে?
-নমিতার সাথে আমার ফোনে যোগাযোগ হয়।
-তাই? কিন্তু নমিতা কিছু বলে নাই যে। ওর সাথে আমাদের কথা হয়। কিন্তু কখনো বলে নাই যে তোর সাথে যোগাযোগ আছে।
-আমিই বলতে মানা করছি।
-হুম বুঝছি। তোর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। কিন্তু ওর হাসবেন্ড ওকে মারবে কেন? ও তো অনেক ভাল মেয়ে।
-আরে ওর হাজবেন্ডটা একটা ফাউল লোক। মদটদও খায়।
এসব কি শুনছি? আমি বলি, নমিতার ফ্যামিলি কি ওর স্বামীর খোঁজ খবর নেয় নাই?

-আসলে নমিতা অনেক দুখী মেয়ে। তোরা জানিস না ওর অনেক কথা। ওর মা নেই। ওর ভায়ের বাসায় থাকত। ওর ভাবী কেন জানি ওকে সহ্য করতে পারত না। ওর ভাবীর প্ররোচনায় ওর ভাই ওকে তাড়াহুড়া করে বিয়ে দেয়। আসলে মা না থাকলে কেউ আর আপন থাকে না।

আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কি কষ্ট। আমি চুপ থাকি। কি বলব বুঝি না।
মেজবাহ বলে, একটা ব্যাপার কি জানিস? আমি যে ওকে পছন্দ করি ব্যাপারটা ও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ওর ভাই রাজি হবে না সেটা ভেবে কিছু বলে নাই।

আচ্ছা নমিতা তো কলেজে আসে। তুই আসিস না কেন? তুই যে পড়ালেখা বন্ধ করেছিস সেজন্য ও কিছু বলে না?
-বলে না মানে। সব সময় তো ঐইটাই আগে বলে। আবার রি এডমিশন নিতে।
-নিয়ে ফেল।
-নাহ আমি বেসরকারি থেকে পরীক্ষা দেব। তবে পড়ালেখায় কিচ্ছু করতে যে ইচ্ছা করে না।
এটা বলেই রেখে দেয় মেজবাহ। আমার অনেক কথার বলার ছিল। কল দিই। কিন্তু দেখি ওর মোবাইল বন্ধ।

নমিতার কারণে যেমন জ্বলে উঠেছিল মেজবাহ। সে নমিতার কারণেই নিভে গেল ও। আশ্চর্য। একটা মেয়ে কিই না পারে??